সাঈদ চৌধুরী ও ছালেহ আহমদ
সিলেটের গোলাপগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শহীদ পরিবারে স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে বাতাস। এটা ছিল গোলাপগঞ্জে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বর্বর হত্যাকান্ড। নিহত ও আহতদের অসহায় পরিবারকে দ্রুত সহায়তার জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকার এবং রাজনৈতিক ও সেবামূলক সংগঠন-সহ প্রবাসী মানবতাবাদী জনতার প্রতি আহবান জানিয়েছেন এলাকাবাসী। আহতদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করারও অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, পুলিশ ও বিজিবি মিলে ছাত্রজনতার উপর নির্মম হামলায় ৬জন খুন হন, আরেকজন খুন হয়েছেন দক্ষিণ সুরমা এলাকায়। আর আহত হয়ে মৃত্যুর মুখুমোখি রয়েছেন আরো অসংখ্য মানুষ। নিহত ৭জন হলেন- দক্ষিণ রায়গড় গ্রামের সুরই মিয়ার ছেলে হাসান আহমদ জয় (২০), নিশ্চিন্ত গ্রামের তৈয়ব আলীর ছেলে নাজমুল ইসলাম (২৪), শিলঘাট গ্রামের কয়ছর আহমদের ছেলে সানি আহমদ (২২), বারকোট গ্রামের মকবুল আলীর ছেলে তাজ উদ্দিন (৪০), দত্তরাইল এলাকার আলাই মিয়ার ছেলে মিনহাজ উদ্দিন (২৩), ঘোষগাঁও ফুলবাড়ি গ্রামের মোবারক আলীর ছেলে গৌছ উদ্দিন (৩৫) ও ঢাকাদক্ষিণ উত্তর কানিশাইল গ্রামের রফিক উদ্দিনের ছেলে ক্বারী মো: কামরুল ইসলাম পাবেল (২২)।
প্রতিবাদী মানুষের অন্তরের যন্ত্রণা ক্ষোভ রাগ প্রকাশের মিছিলে সারা দেশের মতো সিলেটের গোলাপগঞ্জে অংশ নিয়েছেন শিশু থেকে বৃদ্ধ সকল স্তরের মানুষ। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ছিল গ্রামের রাজপথ জনপদ। সেদিন হায়েনার মতো হত্যাকান্ডের ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের পাশাপাশি জড়িত ছিল পুলিশ ও বিজিবি। মানুষের রক্তের জন্য তারা যেন উম্মাদ হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবাদী জনতার মিছিল থামিয়ে দেয়ার জন্য বেপরোয়া ছিল গোলাপগঞ্জ থানার ওসি ও স্থানীয় এসিল্যান্ড।
স্থানীয় সূত্র মতে, ৪ আগস্ট সকাল ১১টায় গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জড়ো হতে থাকেন আপামর জনতা। বিভিন্ন স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজের শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ছড়িয়ে পড়েন প্রধান প্রধান সড়কে। একটি মিছিল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে আসামাত্র আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কতিপয় কর্মী মারমুখী হয়ে ওঠে। তাদের পক্ষ নিয়ে বিজিবির সদস্যরা সরাসরি মিছিলে গুলি করলে বহু মানুষ হতাহত হন। এসময় ঘটনাস্থলে এসিল্যান্ড অভিজিৎ চৌধুরী এবং ওসি-সহ পুলিশের কিছু সদস্যকে উন্মাদের মতো বেপরোয়া আচরণ করতে দেখা গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবাদী মিছিলে হঠাৎ এমন ভয়াবহ গুলির ঘটনায় গ্রামীণ জনপদের সাধারণ ছাত্র-জনতা তাজ্জব হয়ে পড়েন। সেখানে মারাত্বভাবে গুলিবিদ্ধ হন নাজমুল, হাসান, ছানি। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাদের মৃত ঘোষণা করা হয়। খবর পেয়ে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়েন। তখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে পুলিশ-বিজিবির হামলায় নিহত হন তাজ উদ্দিন নামে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী। শিক্ষার্থীদের আরেকটি মিছিল এমসি একাডেমির সামনে হামলার শিকার হয়। পুলিশের সহায়তায় আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সশস্ত্র হামলায় গুলিবিদ্ধ হন মিনহাজ ও গৌছ। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পর তাদের মৃত ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও সিলেটের ক্বীন ব্রীজের পাশে পুলিশের গুলিতে মারা যান ঢাকাদক্ষিণ উত্তর কানিশাইল গ্রামের রফিক উদ্দিনের ছেলে ক্বারী মো: কামরুল ইসলাম পাবেল।
শত শত মানুষের রক্তে রঞ্জিত গোলাপগঞ্জে শুধু মিছিলে নয়, ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাওয়া মানুষকে পেছন থেকে গুলি করে্ও হত্যা করা হয়েছে। পাখির মতো মানুষ মারার দৃশ্য অবলোকন করে বহু লোক এখনো ঘুমের মাঝে শিহরিত হন। যাদের রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ, গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাদেরকে জাতি যেন সহজেই ভুলতে বসেছে।
শুধু কি তাই? নির্মম হলেও সত্য যে, এখনো অনেক খুনি ঘুরে বেড়াচ্ছে বাহাদুর সেজে। কেউ কেউ অন্য রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে মামলা থেকে নিস্কৃতি পাচ্ছে। নিহত ও আহতদের দায়েরকৃত মামলায় আসামীর তালিকায় খুনিদের অনেকের নাম নেই বলে জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশের পরও কেউ কথা বলছেনা। খবরে প্রকাশ, মনগড়া এজাহার দিতে বাধ্য করছেন একটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। সূত্র মতে, মামলা বাণিজ্য চালানো হচ্ছে খুন ও নিপীড়নের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আসামীর তালিকা থেকে বাদ দিয়ে বড় অংকের টাকা পকেটস্থ করছেন কেউ কেউ।
সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন কর্মী সাকিব আহমেদ সতর্ক করে দিয়ে লিখেছিলেন, ‘আপনারা কি ইদানীং খেয়াল করেছেন যে ফেসবুকে জুলাই-অগাস্টের গণহত্যার কোন ক্লিপ বা কোন স্ট্যাটাস আর ভেসে বেড়াচ্ছেনা? খেয়াল করেছেন ফ্যাসিস্ট হাসিনার চালানো নির্যাতনের স্টিমরোলার নিয়ে কেউ লিখছেনা? কেউ ফ্যাসিস্ট হাসিনার সন্ত্রাসী দ্বারা পাখির মত গুলি করে মানুষ হত্যা নিয়ে কবিতা লিখেছেনা- খেয়াল করেছেন? অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়া নিয়ে কোন পোস্ট ভাইরাল হচ্ছেনা কেন? খেয়াল করেছেন? … খুব নীরবের নিভৃতে কুকৌশলে আমাদেরকে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে জুলাই-অগাস্টের সেই ভয়ংকর গণহত্যার কথা। খুব টেকটিক্যালি আমাদের মানসপট থেকে উধাও করে দেওয়া হচ্ছে খুনী হাসিনার চালানোর ১৬ বছরের নির্যাতনের চিত্র। খুব সন্তর্পণে আমাদেরকে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ফ্যাসিস্ট হাসিনার মাধ্যমে একটা দেশকে পঙ্গু করে দেওয়ার কাহিনী। এটাই মূলত বিপ্লবের পরে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার সহযোগী খুনিদের সবচেয়ে বড় সফলতা’।
গোলাপগঞ্জে ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে জামাতের শোকসভা
গোলাপগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ৭ শহীদের স্মরণে নাগরিক শোকসভা ও তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান নিহতদের কবর জিয়ারত ও তাদের পরিবারের সদস্যের সাথে দেখা করে আর্থিক অনুদান প্রদান করেন।
সম্প্রতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে এই নাগরিক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর জিন্নুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও পৌর জামায়াতের নায়েবে আমীর রেহান উদ্দিন রায়হান ও উপজেলা জামায়াতের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি এহতেশামুল আলম জাকারিয়া’র যৌথ পরিচালনায় অনুষ্ঠানে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘এই আন্দোলনে প্রতিটি শহীদ আমাদের জাতীয় বীর। তাদের চরম সাহসিকতার দৃশ্য সারা দেশ এমনকি সারা বিশ্ব দেখেছে। তাদের আত্মত্যাগ আমাদের নতুন করে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।’ তিনি গোলাপগঞ্জের ৭ শহীদের খুনি-সহ সংস্কার আন্দোলন দমনে সকল হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।
নাগরিক শোকসভা ও দোওয়া মাহফিলে বিশেষ অতিথি ছিলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ জামায়াতের আমীর মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন। আরো উপস্থিত ছিলেন সিলেট মহানগর জামায়াতের আমীর ফখরুল ইসলাম, নায়েব আমীর মাওলানা সোহেল আহমদ, সিলেট জেলা দক্ষিণ জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাওলানা লোকমান আহমদ, জেলা উত্তরের আমীর হাফিজ আনোয়ার হোসেন খান, সেক্রেটারি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, জেলা অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সাইফুল্লাহ আল হোসাইন, গোলাপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ নজমুল ইসলাম, গোলাপগঞ্জ পৌর জামায়াতের আমীর মাওলানা আব্দুল খালিক, উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আব্দুল আজিজ, ঢাকাদক্ষিণ ইউপি চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুর রহিম-সহ উপজেলা ও পৌর জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতৃবৃন্দ।
গোলাপগঞ্জে নিহত ৭ জন ও সিলেটে নিহত এটিএম তোরাবের মাগফেরাত কামনা
এদিকে গোলাপগঞ্জে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ৭ শহিদ ও সিলেটে নিহত সাংবাদিক এটিএম তোরাবের মাগফেরাত কামনায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নিহত ও আহতদের অসহায় পরিবারকে দ্রুত সহায়তা দরকার
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ও আহতদের অসহায় পরিবারকে দ্রুত সহায়তার জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকার এবং রাজনৈতিক ও সেবামূলক সংগঠন-সহ প্রবাসী মানবতাবাদী জনতার প্রতি আহবান জানিয়েছেন এলাকাবাসী। আহতদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) এক সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- ১. বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রাণহানির সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করে তাদের শহীদের মর্যাদা দিতে হবে এবং নিহত সবার পরিবারকে এককালীন ক্ষতিপূরণ বাবদ এক কোটি টাকা দিতে হবে। ২. সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে আহত সবার পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে হবে এবং তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান দিতে হবে। ৩. সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অনেক রোগী আছেন, যাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক, তাদের অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. আন্দোলনে আহতদের এককালীন ক্ষতিপূরণ ও দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ৫. আহত শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার যাবতীয় খরচ সরকারকে বহন করতে হবে এবং তাদের পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা করতে হবে। এছাড়া আন্দোলনে নিহতদের শহীদের মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের পরিবারকে এককালীন এক কোটি টাকা দেওয়ার অনুরোধ করেছেন তারা।