বারোমাসি ফুল ঝোলানো বারান্দা। সবুজের স্পর্শ ছড়ানো এক ফালি গাছ। দেয়ালে সাদা প্লাস্টার প্রলেপের উপর সূক্ষ্ম কারুকাজ। জানালাগুলো ধূসর রঙে ঢাকা। চলচ্চিত্রের পর্দায় ঐতিহাসিক ঘটনার স্বারক হিসেবে ব্যবহৃত বাড়ির আদলে তৈরী ‘আলোক ঝরনাধারা’। পশ্চিম লন্ডনের অভিজাত এলাকা লিন্স্টার গার্ডেনের মতো। হাইড পার্ক থেকে সামনে এগোলে, বে’স ওয়াটার ও কুইন্স ওয়ে টিউব স্টেশন থেকে অদূরে লিন্স্টার গার্ডেন।
সাত রঙের মেলবন্ধনে আলোক ঝরনাধারা সবার নজর কাড়ে। জলপ্রপাতের সামনে দাড়ালে যেমনটি দেখা যায়। পাথর-শ্যাওলা-জলজ উদ্ভিদ এবং লাল, নীল, সাদা, হলুদ, সবুজ, কমলা ও গোলাপী রঙ্গের অসাধারণ সমারোহ। এক কথায় লিকুইড রেনবো বলা যেতে পারে।
নতুনত্বের ছোঁয়ায় ইনডোর প্লান্ট। ডেকোরেটিভ ওয়াল-আর্ট দিয়ে সাজানো অন্দরমহল। ড্রয়িং রুমের এক কর্ণারে কাঁচের জারের মধ্যে জলজ গাছ। ব্যালকনিতে আমব্রেলা পাম, ওয়ান্ডারিং জু, একুয়াটিক, মানি প্লান্ট, ওয়াটার লেমন গ্রাস এবং বিভিন্ন ধরনের শালুক। বেডরুমে একটি ল্যাভেন্ডার গাছ। ল্যাভেন্ডারের মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠে ঘরের প্রতিটি কোণ, তরতাজা হয়ে উঠে মন এবং শরীর।
এই সুন্দর ও মনোগ্রাহী আয়োজনের মূল কান্ডারী হান্নানার শরীরটা এখন আর ভালো নেই। উন্নত চিকিৎসায় বিফল হয়ে দেশজ ওষুদের দারস্থ হয়েছেন। পলাশ স্ত্রীকে নিয়ে লন্ডন ছেড়ে অনেক আগে চলে গেছেন দেশের বাড়িতে।
হান্নানা ভাবলেন, তার পরিণতি ঘনিয়ে আসছে। বড় ছেলেকে বিছানার পাশে ডেকে বললেন, প্রিয় বৎস আমি শীঘ্রই চলে যাব। তুমি পলাশের সেবা যত্ন করবে। আর আমার হানিফার প্রতি সর্বদা খেয়াল রাখবে। আশির্বাদ করি, প্রভু তোমার মঙ্গল করুন।
মুখ গুঁজে থাকা অশ্রুসিক্ত হানিফা মাথাটা মায়ের বুকে ঘষতে থাকে! মা যদি সত্যি চলে যান, তাহলে পরিবারের হাল ধরবে কে? এনিয়ে ভাবনায় পড়ে যায় আলাল। মাত্র কলেজে পা দিয়েছে সে। পারিবারিক দায়িত্ব বুঝে নেয়ার বয়স তার হয়নি। ঘরের টুকিটাকি কিছু করতেও অভ্যস্ত নয়। নিজের বিছানা গোছানোর কাজটি এখনো কাজের বুয়া করে দেয়।
হান্নানার শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে প্রতিবেশীরা ধনকুবের পলাশকে আরেকটি বিয়ের পরামর্শ দিতে থাকে। কথাটা পাড়ায় চাউর হয়ে যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত খবরটায় ব্যথাতুর হয়ে ওঠেন হান্নানা। জীবনের সবকিছু ওলট-পালট মনে হয়। মৃত্যুর আগেই মরতে ইচ্ছে করে!
দীর্ঘকালের গুছিয়ে নেয়া জীবন মুহূর্তের মধ্যে কেমন অগোছালো হয়ে গেল। পরিস্থিতি সামলে নেয়ার জন্য ছেলেকে বিয়ে দেবার চিন্তা করেন। ঘর সামলাবার অজুহাত থেকে স্বামীকে বারণ করার এটাই একমাত্র উপায়। নেতিবাচক পরিস্থিতি সামলে নেয়ার চিরায়ত অভ্যাস হান্নানার মনে কিছুটা স্বস্তি এনে দেয়।
সিলেট শহরের প্রান্ত সীমায় তারা থাকেন। এ পাড়ায় অসংখ্য বানরের বসবাস। চাষনী পীরের মাজারের টিলায় বংশ পরস্পরায় বাস করে আসছে এই বানরগুলো। জিয়ারতে আসা মুসল্লিদের দেয়া খাবার খেয়ে টিলার নিরাপদ গাছ-গাছালিতে আশ্রয় নেয়।
হান্নানা মনস্কামনা পূরণের জন্য মাজারে বানরদের জন্য খাবার পাঠাতে চান। বিষয়টি আলালের মোটেও পছন্ন নয়। পশুপাখির প্রতি তার গভীর অনুরাগ সত্ত্বেও মনস্কামনার কুসংস্কার ভাবনায় সে বিরক্ত হয়। কিন্তু অসুস্থ মাকে তা বলতে চায়নি। আনমনে মাজারের দিকে যাত্রা করে।
গোয়াইপাড়া পথের মুখের দোকানে বানরের খাবার বিক্রি হয়। কিছু বাদাম ও বিস্কিট কিনে নেয় আলাল। দূর থেকে বানরগুলো যেন তাকে লক্ষ্য করছিল। খাবারগুলো সামনে ছিটিয়ে দিলে তারা এসে লাফিয়ে লাফিয়ে আনন্দের সঙ্গে খেলো। একটি বানর আলালের মাথার কেপ নিয়ে চম্পট দেয়। অতিরিক্ত খাবার পেয়ে আবার ফিরিয়ে দেয়। দূর থেকে একজন ছবি তুলে ছিল। ফেইসবুকে দিয়ে দিয়েছে।
আলালের হাতে বানরের প্রসাদ খাওয়ার দৃশ্যটি সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে যায়। সামিয়া জানতে চায় প্রসাদ বিতরণের মতলব কি? আলাল শুধু হাসে, কোন উত্তর দেয়নি।
বিকেলে মায়ের অবস্থার অবনতি হয়। হাসপাতালে নেয়ার পথেই মারা যান তিনি। প্রিয় ছোট মেয়েটি মায়ের প্রেমময় যত্নের জন্য কাঁদতে থাকে। হানিফার বান্ধবি সামিয়া আসে বাবা-মা‘র সাথে। শোকাতুর পরিবারের প্রতি সকলে সমবেদনা জানায়।
মায়ের মৃত্যু শোকে ক‘দিন আর কোথাও বেরুয়নি আলাল। নীরবেই মাসখানেক কেটে গেল। বসন্তের প্রথম দিনে সামিয়ার টেলিফোনে ঘর থেকে বেরিয়েছে। আগের বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ১৩ তারিখে ফাল্গুন মাসের প্রথম দিন ছিল। আর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ভালোবাসা দিবস, ভ্যালেন্টাইন্স ডে।
এবার দুটি দিবসই একই দিনে পালিত হচ্ছে। ভালোবাসা দিবসে বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে মানুষ মেতে উঠেছে বসন্তের ফুল এবং গানে। সামিয়ার পোশাকের ভিন্নতা নজরে পড়ে আলালের। তারা যখন ফুলের ঘরে ঢুকে, তখন দোকান মালিক টেলিফোনে কার সাথে কথা বলছিল। ফাল্গুনের দিন এক লাখ আর ভালোবাসা দিবসে দেড় লাখ। নুন্যতম আড়াই লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয় প্রতি বছর। এবার একদিনে দুটি উৎসব হওয়ায় অর্ধেক ব্যবসা হবেনা।
আলাল বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে নেয়। সামিয়ার কাছে আস্তে করে সামাধান চায়। নিজের পক্ষ থেকে আরেকটি ফুল কিনে আলালকে উপহার দেয় সামিয়া। প্রাণময় হালকা হাসি দিয়ে বলে, আমাদের দু‘জনার হাতে ফুল, আর তাদের ব্যবসা ডাবল!
সামিয়ার বড় ভাই মেজর আফসর হানিফাকে ভেতরে ভেতরে ভালবাসে। মিষ্টি মুখের ছোট্ট মেয়েটিকে দেখতে গেলে আফসর সামিয়াকে সাথে নিয়ে যায়। তাদের মায়ের কুলখানিতে আসার পর উভয় পরিবারই সেটা অনুভব করেছে। হানিফা তাদের যথেষ্ট আতিথেয়তা দেখিয়েছে। ঝলমলে নীল চোখ আর চকচকে রঙিন মুখ, হালকা জামাকাপড় সত্ত্বেও বুনো গোলাপ ফুলের মতো লেগেছে।
গেলদিন মেজর আফসরের কাছ থেকে মিষ্টি সুগন্ধযুক্ত কার্ড এসেছিল। তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ। সব মহিলা আত্মীয় স্বজন জড়ো হয়েছিলেন। এক পরিবারের শিশুদের সাথে সৎ মা ছিলেন। বেচারির চেহারা খুব সুন্দর। কিন্তু কেমন কুৎসিত অন্তর। পোশাকে রঙ্গের বাহার, নাটকের সঙ সাজার দৃশ্য!
ছোট্ট মেয়ের জুতোটি খুলে গেছে। ফিতা ঠিক করতে গিয়ে হানিফা সহায়তা করেছিল। কিন্তু মা বেজায় ক্ষেপে গেলেন মেয়েটির উপর। খুব রাগ এসেছিল হানিফার। অনুষ্ঠানে ব্যাঘাত না ঘটানোর জন্য চটপট নিজেকে সামলে নেয়। তবে সৎ মা বিষয়ে তার চলমান ধারণা আরো প্রকট হয়ে ওঠে। ছোট্ট মেয়েটির উত্তপ্ত অশ্রুগুলি তাকে আচ্ছন্ন করে। হৃদয়টা ভেঙে যায়!
সবচেয়ে অদ্ভুত, অনেক মহিলা এদিক-ওদিক দাঁড়িয়ে ছিলেন। কেউ কিছু বলেনি। ছোট্ট মেয়েটি যেন খুব অসহায়, নিরুপায়। হানিফা মেয়েটিকে কুলে নিয়েছিল। সে তখন ফুপিয়ে কাঁদলো। মনে হল অনেক দিন পর একটু আদর পেয়েছে।
আফসর অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্বে হানিফাকে কাছে টানছিল। অনুষ্ঠান এতটাই মনমুগ্ধকর ছিল, প্রতিটি পর্বে তারা প্রশংসা কুড়িয়েছে। ছেলে বুড়ো সবাই তাকে বেশ ভাল পেয়েছে। এত সুন্দর এপ্রোচ ওবাড়িতে আগে কখনও দেখেনি।
স্ত্রীর ইন্তেকালে ধনকুবের পলাশ নতুন বিয়ে করে ফেলতে পারেন। সন্তানদের এমন ধারণাই দিয়েছেন হান্নানা। আফসরের বাবা-মা বিষয়টি জেনে গেছেন। ফলে তারাও আলালের বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকেন। আলাল ও আফসরকে ঘিরে সামিয়া ও হানিফা আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
পলাশ তার বড় বোনকে নিয়ে ছেলে-মেয়ের সাথে কথা বলেন। হান্নানার অনুপস্থিতির অনেক স্মৃতিচারণ! আলালের জন্য বিয়ের চিন্তা করছেন বলেও জানান। তাদের পছন্দের কিছু থাকলে সেভাবে এগুতে চান। বাবার হৃদ্যতাপূর্ণ কথামালায় বিস্মিত হয় ছেলে-মেয়ে। নিজেদের ভেতরের ভুল ধারণার জন্য লজ্জাবোধ হয়। অনুতপ্ত হৃদয়ের মৌনতায় কিছুই বলতে পারেনি।
হানিফা মেজর আফসরের বোনের কথা প্রস্তাব করে। ফুফু তখন উজ্জ্বল চোখে ঝলকিয়ে উঠছিলেন, আনন্দের হাসিতে। বাবাও কোন প্রশ্ন ব্যতিরেখে সম্মতি প্রকাশ করেন। আলালের মুখে প্রাণবন্ত হাসি খেলে যায়। রংধনুর রঙের ছটায় সুদর্শন পরীর মত হাসে হানিফা, জড়িয়ে ধরে বাবাকে।
• সাঈদ চৌধুরী কবি ও কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক: দৈনিক সময়, মানব টিভি