চলছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের কারণে গত ০২ মার্চ (বুধবার) ভোরে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ নামে জাহাজটি ২৯ জন নাবিকসহ ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের জলসীমায় আটকা থাকা অবস্থায় রকেট হামলার শিকার হয়। এই হামলায় জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. হাদিসুর রহমানের (৩৩) নিহত হন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’র ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন বীমাকারীর কাছ থেকে ২২.৪ মিলিয়ন ডলার দাবি করেছে। ইউক্রেন সংকটে এটাই প্রথম দাবি করা বড় অংকের সামুদ্রিক বীমা।’
গত সপ্তাহে জাতিসংঘের শিপিং এজেন্সি কৃষ্ণ সাগর এবং আজভ সাগরে আটকে থাকা বাণিজ্যিক জাহাজ এবং ক্রুদের জন্য নিরাপদ করিডোর খোলার ঘোষণা দিয়েছিলো। তবে শিপিং ইন্ডাস্ট্রি ধারণা করছে এই অগ্রগতি কিছুটা ধীরগতিতে হবে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এই অঞ্চলে ভ্রমণের জন্য বীমা প্রিমিয়াম বেড়েছে ১০০ শতাংশেরও বেশি। বীমাকারীরাও এসব দাবি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে খরচ আরো বৃদ্ধি পাবে।
জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইউক্রেন দাবি করছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে বন্দর স্থাপনায় আঘাত হানছে। তবে রাশিয়া তা অস্বীকার করেছে। ঢাকার রাশিয়ান দূতাবাস বলছে ঘটনার পরিস্থিতি কেবল প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
বিএসসির একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঘটনার পর জাহাজটির মালিক বিএসসি জাহাজটি পরিত্যাগ করে তাদের বীমাকারীর কাছে দাবি উত্থাপন করেছে।সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, যুদ্ধ সংক্রান্ত ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য বীমা করা হয়েছিলো ঢাকা ভিত্তিক ‘সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের’ মাধ্যমে। সেটা আবার লন্ডন ব্রোকার টাইজারের লয়েডের মাধ্যমে পুনঃবীমা করা হয়েছে। সাধারণ বীমার এক্সপোজার ছিল ১০ শতাংশ এবং টাইজার বাকি ৯০ শতাংশ পূরণ করেছে।
সেখানে থাকা এক কর্মকর্তার বরাতে রয়টার্স জানায়, জাহাজটি সিরামিক তৈরিতে ব্যবহৃত অন্যতম কাঁচামাল কাদামাটি নিয়ে ইতালি যাওয়ার কথা ছিল। সৌভাগ্যক্রমে যখন জাহাজটি অলভিয়া বন্দরে পৌঁছায় তখন সেখানে কোনো পণ্যবাহী জাহাজ ছিল না।
বীমার ব্যাপারে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর সুমন মাহমুদ সাব্বির আলাদাভাবে রয়টার্সকে বলেছেন, দাবিটি প্রক্রিয়া করতে সময় লাগবে। যুদ্ধকবলিত অঞ্চল থেকে জাহাজ না সরানো পর্যন্ত বীমা প্রতিষ্ঠান সেখানে তাদের লোক পাঠাতে পারেনা ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে জরিপ করার জন্য। তবে আমরা আমাদের সুবিধার দিক থেকে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
বীমা কর্পোরেশনের সূত্রের মাধ্যমে জানা যায়, লন্ডনের সামুদ্রিক বীমা বাজারের ক্ষেত্রটি আরো বাড়ানো হয়েছে। সংঘর্ষের তীব্রতা আর বাণিজ্যিক শিপিং বৃদ্ধির কারণে বীমার বাজারে এ অঞ্চল উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়। কাগজে কলমে দাবিটা সরল হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে তা প্রক্রিয়াকরণে সময় লাগতে পারে। বিশেষ করে যদি আরো ডকুমেন্টস সংগ্রহের দরকার হয়।
ইউক্রেনের মেরিটাইম অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ডেপুটি হেড ভিক্টর ভিশনভ রয়টার্সকে বলেছেন, জাহাজটি বন্দরে নোঙর করে ছিল যার মধ্যে কোনো ক্রু ছিল না। বাকি ২৮ জন ক্রু সদস্যকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বন্দরের ক্যাপ্টেন জাহাজে আসার জন্য কিছু ক্রু খুঁজছিলেন।
ভিশনভ নিশ্চিত করেছেন, ক্ষেপণাস্ত্রটি আঘাত করার সময় জাহাজের সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যদিও ইঞ্জিনটি নিষ্ক্রিয় ছিল কিনা তা স্পষ্ট নয়।
জাহাজের জন্য সাধারণত P&I বীমা করা থাকে যা তৃতীয়পক্ষ যেমন পরিবেশগত ক্ষতি এবং বাহ্যিকভাবে কোনো আঘাতপ্রাপ্ত হয় তবে তারা ক্ষতিপূরণ দিতে দায়বদ্ধ থাকবে। যুদ্ধ সংক্রান্ত ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি ছাড়াও আলাদাভাবে জাহাজের কাঠামো এবং যন্ত্রপাতি সম্পর্কিত বীমা নীতি বাহ্যিক ক্ষতির বিরুদ্ধে জাহাজগুলিকে ক্ষতিপূরণ দেয়।
সর্বশেষ গত বছরের জুলাই মাসে জাপানের মালিকানাধীন তেল পণ্যের ট্যাঙ্কার মার্সার স্ট্রিট ওমানের কাছে সন্দেহভাজন ড্রোন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেখানে দুইজন ক্রু সদস্য নিহতও হয়েছিলো।
বীমাকারী অ্যালিয়ানজ গ্লোবাল কর্পোরেটের ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ১০০ টনের বেশি ওজনের ১০টির কম জাহাজ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
রয়টার্স সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি আরো চারটি জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে, যার মধ্যে একটি ইতোমধ্যেই ডুবে গেছে।