কিডনি পাচার চক্রে জড়িত সন্দেহে দিল্লিতে গ্রেফতার বাংলাদেশিসহ সাত জন

এশিয়া বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক কিডনি পাচারের তদন্ত করতে গিয়ে একটা বড়সড়ো চক্রের হদিশ পেয়েছে দিল্লির পুলিশ। আন্তর্জাতিক কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশি নাগরিক, এক ভারতীয় চিকিৎসক, তার সহযোগী-সহ মোট সাতজনকে গ্রেফতার করেছে দিল্লির অপরাধ দমন শাখার পুলিশ।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশের বলে পুলিশ জানিয়েছে। ধৃত চিকিৎসক বিজয়া রাজা কুমারী দিল্লির দুটি বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। দিল্লির অ্যান্টি ক্রাইম ব্রাঞ্চের ডিসিপি অমিত গোয়েল সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, “অপরাধ দমন শাখা একটি আন্তর্জাতিক চক্রের সন্ধান পেয়েছে যারা বেআইনি ভাবে অঙ্গ পাচারের সঙ্গে জড়িত। এই চক্রের শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশি একজন নাগরিক যার নাম রাসেল।”

“তদন্ত করে আমরা জানতে পেরেছি এই ঘটনায় রোগী এবং দাতা দুই-ই বাংলাদেশি নাগরিক। রাসেল নামক ওই অঙ্গ পাচার চক্রের মাধ্যমে রোগী এবং অঙ্গ দাতা দুজনকেই জোগাড় করত।”

সম্প্রতি রাজস্থানের দুর্নীতি দমন শাখার কর্তারা অভিযান চালিয়ে কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন ব্যক্তির খোঁজ পায় সেই রাজ্যে। আন্তর্জাতিক কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত ওই ব্যক্তিরা জাল নথি তৈরি করত, যার ভিত্তিতে ভারতের হাসপাতালে বাংলাদেশ থেকে আসা রোগীদের বেআইনি ভাবে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হতো।

সেই মামলার তদন্ত করতে গিয়েই এই চক্রের সঙ্গে জড়িত অন্য ব্যক্তিদের হদিশ মিলেছে। গত দুই সপ্তাহে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের তিনজন নাগরিকসহ মোট সাতজনকে গ্রেফতার করেছে দিল্লি পুলিশ। বার্তা সংস্থা এএনআইকে পুলিশ জানিয়েছে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হতো। রোগীর পরিবারের কাছ থেকে ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা চাওয়া হতো। ২০১৯ সাল থেকে সক্রিয় ছিল এই চক্র।

দিল্লির অ্যান্টি ক্রাইম ব্রাঞ্চের ডিসিপি অমিত গয়েল বলেন, “রাসেলকে আমরা গ্রেফতার করেছি। একইসঙ্গে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে যে হাসপাতালে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হতো, সেখানকার চিকিৎসকও রয়েছেন। তিনি এই চক্রের সঙ্গে কাজ করতেন। হাসপাতালের সন্দেহভাজন কর্মীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।” প্রসঙ্গত, এই ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও একইরকমের কিডনি পাচার চক্র যার সঙ্গে বাংলাদেশের যোগ রয়েছে তার হদিশ পাওয়া গিয়েছিল।

চিকিৎসকের ভূমিকা নিয়ে পুলিশ যা বলছে

দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে বিজয়া রাজা কুমারী নামে যে চিকিৎসককে গ্রেফতার করা হয়েছে, তিনি এই চক্রের সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে যুক্ত ছিলেন বলে তদন্তে জানা গিয়েছে। সিনিয়র রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট সার্জেন বা কিডনি প্রতিস্থাপক শল্যচিকিৎসক হিসাবে কাজ করতেন তিনি।

ড. বিজয়া রাজা কুমারী দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ অঞ্চলের একটি হাসপাতালের ফি-ফর-সার্ভিসের ভিত্তিতে চিকিৎসক হিসাবে কাজ করতেন। তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে, তিনি দিল্লির নয়ডার অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে অমিত গোয়েল বলেন, “এই চক্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন ওই চিকিৎসক। উনি এই বেআইনি পাচারের বিষয়ে জানতেন। নিয়ম মেনে যে রোগীর কোনও আত্মীয় যে অঙ্গ দান করছেন না, তা তিনি জানতেন। তা সত্ত্বেও অস্ত্রোপচার করে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করেছেন।”

কোন হাসপাতালে এই বেআইনি প্রতিস্থাপন করা হতো, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বলেন, “ওই চিকিৎসক একটি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত যেখানে এই বেআইনি কাজ চলত। আর এখনও পর্যন্ত তদন্তে দুটো হাসপাতালের নাম উঠে এসেছে। আমরা ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও বিশদে জানার চেষ্টা করছি।”

যেসব হাসপাতালের সাথে যুক্ত ছিলেন ডা. বিজয়া রাজা কুমারী, তার একটি ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপেলো হসপিটালের একজন মুখপাত্র সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “পুলিশের তদন্তের পর ওই চিকিৎসককে সাসপেন্ড করা হয়েছে।”
“এর আগে ক্রাইম ব্রাঞ্চের তরফে ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপেলো হসপিটালের কাছে কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছিল, আমরা তা সরবারহ করেছি। তবে ওই তদন্ত অন্য এক হাসপাতালের প্রসঙ্গে ছিল। তারপরেই ওই চিকিৎসককে আমরা সাসপেন্ড করেছি। ঘটনার (অঙ্গ পাচার) সঙ্গে ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপেলো হসপিটাল কোনও ভাবেই জড়িত নয়।”

অন্য যে বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে ধৃত চিকিৎসক যুক্ত ছিলেন সেখানে তিনি ভিজিটিং কনসালটেন্ট হিসাবে কাজ করতেন। ইয়াথার্থ হাসপাতালের অতিরিক্ত মেডিক্যাল সুপারিনটেনডেন্ট সুনীল বালিয়ান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন ভিজিটিং কনসালট্যান্ট হিসেবে হাসপাতালে কাজ করছিলেন ড রাজা কুমারী । তার আনা রোগীদের অঙ্গ প্রতিস্থাপন করতেন।

মি. বালিয়ান বলেন, “ইয়াথার্থের কোনো রোগীর চিকিৎসার দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়নি এবং গত তিন মাসে তিনি একটা অস্ত্রোপচার করেছেন।”

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে আসা রোগীদের দিল্লি অঞ্চলের বড় বড় হাসপাতালগুলিতে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিত ওই চক্রের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। ড. রাজা কুমারী এবং তার সহযোগী অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করতেন। ভুয়ো নথি তৈরি করে দাতাদের রোগীর আত্মীয় বলে দেখানো হতো।

কী ভাবে কাজ করত এই চক্র

পুলিশ জানিয়েছে ধৃত অভিযুক্ত রাসেল ও তার সহযোগীরা বাংলাদেশের কিডনির সমস্যায় রয়েছেন, এমন রোগীদের খুঁজে বের করত। এর জন্য মূলত ডায়ালেসিস সেন্টার গুলোর উপর নজর রাখত তারা। রোগীদের ভারতে এনে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হতো। অন্যদিকে, দাতা হিসাবে খুঁজে আনা হত আর্থিকভাবে কমজোর ব্যক্তিদের। এদের মধ্যে কাউকে আবার ভারতে কাজের সুযোগ করে দেওয়ার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েও নিয়ে আসা হতো বলে অভিযোগ। এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত ‘মিডলম্যানরা’ দাতাদের ৪-৫ লক্ষ টাকা দিত যদিও রোগীর কাছ থেকে ২৫-৩০লক্ষ টাকা আদায় করা হতো ।

যেভাবে হদিশ পাওয়া গেল এই চক্রের

গত এপ্রিল মাসে রাজস্থানের দুর্নীতি দমন ব্যুরো অর্থের বিনিময়ে ভিনদেশী নাগরিকদের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য ভুয়ো নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট ইস্যু করার চক্রের অভিযানে নেমে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। ধৃতদের কাছ থেকে জানা যায় এই চক্রের সঙ্গে দিল্লির যোগ। রাজস্থান পুলিশের তথ্যের উপর ভিত্তি করে সম্প্রতি অভিযান চালায় দিল্লির অপরাধ দমন শাখার পুলিশ। চক্রের প্রধান, রাসেলকে গ্রেফতার করার পর পুলিশই জেরায় সে তার এক সহযোগীর নাম ফাঁস করে।

মোহাম্মদ শারিক নামে তার ওই সহযোগী উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা বলে পুলিশ জানিয়েছে। জেরা করে জানা গিয়েছে, তার কাজ ছিল ড. রাজা কুমারীর কাছ থেকে প্রতিস্থাপনের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া । অস্ত্রপোচারের আগে যে সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় তার ব্যবস্থা করা। অন্যদিকে, ড. রাজকুমারীর সহযোগী ব্যবস্থা করত দাতার ভুয়ো নথিপত্র তৈরি। দাতাদের দেখানো হতো রোগীর আত্মীয় হিসাবে। মহম্মদ শারিক ও রাসেলের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে পরে ওই চিকিৎসক এবং তার সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়। – বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *