গাজায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ইসরায়েল এবং হামাস

মধ্যপ্রাচ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

গাজায় ১৫ মাসের যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হামাস এবং ইসরায়েল একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছেছে। দীর্ঘ কয়েক মাস আলোচনার পর এই চুক্তিতে পৌঁছুলো উভয় পক্ষ, যার অন্যতম মধ্যস্থতাকারী ছিল কাতার।

আলোচনার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বিবিসিকে বলেছে “কাতারের প্রধানমন্ত্রীর সাথে হামাস এবং ইসরায়েলের মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে পৃথক বৈঠকের পর উভয় পক্ষ গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তি দেয়ার বিষয়ে চুক্তিতে সম্মত হয়েছে”।

যুদ্ধবিরতির খবর জানার পর গাজায় ফিলিস্তিনিদের অনেককে রাস্তায় উল্লাস করতে দেখা গেছে। বিবিসির গাজা সংবাদদাতা রুশদি আবুআলুফ বলছেন, এই চুক্তির ফলে গাজা শহর এবং দক্ষিণ গাজা থেকে লক্ষ লক্ষ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা এখন তাদের নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে পারবেন।

ফিলিস্তিনিদের জন্য চুক্তির অন্যতম দিক হলো, এর ফলে রাফাহ সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন ছয়শ ট্রাক ত্রাণ এবং চিকিৎসা সামগ্রী প্রবেশ করতে দেয়া হবে। গাজায় অবশিষ্ট হাসপাতালগুলোকে সচল রাখতে ৫০ টি জ্বালানী ভর্তি লরিও পাঠানো হবে বলে জানা যাচ্ছে।

এদিকে চু্‌ক্তির পর যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন “এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র নভেম্বরের ঐতিহাসিক বিজয়ের কারণে”। এর আগে তার সামাজিক মাধ্যম, ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লেখেন “মধ্যপ্রাচ্যে জিম্মিদের জন্য আমরা একটি চুক্তি করছি। তারা খুব দ্রুতই মুক্তি পাবে”।

চু্ক্তির আওতায় হামাস ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দেবে। বিবিসি ভেরিফাইয়ের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর জিম্মি করা ২৫১ জনের মধ্যে ৯৪ জন এখনো গাজায় রয়েছে। এদের মধ্যে ৬০ জন এখনো জীবিত এবং ৩৪ জন মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জেরুজালেম থেকে বিবিসি সংবাদদাতা জোনাহ ফিশার জানাচ্ছেন, কয়েকটি পর্যায়ে এই চুক্তিটি বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানা যাচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে ছয় সপ্তাহের একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকবে। এই সময়ে হামাস ৩৩ জন জিম্মিকে মুক্তি দেবে। প্রতিজন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেয়ার বিনিময়ে ইসরায়েল বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনী বন্দিকে মুক্তি দেবে।

২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েল ব্যাপক হামলা চালানো শুরু করে। এসব হামলায় গত ১৫ মাসে ৪৬ হাজার ফিলিস্তিনীকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই থেকে পাওয়া চুক্তির সম্পূর্ণ বিবরণ

১. দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রস্তুতি
পক্ষগুলো ও মধ্যস্থতাকারীদের লক্ষ্য হল বন্দী ও পণবন্দীদের বিনিময়-সংক্রান্ত ২০২৪ সালের ২৭ মে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটি চূড়ান্ত ঐকমত্য অর্জন করা এবং শান্তিতে ফিরে আসা যা পক্ষগুলোর মধ্যে একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি অর্জন করতে সাহায্য করবে।

প্রথম পর্যায়ের সকল প্রক্রিয়া দ্বিতীয় পর্যায়ে অব্যাহত থাকবে যতক্ষণ না দ্বিতীয় পর্যায় বাস্তবায়নের শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা চলমান থাকে এবং এই চুক্তির জামিনদাররা একটি চুক্তিতে পৌঁছানো পর্যন্ত আলোচনা অব্যাহত রাখবেন।

২. ইসরাইলি বাহিনী প্রত্যাহার
গাজা উপত্যকার সীমান্তবর্তী ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে পূর্ব দিকে ইসরাইলি বাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে ওয়াদি গাজা (নেটজারিম অক্ষ ও কুয়েত চৌরাস্তা)।

সীমান্তের দক্ষিণ ও পশ্চিমে এবং চুক্তির উভয় পক্ষের সম্মত মানচিত্রের ভিত্তিতে ইসরাইলি বাহিনীকে (৭০০) মিটার পরিধির মধ্যে মোতায়েন করা হবে। তবে পাঁচটি স্থানীয় জায়গায় তা ব্যতিক্রম থাকবে, যা ইসরাইলি পক্ষ থেকে নির্ধারিত (৪০০) মিটারের বেশি অতিরিক্ত হবে না।

৩. বন্দী বিনিময়
ক. ১১০ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি বন্দীর মুক্তির বিনিময়ে ৩৩ জনের তালিকা থেকে নয়জন অসুস্থ ও আহতকে মুক্তি দেয়া হবে।

খ. ইসরাইল ৮ অক্টোবর ২০২৩ থেকে এক হাজার গাজার বন্দীকে মুক্তি দেবে যারা ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর সাথে জড়িত ছিলেন না। গ. ৩৩ জনের তালিকা থেকে বয়স্কদের (৫০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষদের) মুক্তি দেয়া হবে বিনিময় হার ১:৩ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১:২৭ অন্যান্য সাজা অনুসারে। ঘ. এব্রা মাঙ্গেস্তো ও হেশাম এল-সাইদ ১:৩০ বিনিময় হার অনুসারে মুক্তি পাবেন। সেই সাথে ৪৭ জন শালিত বন্দীকেও মুক্তি দেয়া হবে। ঙ. উভয়পক্ষের মধ্যে সম্মত তালিকার ভিত্তিতে বিদেশে বা গাজায় বেশ কিছু সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেয়া হবে।

৪. ফিলাডেলফি করিডোর
ক. সংযুক্ত মানচিত্র ও উভয়পক্ষের মধ্যে চুক্তির ভিত্তিতে ইসরাইল প্রথম পর্যায়ে করিডোর এলাকায় ধীরে ধীরে সৈন্য হ্রাস করবে। খ. প্রথম পর্যায়ের শেষ বন্দী মুক্তির পর, ৪২তম দিনে ইসরাইলি বাহিনী তাদের প্রত্যাহার শুরু করে ৫০তম দিনের মধ্যে তা সম্পন্ন করবে।

৫. রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং
ক. সকল নারী (বেসামরিক ও সৈন্য) মুক্তির পর রাফাহ ক্রসিং বেসামরিক নাগরিকদের স্থানান্তর এবং আহতদের জন্য প্রস্তুত থাকবে। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সাথে সাথেই ইসরাইল ক্রসিংয়ের প্রস্তুতির জন্য কাজ করবে। খ. সংযুক্ত মানচিত্র অনুসারে রাফাহ ক্রসিংয়ের চারপাশে ইসরাইলি বাহিনী পুনরায় মোতায়েন করা হবে। গ. প্রতিদিন ৫০ জন আহত সামরিক ব্যক্তিকে (৩) জন ব্যক্তির সাথে পারাপারের অনুমতি দেয়া হবে। প্রতিটি পারাপারের জন্য ইসরাইল ও মিসরের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। ঘ. মিসরের সাথে আগস্ট ২০২৪ সালের আলোচনার ভিত্তিতে ক্রসিংটি পরিচালিত হবে।

৬. অসুস্থ ও আহত বেসামরিক নাগরিকদের বের করে আনা
২৭ মে ২০২৪ সালের চুক্তির ১২ ধারা অনুসারে, সকল অসুস্থ ও আহত ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিককে রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং দিয়ে পার হতে দেয়া হবে।

৭. নিরস্ত্র অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের প্রত্যাবর্তন (নেটজারিম করিডোর)
ক. ২৭ মে ২০২৪ সালের চুক্তির ধারা ৩-ক এবং ৩-খ এর উপর ভিত্তি করে নিরস্ত্র অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের প্রত্যাবর্তনে সম্মত হয়েছে। খ. ৭ম দিনে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত পথচারীদের অস্ত্র বহন না করে এবং রশিদ স্ট্রিট দিয়ে অনুসন্ধান ছাড়াই উত্তর দিকে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। ২২তম দিনে তাদের সালাহুদ্দিন স্ট্রিট থেকেও অনুসন্ধান ছাড়াই উত্তর দিকে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। গ. ৭ম দিনে যানবাহন ও পথচারী ছাড়া অন্য যেকোনো যানবাহনকে অনুসন্ধানের পর নেটজারিম করিডোরের উত্তরে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। যানবাহন অনুসন্ধান একটি বেসরকারি কোম্পানি করবে। একটি সম্মত প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে মধ্যস্থতাকারীরা ইসরাইলি পক্ষের সাথে একমত হয়ে এই বেসরকারি কোম্পানি নির্ধারণ করবে।

৮. মানবিক সহায়তা প্রোটোকল
ক. চুক্তির অধীনে মানবিক সহায়তা প্রক্রিয়াগুলো মধ্যস্থতাকারীদের তত্ত্বাবধানে সম্মত মানবিক প্রোটোকলের অধীনে সম্পন্ন করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *