অমর ও বিরল বিচারপতি আব্দুর রউফ ।। ব্যারিষ্টার হামিদ আজাদ

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

“মহান আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি, মহান আল্লাহর কাছেই ফিরে যেতে হবে”। স্রষ্টা নির্ধারিত সে নিয়মেই সর্বজন শ্রদ্বেয় বিচারপতি আব্দুর রউফ সাহেব তাঁর রব্বের সান্নিধ্যে চলে গেছেন। এক বর্ণাঢ‍্য জীবনের অধিকারী এ মহান ব‍্যক্তি জাতির জন‍্য যা করেছেন তা অতুলনীয়। সকল মাপে তিনি আপন গুনে সেরা ছিলেন। আজকের বাংলাদেশে তার মত দেশ প্রেমিক ও চৌকষ যোগ‍্যতার অধিকারী কান্ডারীর বড় প্রয়োজন। তাঁর মৃত্যু একটি বড় শূণ‍্যতার সৃষ্টি করল। তিনি নীরবে তাঁর প্রিয় প্রভুর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে চলে গেছেন। তিনি আর আসবেননা। তবে জাতির এ ক্রান্তি লগ্নে আরো বিচারপতি আবদুর রউফের বড় প্রয়োজন।

বিচারপতি আব্দুর রঊফ ছিলেন একজন আদর্শ বিচারপতি। বিচার কাজে তাঁর সততা, বলিষ্ঠতা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতা তাঁকে বিচারাঙ্গনে সম্মান ও মর্যাদার শীর্ষ আসনে আসীন করেছিল। তিনি প্রমান করেছেন সম্মান জবরদস্তি করে আদায় করা যায়না। কেবল কর্ম ও চরিত্র মানুষকে অভাবনীয় মর্যাদার মুকুট পরিয়ে দিতে পারে।

দায়িত্ব পালনে জবাবদিহিতার অনুভূতি ও দক্ষতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ পেশ করে বিচারপতি আব্দুর রউফ পেশাদারিত্বের জগতে উজ্বল নক্ষত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন কিন্তু নীতির প্রশ্নে আপোষ করেননি। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সত‍্য কথা বলার সাহস দেখিযে যারা ইতিহাস রচনা করেছেন, বিচারপতি আব্দুর রউফ ছিলেন তাদেরই একজন।

দেশ প্রেম একটি জনপ্রিয় শ্লোগান। কিন্তু খুব কম লোকই দেশ প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে। বিচারপতি আব্দুর রউফ ছিলে সেই বিরল মানুষদের একজন, যিনি দেশ প্রেমের পরীক্ষায় বার বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। কোন লোভ, লালসা, হুমকি তাঁকে এ পরীক্ষায় পরাভূত করতে পারেনি। যে কোন জাতির উন্নতি ও স্থিতিশীলতার জন‍্য সে জাতির জনসাধারনের দেশ প্রেমই হচ্ছে নিয়ামক শক্তি। দুর্ভাগ্যবশতঃ বাংলাদেশে সত‍্যিকারের দেশপ্রেমিকের অভাব দীর্ঘদিনের। বিচারপতি আব্দুর রউফের বিদায় সে অভাবকে আরো তীব্র করল।

পদ-পদবী ও জশ খ‍্যাতিতে যারা শীর্ষে উঠেন তাঁদের মাঝে কিছুটা হলেও অহংবোধ কাজ করে। কিন্তু বিচারপতি আব্দুর রউফ ছিলেন সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তাঁর মহানুভবতা, বিনয় এবং উদারতা ছিল আকাশ-চুম্বী। তিনি ছিলেন সত‍্যিকারের “ইবাদুর রাহমান”। উস্তাদ আবদুর রউফের সাথে বেশ কয়েকবার স্টেইজ শেয়ার করার বা একই প্লাটফর্মে কথা বলার বা বক্তব‍্য রাখার সুযোগ হয়েছ। বয়সে আমি ওনার অনেক ছোট, সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে ওনার পায়ের কাছে যাওয়ার যোগ‍্যতাও আমার নেই। তবুও তিনি আমার মত একজন নগন‍্য আল্লাহর গোলামের প্রতি যে মাপের সম্মান ও মর্যাদা দেখাতেন তা দেখে আমি একদিকে বিব্রত বোধ করতাম, অপরদিকে প্রতিবারই তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্বা ও ভালবাসা হাজার গুন বেড়ে যেত। তিনি ছিলেন একজন উঁচু মাপের আল্লাহর বান্দাহ এবং বিনয়ের জগতে এক রোল মডেল।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দক্ষতা, বলিষ্ঠতা, পেশাদারিত্ব এবং নিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে বিচারপতি আব্দুর রউফ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে তা সম্ভবতঃ এখনও একমাত্র উদাহরন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত নির্বাচনই সম্ভবতঃ বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র নির্বান যার নিরপেক্ষতা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেনি। জাতি এ ধরনের একজন সৎ, দক্ষ, নির্মোহ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনারের জন‍্য আজো হন‍্যে হয়ে ঘুরছে।

পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার ক্ষেত্রে তিনি যেমন শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন, কোরোআন-হাদীস সহ ইসলামী জ্ঞানের ক্ষেত্রেও তিনি সমভাবে পান্ডিত‍্য অর্জন করেছিলেন। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর জ্ঞানগর্ব আলোচনা যে কোন মানুষকেই বিমোহিত করত। কথা ও আমলের মিল তাঁর চরিত্রকে চুম্বকীয় চরিত্রে রুপান্তরিত করেছিল। ফলে তাঁর সান্নিধ‍্যে যারা এসেছেন তাঁরা সুন্দর জীবনের নবদিগন্ত উন্মোচিত করতে সক্ষম হয়েছেন।

পেশাগত জীবনে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন তাঁকে দ্বীন বা ধর্মীয় অনুশাসন পালনে মুহূর্তের জন‍্যও গাফেল করেনি। শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি যথাসময়ে নামাজ আদায়-সহ আল্লাহর হুকুম পালনে সদা সতর্ক ও যত্নশীল ছিলেন। তিনি নিজেকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিতে শত চ‍্যালেন্জের মাঝেও কখনও কুন্ঠাবোধ করেননি। তিনি তাদেরই একজন যারা পেশার জগতে সেরা হয়েও দ্বীনের জগতে কোন আপোষ না করে “উত্তম” খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।

“তার কথার চেয়ে কার কথা উত্তম হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহ্‌র পথে ডাকে, সৎ কর্ম করে, আর অকপটে ঘোষনা করে আমি মুসলমান” – আল-কোরআন। বিচারপতি আব্দুর রউফ কোরআনের আয়নায় বিম্বিত সে উত্তম মানুষদেরই একজন ছিলেন।

“এমন জীবন তুমি করিবে গঠন/মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন”। বিচারপতি আব্দুর রউফ আমাদের জন‍্য এমন একটি আদর্শ জীবন উপহার দিয়েই তাঁর রব্বের সান্নিধ‍্যে চলে গেলেন। মহান প্রভূ তাঁর সকল নেক আমলগুলুকে কবুল করুন এবং জান্নাতে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে আসীন করুন। আমীন।

* ব্যারিস্টার হামিদ হোসাইন আজাদ এমসিএ’র কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট, খ্যাতিমান আইনজীবী ও মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *