কবি দিলওয়ার বাংলা সাহিত্যের এক প্রবাদ পুরুষ। তার মন ছিল গভীর ঐশ্বর্যময়। স্বভাব ছিল বহতা নদীর মতো, সতত বহমান।
দিলওয়ার এক বিস্ময় প্রতিভা। মানুষ হিসেবে এবং কবি হিসেবে ছিলেন অনেক বড় মাপের অনন্য একজন। তিনি গণমানুষের কবি। মুক্তিকামী মানুষের কবি। তার নিজের ভাষায়-
‘পৃথিবী স্বদেশ যার, আমি তার সঙ্গী চিরদিন’।
কাব্যের সুদূর প্রসারী আবেদন সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন বলেই কবি বলতে পেরেছেন-
‘এবার এলো শক্তিহীনের/ শক্তি লাভের দিন/ নবীন ভুবন সৃষ্টি হবে/ ঐক্যে অমলিন।‘
২০০১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা টাউন হলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সংঘ কর্তৃক কবি দিলওয়ারকে প্রদত্ব সংবর্ধনার মানপত্রে উল্লেখ করা হয়- ‘সাথী আজ তোমাকে সংবর্ধিত করার সুযোগ পেয়ে আমরা আনন্দিত। তোমাকে সম্মান জানানোর নাম মানুষকে ভালোবাসা। … তুমি কোনো একটি দেশের নও। কোনো দেশের কোন সীমানা তোমাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। তোমার আশ্চর্যজনক সুস্থমন, প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও দৃঢ় আত্মসম্মানবোধ তোমাকে এক কর্মযোগী করে তুলেছে।’
কবি দিলওয়ার সাম্য, মানবতা ও শোষিত মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। তিনি আমাদেরে অনেক স্মরণীয় রচনা উপহার দিয়েছেন। তার কবিতার বহু পংক্তি সাধারণ মানুষেরও মুখস্থ। সমাজ পরিবর্তনে সংগ্রামীদের উদ্দীপ্ত করে তার এসব ছড়া ও কবিতা।
জাতীয় মুক্তির সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি বলেন- ‘চাই বিপ্লব, চাই বিপ্লব, চাই/ বিপ্লব ছাড়া মুক্তির উপায় নাই/ পুরাতন করে কর্তন/ আনো নব পরিবর্তন/ নরদানবের বংশ/ করবো সমুলে ধ্বংস/ বুঝে নাও আজ এই ধরণীর/ প্রাপ্য যে যার অংশ/ রুখিয়া দাঁড়াও ভাইরে/ জীবনের গান গাইরে/ প্রাণ ধারণের প্রাপ্য রাসদ/ চাইরে মোদের চাই/ বিপ্লব ছাড়া জীবন জাগার কোনো উপায় নাই/ দাও তবে প্রতিঘাত/ হাতেতে মিলাও হাত/ দাও হুঙ্কার, টুটাবোই মোরা/ দুঃস্বপ্নের রাত।’
সিলেট শহরতলীতে ঠিকানা থাকলেও কবি দিলওয়ার আলোচিত ও সমাদৃত ছিলেন রাজধানী ঢাকা ও কলকাতার শীর্ষ কবিদের মধ্যে। ১৯৮০ সালে কবি দিলওয়ার কাব্য চর্চায় বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা একাডেমী ফেলোশীপ লাভ করেন ১৯৮১ সালে। ২০০৮ সালে সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে একুশে পদক প্রদান করা হয়। তিনি একাধারে কবি, ছড়াকার, সাংবাদিক, নাট্যকার ও গীতিকার ছিলেন। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে তার কবিতা প্রেরণা সঞ্চার করেছে।
দিলওয়ার গণমানুষকে হদয়ে কতটা জায়গা দিয়েছিলেন তার প্রমান মিলে বিভিন্ন কবিতায়। ‘আয়রে চাষী মজুর কুলি মেথর কুমার কামার/ বাংলা ভাষা ডাক দিয়েছে বাংলা তোমার-আমার।’ অথবা ‘বহু লাঞ্ছনা, বহু অপমান/ সহিয়াছে যারা মুখ করি ম্লান/ জয় হবে সেই নিপীড়িতদের/ জালিমেরা শির নোয়াবে/ এইবারে রাত পোহাবে।‘
কবি দিলওয়ারের কণ্ঠে জাগরনীর সুর ছিল। নিজ সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যে তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন। বেদনাক্লিষ্ট মানুষকে জাগ্রত করে কবি বলেন-‘পৃথিবীতে এসে কেঁদে যায় যারা বেদনার গেয়ে গান/ হতাশার কালো নয়নে মাখিয়া তপ্ত নিশ্বাস ফেলে/ নত করি শির চরণে নিজের দুঃখের পসরা ঠেলে/ মহাজীবনের ললাটে আঁকিয়া তলোয়ার খরশান/ তাদের বিফল জীবনের লাগি, বলো ঠিক দায়ী কারা/ বিধি না জনক? শাক্ত না ধনী? কোথায় জবাব তার/ লুকালো কোথায় উত্তরদাতা, সে কোন অন্ধাকার?/ নিবিড় আবেগে কাঁপিছে আমার দুইটি আঁখির তারা!’
‘গণমানুষের কবি’ বললে তার নাম বলতে হয়না। ১৯৭৭ সালের ৭ মার্চ সিলেটে কবি দিলওয়ারকে দেয়া নাগরিক সংবর্ধনার মানপত্রে ‘গণমানুষের কবি’ অভিধায় অভিষিক্ত করা হয়। এরপর তিনি আজীবন বরণীয় হয়েছেন এই নামেই।
শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের প্রতি কবির ভালোবাসার অন্ত নেই। শিশুর মত তার সরল কবি মন কোমলমতি মানুষদের টানে। ছোট বেলায় কবির কথা মনে হলে শান্ত সকালে সুরমা পারের সূর্যোদয় অবলোকন করে করে অনাবিল আনন্দে ছুটে যেতাম। মনে মনে আবৃতি করতাম তার ‘কীনব্রীজে সূর্যোদয়’। ‘এখন প্রশান্ত ভোর। ঝিরঝিরে শীতল বাতাস/ রাত্রির ঘুমের ক্লান্তি মন থেকে ঝেড়ে মুছে নিয়ে/ আমাকে সজীব করে। উর্ধ্বে ব্যাপ্ত সুনীল আকাশ/ পাঠায় দূরের ডাক নীড়াশ্রয়ী পাখীকে দুলিয়ে।/ নীচে জল কলকল বেগবতী নদী সুরমার,/ কান পেতে শুনি সেই অপরূপ তটিনীর ভাষা/ গতিবন্ত প্রাণ যার জীবনের সেই শ্রেয় আশা/ সৃষ্টির পলিতে সেই বীজ বোনে অক্ষয় প্রজ্ঞার।/ সহসা ফিরিয়ে চোখ দিয়ে দেখি দূর পূবাকাশে/ তরুণ রক্তের মতো জাগে লাল সাহসী অরুণ/ পাখীর কাকলি জাগে। ঝিরঝিরে শীতল বাতাসে/ দিনের যাত্রার শুরু। অন্তরালে রজনী কুরণ!/ ধারালো বর্শার মতো স্বর্ণময় সূর্যরশ্মি ফলা/ কীন ব্রীজে আঘাত হানে। শুরু হয় জনতার চলা।’
সিলেটে বৃটিশ ঐতিহ্যের নিদর্শন এই ব্রীজ। পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ পায়ে হাঁটার সেতু। বড় বড় লোহার কাঠামোয় অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। ১৯৩৩ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়। চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় ১৯৩৬ সালে। তৎকালীন আসাম প্রদেশের গভর্নর মাইকেল কীনের নামে এই সেতুর নামকরণ হয় কীনব্রীজ। ১১৫০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৮ ফুট প্রস্থ ব্রীজ দিয়ে হাটার সময় বড় মনোরম দেখায়। নদীর কাব্যময় ঢেউ বয়ে চলে অবিরাম। বুকের মধ্যে ছল ছল করে ঢেউ ছলকায়। কখন পৌছে যাই কবি মন্জিল। ভার্থখলা, খান মন্জিল।
খান মন্জিল আমার খালার বাড়ি। মুসলিম খান আমার খালু। তিনি কবি দিলওয়ারের বড় ভাই। বিশিষ্ট ছড়াকার কাদের নওয়াজ খান ও ছড়াকার বদরুল আলম খান আমার খালাত ভাই। কবিপুত্র কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, শাহীন ইবনে দিলওয়ার, কামরান ইবনে দিলওয়ার এবং তাদের ভাই-ভাতিজাসহ অনেকে লেখেন। মান সম্পন্ন লেখ। তবে আমার কাছে মূলত তিনিই প্রধান আকর্ষণ। মনের গভীরে থাকে সুরমা পারের কবি, আমাদের প্রিয় দিলু মাম।
সমকালীন বাংলা সাহিত্যের জননন্দিত লেখক কবি দিলওয়ার আমাদের সাহিত্যে দৃঢ়তা ও শক্তিময়তার অভাব অবলীলায় পূরণ করেছেন। তার কবিতা স্বাধীনতা, মানবতা এবং সুবিচার প্রত্যাশায় তীক্ষ্ণ, তীর্য ও উজ্জ্বল। তার কল্পনায় ধর্মীয় উদারতা ও সাম্যবাদ আবার কখনো নৈরাজ্য স্পর্শ করেছে। তবে ভালোবাসা সর্বত্র প্রাধান্য পেয়েছে।
‘সে’ কবিতায় কবি দিলওয়ার বলেন- ‘ভারি মজার মজার কতো কথাই-না সে বলতো/ সে বলতো হাত দুটি নেড়ে নেড়ে, সহাস্যে, সোল্লাসে/ ছাই ছাপা আগুনের মত সেই ক্ষণে সে জ্বলতো/ আমি বুঝতাম বৈকি। আমি বুঝতাম অনায়াসে।/ … তার সেই ক‘টি কথা এই মনে এখনো সরব/ হিটলারের মুন্ডু হাতে আমি যেন মার্শাল জুকভ।’
কবির মুখে কত শত পংক্তিমালা শুনেছি, আজো কানে বাজে। সমাজ বিকাশের চেতনাকে কেন্দ্র করে সৃজিত অবিস্মরণীয় পংক্তিমালা। যে কবিতা সূর্যের মতো সর্বত্রই রশ্মি ছড়ায়। ‘যতোদিন বেঁচে আছো ততোদিন মুক্ত হয়ে বাঁচো/ আকাশ-মাটির কন্ঠে শুনি যেনো তুমি বেঁচে আছো।’ অথবা ‘মৃত্যুর মিছিলে তুমি জীবনের দীপ্ত তরবারী/ একথা নতুন করে তোমাকে জানাতে হবে নাকি?/ এ-কথারি ঢেউ নিয়ে কখন ছেড়েছে নীড় পাখী/ উন্মুক্ত আকাশ তলে তোমারি বন্দনা শুনি, নারী…সে কথা ভুলোনা তুমি। ভুলো না পাথর চাপা ঘাসে/ তোমারি সৌহার্দে, নারী, ঈশ্বর শিশুর মতো হাসে।
‘তুমি রহমতের নদীয়া, দোয়া করো মোরে হযরত শাহজালাল আউলিয়া’ এসব গান ও কবিতা সিলেটের জনমনে এখনো ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। সিলেট বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়েছিলো কবি দিলওয়ারের এই গানটি দিয়ে। প্রায় পাঁচ দশক ধরে সিলেটের অসংখ্য শিল্পী তার লেখা গান গেয়ে আসছেন। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে তার লেখনী নিসৃত হয়েছে। করিব কন্ঠে কতবার শুনেছি- ‘আমিতো কাঠুরে নই, আমি তো চাইনে কেটে নিতে/ ফুলের ফলের উৎস: গাছের সবুজ বাহুগুলি/ চুলোর নারকী ক্ষুধা নেই তো ইচ্ছের চারিভিতে/ নির্বিকার বহ্নিমান পোড়াতে বাসনা শতমূলী।/ আমার একান্ত সুখ বৃক্ষের আদিম সমতায়/ যে-পাখীরা নীড়ভ্রষ্ট, আসুক উল্লাসে তারা ফিরে/ সবুজ সুঠাম যতো বাহুর সহিষ্ণু মমতায়/ শূন্যের বিপুল আর্তি ফিরুক শূন্যের বুক চিরে!/ আমার কুঠার যেই, রইবে সে ক্রোধে চিরকাল/ শ্বাপদসংকুল যতো গহন অরণ্যপানে খাড়া/ অশান্ত কাঁপিয়ে যাবে জীঘাংসু রাত্রির শিরদাঁড়া/ কুঠারের তীক্ষ্ণ ধারে বহমান অনন্ত সকাল!/ ফুলের গন্ধের নদী ফলের নৌকোর খোলে হাল/ বৃক্ষের বাহুতে বসে পাখিরা সংগীতে তোলে তাল।
‘শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন’ কবিতায় শ্রেণী বিভক্তির বিরুদ্ধে কবির দৃপ্ত উচ্চরণ- ‘শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন যদি অপরাধ হয়/ আমরা কি আজো দিতে পারলাম/ মানুষের পরিচয়?/ ডুবে আছি আজো খন্ডে খন্ডে সাম্প্রদায়িক পাঁকে/ দম্ভদূষিত নাগপাশে বেঁধে/ মানুষের বিধাতাকে।/ প্রতিদিন ভোরে ও-কার সূর্য মর্মরক্তে ভিজে/ আমাদের ঘরে আলো দিয়ে যায়/ বিগলিত হয়ে নিজে?/ ও-কার বাতাস প্রতি নিশ্বাসে বিশ্বজনীন হয়?
শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন/ এ তো ভুলবার নয়।/ শুধু মুখে নয় বুকেও ক্ষরিত সাম্প্রদায়িক বিষ/ অঘ্রাণে তাই ব্যথারক্তিম ঐশী ধানের শিষ!/ কতকাল ধরে, বলতে পারি না/ আত্মহনন কাজে/ ব্যস্ত রয়েছি আমরা সবাই। প্রভাত মথিত সাঁঝে।/ কেটে গেল কত পিতামহ আর/ প্রপিতামহের কাল/ বোধির গোড়ায় সার হলো কত বিভেদের জঞ্জাল।
শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন/ চিরাচরিতের পথে/ জীবন কখনো চলতে পারে না- নদীর জীবন স্রোতে!/ ঔরসজাত মানবতা চাই/ কালের শুদ্ধসুধা/ রক্তে আমার এই তো ধর্ম/ এই তো মাতৃক্ষুধা।
‘বলে রাখি শোনো, করো নাকো হৈ চৈ/ যতদিন আছে শ্রেণী বিভক্ত জাতি/ আমি কিছুতেই তোমাদের দলে নই।’
নিপীড়িত জনতার সাহসের বাতিঘর গণ মানুষের কবি দিলওয়ার বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিলেন সদা সোচ্চার। তার ভাষায়- ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি: পদ্মা তোমার যৌবন চাই/ যমুনা তোমার প্রেম/ সুরমা তোমার কাজল বুকের পলিতে গলিত হেম।/ পদ্মা যমুনা সুরমা মেঘনা/ গঙ্গা কর্ণফুলী/ তোমাদের বুকে আমি নিরবধি/ গণমানবের তুলি!/ কত বিচিত্র জীবনের রং/ চারদিকে করে খেলা/ মুগ্ধ মরণ বাঁকে বাঁকে ঘুরে/ কাটায় মারণ বেলা!/ রেখেছি আমার প্রাণ স্বপ্নকে/ বঙ্গোপসাগরেই/ ভয়াল ঘূর্ণি সে আমার ক্রোধ/ উপমা যে তার নাই!/ এই ক্রোধ জ্বলে আমার স্বজন/ গণমানবের বুকে/ যখন বোঝাই প্রাণের জাহাজ/ নরদানবের মুখে!/ পদ্মা সুরমা মেঘনা…/ অশেষ নদী ও ঢেউ/ রক্তে আমার অনাদি অস্থি,/ বিদেশে জানে না কেউ!’
কবির সত্যিকারের সহযাত্রী আনিসা দিলওয়ার আছেন তার সৃষ্টিশীলতার বড় একটা অংশ জুড়ে। ‘গোটা বিশ্ব আজ প্রিয়তমা’ কবিতায় তিনি বলেন- ‘প্রিয়তমা এসো তুমি যৌথকণ্ঠে শেষ বার বলি/ আমরা বহন করি অলৌকিক মানবতা বোধ/ তাকে রোজ স্নাত করে অতলের জলীয় আমোদ/ তার স্বাদ পেতে চায় আদিম প্রাণের কথাকলি/ উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখি রোদ হাতে নাজিম হিকমত/ ম্যাক্সিম গোর্কির রাত আজো কিনা হয়নি নিঃশেষ/ জননীর কণ্ঠে শুনি বাঁধভাঙ্গা কঠোর আদেশ/ ধ্বংসকে দেখিয়ে দাও সৃজনের ধ্র“পদী হিম্মত/ প্রিয়তমা, মনে রেখো পৃথিবীর সূর্যপ্রদক্ষিণ/ অগত্যা বিশ্রাম নেই আকাঙ্খিত আলোর সফরে/ অনাগত সন্তানেরা রক্তস্রোতে বিচরণ করে/ পশু মানুষের হাতে নয় তারা কখনো অধীন/ প্রিয়তমা তুমি নও, গোটা বিশ্ব আজ প্রিয়তমা/ তার জন্য অনিবার্য বৈপ্লবিক প্রেম-পরিক্রমা।’
ষাটের দশকে দক্ষিণ স্বাধীনতাকামী নেলসন মানদেলা যখন জেলে বন্দি, তখন দিলওয়ার তাকে নিয়ে লিখেন-
‘নেলসন মানদেলা: একটি আগ্নেয় স্মরণ।’ কবি বিশ্বমানবতার পক্ষে কলম ধরেন ‘আনিসা শুনতে পাও, ‘উহুরু’ ‘উহুরু’ সেই ডাক?/ অগ্নিগোলকের মতো কৃতঘ্ন আঁধার ভেদ করে/ সে-ডাক ছুটন্ত দ্যাখো। রৌদ্র নৃত্য কালের অধরে!/ কৃষ্ণ সাগরের স্রোতে শ্বেতদৈত্য আতংকে নির্বাক/ এবং শুনতে পাও খাচাভাঙ্গা সিংহের গর্জন?/ শানিত থাবায় তার জন্মগত মুক্তির সনদ/ সে হাঁকে অকুতোভয়ে: করবে কে আয় গতিরোধ/ দেখি কার শক্তি কতো। আমি আজ অরাতি দমন/ সেই বজ্রনাদ শুনে, চেয়ে দ্যাখো, ধবল প্যান্থার/ শ্বেতাঙ্গ অসুরবৃন্দ জ্বরার্ত শিশুর মতো কাঁপে/ বিপুলিপ্ত নিকটবর্তী। শাখায় ঝুলন্ত স্বৈরাচার/ অতল তিমির গর্ভে সূর্যকান্ত মণির মতোন/ আফ্রিকা ক্রমশঃ দীপ্ত কন্ঠে কোটি পল রোবসন’।
কেবলমাত্র নেলসন মানদেলা নিয়েই নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেক বিষয় নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন। যেখানে কবিতায় সর্বাগ্রে স্থান পেয়েছে সাম্য, মৈত্রী ও মানবতার অমীয় বানী।
কবি দিলওয়ারের প্রথম কবিতা ‘সাইফুল্লাহ হে নজরুল’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে সাপ্তাহিক যুগভেরীতে। ১৯৫৩ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জিজ্ঞাসা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সালে বের হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ঐকতান’। এরপর কবি একে একে লিখেন পুবাল হাওয়া (গানের বই, ১৯৬৫), উদ্ভিন্ন উল্লাস (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৬৯), বাংলা তোমার আমার (গানের বই, ১৯৭২), ফেসিং দি মিউজিক (ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ, ১৯৭৫), স্বনিষ্ঠ সনেট (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৭৭), রক্তে আমর অনাদি অস্থি (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৮১), বাংলাদেশ জন্ম না নিলে (গ্রবন্ধগ্রন্থ, ১৯৮৫), নির্বাচিত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৮৭), দিলওয়ারের শত ছড়া (ছড়ার বই, ১৯৮৯), দিলওয়ারের একুশের কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৯৩), দিলওয়ারের স্বাধীনতার কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৯৩), ছাড়ায় অ আ ক খ (ছড়ার বই, ১৯৯৪), দিলওয়ারের রচনাসমগ্র ১ম খণ্ড (১৯৯৯), দিলওয়ার-এর রচনা সমগ্র ২য় খণ্ড (২০০০), ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর ডাকে (ভ্রমণ, ২০০১), দুই মেরু, দুই ডানা (কাব্যগ্রন্থ ২০০৯)৷
সাহসী শব্দ সৈনিক কবি দিলওয়ারের ‘চলমান শব্দাবলী’র মতো কলামগুলো দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। তার গল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘সাদা কালো বিড়াল’ এবং ‘ইলিশ মাছের কাঁটা’। মঞ্চ নাটক হচ্ছে ‘আসল মুক্তিযুদ্ধ এবং রুধিরাক্ত কাল’।
ইংরেজি রচনা ও অনুবাদেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন কবি দিলওয়ার। অনুবাদ করেছেন মার্কিন কবি নরমান, কোরীয় লেখক মোগউ, জার্মান কবি কাল ক্রালাউ, রুশ কবি আইওন, ইতালিয়ান কথা সাহিত্যিক মোরাকিয়ান সহ বিখ্যাত লেখকদের বই।
কবি ক্লান্তিহীন উদ্যম, দুর্বার উদ্দীপনায় ছিলেন গতিশীল ও প্রত্যাশাময়ী। আমার ‘ছায়াপ্রিয়া’ উপন্যাস সম্পর্কে গণমানুষের কবি দিলওয়ার লিখেন- ‘বোধশক্তি অর্জনের পর থেকেই মানুষ যে তিনটি অমূল্য উপকরণকে পাথেয় করে নানাভাবে নিজের প্রকাশ ঘটাতে থাকে সেই ত্রয়ী হচ্ছে মন, স্মৃতি ও চিন্তাশক্তি। মানুষের আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের জগতে যে সব বিস্ময় স্তরে স্তরে বিন্যস্ত রয়েছে, তাদের একটি হচ্ছে সাহিত্য। বাংলা ভাষার হাজার বছরের ইতিহাসে কবিতার স্থান সর্বোচ্চ হলেও উপন্যাসের শুরু প্রায় দেড়শ বছর থেকে। সমালোচকেরা এক্ষেত্রে প্রথম উপন্যাস হিসেবে গণ্য করেন যে গ্রন্থটিকে তার নাম “আলালের ঘরের দুলাল”। অতি অল্প সময়কালের মধ্যে বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের ধারাটি বিস্ময়কর উন্নতি সাধন করে। আমার এই অতীত স্মৃতি চারণের মূলে একজন তরুণের লেখা একটি উপন্যাস ‘ছায়াপ্রিয়া’।
একান্ত স্নেহাস্পদ উপন্যাসিক সাঈদ চৌধুরী তার প্রথম গ্রন্থটি নিয়ে পাঠক সমাজে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছেন। এই উৎসাহ ব্যঞ্জক প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে যে, সাঈদ চৌধুরী তার লেখায় পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থার মানসিক সুখ-দুঃখকে অনেকটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। নিঃসন্দেহে এটি এক প্রাচুর্যময় সম্ভাবনার ঝলকানি। পরিমিত কলেবরের উপন্যাসটিতে লেখক ভাবনা একাত্ব হয়ে আছে। কেন জানি মনে পড়ে যায় আমার প্রথম যৌবনে পঠিত একটি বিদেশী উপন্যাসের কথা। সেই উপন্যাস রচয়িতার বাড়ি ছিল নরওয়ের এক গ্রামাঞ্চলে। তিনি হলেন বিশ্ব বিখ্যাত ন্যুট হামসুন। উপন্যাসের নাম হাংগার। যদিও বিষয় বস্তুর তুলনায় সাঈদ চৌধুরী ও হামসুনের মধ্যে ব্যবধান বিপুল। তা সত্ত্বেও আত্মপ্রকাশের প্রশ্নে দু’জনের মধ্যে কোথাও যেন একটি মিল রয়েছে।
আমি খুবই আনন্দিত যে, ‘ছায়াপ্রিয়া’ উপন্যাসটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আমি আশা করবো সাঈদ চৌধুরী পাঠকদের পক্ষ থেকে গ্রহণযোগ্যতার যে সম্মান অর্জন করেছেন, আগামীতে আরো সতর্কতা ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে নতুন নতুন সাহিত্যকর্ম উপহার দিয়ে তার অভীষ্ট লক্ষ্য পথে এগিয়ে যাবেন। প্রসঙ্গতঃ আমরা অবশ্যই স্মরণ করবো যে, প্রতিটি উন্নত দেশ তার অস্তিত্বে ধারণ করে আছে নিজ নিজ সাহিত্য-সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। আমি লেখকের ফলপ্রসূ দীর্ঘায়ু কামনা করি। -দিলওয়ার, ভার্থখলা, সিলেট।’
কবি দিলওয়ার ১ জানুয়ারি ১৯৩৭ সালে সিলেট শহরের দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলাস্থ পৈতৃক নিবাস খান মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভী হাসান খান এবং মাতা মোছাম্মৎ রহিমুন্নেসা। পুরো নাম দিলওয়ার খান। যদিও তিনি পারিবারিক ‘খান’ পদবি কখনো ব্যবহার করেননি। রক্ষণশীল পারিবারিক ঐতিহ্য ভেঙে কবি দিলওয়ার সাধারণ মানুষের সাথে মিশে গিয়েছিলেন। সকল চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে কবি দিলওয়ারের চেতনায় ছিল শুধুই দেশপ্রেম। মানুষকে ভালোবেসে তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন।
‘আমার মৃত্যুর পর’ শীর্ষক লেখা কবিতায় কবি দিলওয়ার বলেছেন ‘আমার মৃত্যুর পরে যদি তুমি/ কখনো খুঁজতে যাও এই মর্মভূমি/ মনে রেখো তবে/ বাংলার হৃদয় নিয়ে কেটেছে/ আমার দিন/ প্রতীচ্যের মুক্তির গৌরবে।’
২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর বার্ধক্যজনিত কারণে ইহকাল ত্যাগ করেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এই কবি। যার ভালোবাসা ছিল কর্ম চঞ্চল মানুষের সাথে। জনতার বহমান কর্মধারার সঙ্গেও। তিনি একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা-ব্যক্তিত্ব। ঐশ্বর্যময় কবি। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি মানবতার মুক্তিকন্ঠ, গণমানুষের কবি দিলওয়ারকে।
লেখক: সময় সম্পাদক। কবি ও কথাসাহিত্যিক।