খালেদাকে জড়িয়ে ধরেন তারেক, নজর কেড়েছে মা-পুত্রের আবেগঘন মুহূর্ত

বাংলাদেশ যুক্তরাজ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী:

লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান তাঁর বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও পুত্রবধূ জুবাইদা রহমান-সহ পরিবারের সদস্যরা। অনেক দিন পর মা-পুত্রের সাক্ষাতের আবেগঘন মুহূর্তটি উপস্থিত সকলে নজর কেড়েছে। এর আগে ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই বেগম জিয়া লন্ডন সফর করেন। তারপর মা-পুত্রের আর কোন সাক্ষাৎ হয়নি।

ভিডিওতে দেখুন:

যুক্তরাজ‍্যে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার হজরত আলী খান এবং যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালিক ও সাধারণ সম্পাদক কয়ছর এম আহমেদ হিথরোতে খালেদা জিয়াকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। এসময় বিমানবন্দর এলাকায় সমবেত বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী বেগম জিয়াকে স্বাগত জানিয়ে স্লোগান দেন।

কাতারের আমীর তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জন্য সর্বাধুনিক চিকিৎসা–সুবিধা তথা যন্ত্রপাতি, মেশিনারি ও ল্যাবরেটরি সমৃদ্ধ এয়ার এম্বুলেন্স পাঠান। আমীরের পাঠানো বিশেষ এয়ার এম্বুলেন্স করে মঙ্গলবার রাতে বাংলাদেশ থেকে যাত্রা করে লন্ডনের হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন বুধবার সকাল সোয়া ১০টায়। এখানে হিথ্রো কর্তৃপক্ষ খালেদা জিয়াকে ভিআইপি প্রটোকল প্রদান করে।

বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তারেক রহমান মাকে নিয়ে সেন্ট্রাল লন্ডন উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। নিজে গাড়ি চালিয়ে প্রায় ১১টার সময় দ্য ক্লিনিক হাসপাতালে পৌঁছেন। এ সময় পরিবারের সদস্যরাও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।

খালেদা জিয়া ‍উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন এসেছেনে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস-সহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। বাংলাদেশ থেকে খালেদা জিয়ার সাথে আসা চিকিৎসকেরা লন্ডনের দ্য ক্লিনিক’র চিকিৎসকেরদের কাছে তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় সমন্বয় করছেন।

লন্ডনে প্রাথমিক চিকিৎসার পর খালেদা জিয়ার আরো চিকিৎসা গ্রহনের কথা রয়েছে আমেরিকার মেরিল্যান্ডে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের তিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ঢাকায় খালেদা জিয়ার শরীরে রক্তনালিতে সফল অস্ত্রোপচার হয়েছিল। সুত্র মতে, খালেদা জিয়ার লিভার প্রতিস্থাপন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। সামগ্রীক চিকিৎসায় দুই মাসের মতো লেগে যেতে পারে।

২০১৮ সালে কারাগারে যাওয়ার পর খালেদা জিয়া মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবস্থা জটিল হলে বিএনপি এবং পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে তাঁর বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়। তৎকালীন আওয়ামী সরকার তা অগ্রাহ্য করে। সবাই যখন চূড়ান্তভাবে আশাহত, ঠিক তখন আগস্ট বিপ্লবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর খালেদা জিয়া মুক্তি পান। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মামলার রায়ও আদালত থেকে বাতিল হয়।

ঢাকা থেকে যাত্রা

মঙ্গলবার রাত পৌণে বারটায় কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেন খালেদা জিয়া। বিমানবন্দরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা তাঁকে বিদায় জানান। গুলশান থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে খালেদা জিয়াকে বিদায় জানাতে শত শত মানুষ দীর্ঘক্ষণ দাড়িয়ে অপেক্ষা করেন খালেদা জিয়াকে এক নজন দেখার জন্য। দলীয় নেতা-কর্মী ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন।

তারও আগে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার, তাঁর স্ত্রী কানিজ ফাতিমা, তাঁর ভাই মরহুম সাঈদ ইস্কান্দারের স্ত্রী নাসরিন ইস্কান্দার-সহ পারিবারিক স্বজনেরা তাঁকে বিদায় জানান। বিমানবন্দরের পথে গাড়িতে খালেদা জিয়ার সাথে ছিলেন ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান সিঁথি।

সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন

লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে গতকাল সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর-সহ দলের সিনিয়র নেতারা। খালেদা জিয়া বাসভবন থেকে রওনা হওয়ার পর সেখানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘ম্যাডাম আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীসহ সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।’

সাথে এসেছেন যারা

খালেদা জিয়ার সাথে রয়েছেন তাঁর চিকিৎসার জন্য গঠিত বোর্ডের সদস্য- মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিক, অধ্যাপক নরুদ্দিন আহমেদ, জাফর ইকবাল, অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও মোহাম্মদ আল মামুন। এছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এনামুল হক চৌধুরী, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল, খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার ও প্রটোকল অফিসার এসএম পারভেজও খালেদা রয়েছেন।

কাতার রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসলাম। বুধবার কাতার হামাদ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে সাক্ষাৎ করেন তিনি। এ সময় রাষ্ট্রদূত খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নেন। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে তার সুস্থতা কামনা করেন।

‘অনেক প্রশ্ন পেছনে রেখে লন্ডন গেলেন খালেদা জিয়া’

‘অনেক প্রশ্ন পেছনে রেখে লন্ডন গেলেন খালেদা জিয়া’ বিবিসি বাংলার এমন খবরে অনেকেই উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বিএনপি নেতারা অবশ্য বলছেন অতীত ইতিহাস ও রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে ‘খালেদা জিয়া ফিরবেন কি না কিংবা ফিরতে পারবেন কি না’, এমন নানা আলোচনা ডালপালা মেলেছে, তবে এসব আলোচনার কোনো ভিত্তি নেই বলেই মনে করেন তারা।

“আমরা আশা করছি চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে খালেদা জিয়া দেশে ফিরবেন ও দেশকে নেতৃত্ব দিবেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলছেন, “পুরানো তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে দেশের মানুষ হয়তো চিন্তা করছেন। কিন্তু এখানে ভীত হওয়ার কারণ নেই , যদিও সতর্ক থাকতে হবে,” বলছিলেন তিনি।

উল্লেখ্য, খালেদা জিয়ার সুদূঢ় নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয় এবং তিনি হন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। তখন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনকে নতুন ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। আর জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ জতীয়তাবাদী দল’ তাঁর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি, সততা, দেশপ্রেম এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচী তথা ১৯ দফা কর্মসূচীর মাধ্যমে খুব সহজেই সর্ব সাধারণের মন জয় করতে সক্ষম হয়। রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম দৃঢ়তা ও মননশীলতার ‘আইকন’ হয়ে ওঠেন খালেদা জিয়া।

* সাঈদ চৌধুরী দৈনিক সময় ও মানব টিভি সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *