অনাহারে রাখা আসলে যুদ্ধাপরাধ, কিন্তু বিচার হবে কি?

মধ্যপ্রাচ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

কঙ্কালসার নবজাতক ধুঁকতে ধুঁকতে মারা যাচ্ছে মায়ের কোলে৷ গাজা ভূখণ্ড থেকে সম্প্রতি এই দৃশ্য ছড়িয়ে পড়তেই তীব্র সমালোচনায় মুখরিত সারা বিশ্ব৷ বিশেষ করে, ২০২৪ সালের নভেম্বরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং প্রাক্তন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে জারি করা আইসিসির পরোয়ানা, যেখানে বিশেষভাবে অনাহারকে যুদ্ধাপরাধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷

যুদ্ধে শুধু গুলি, ক্ষেপণাস্ত্র, বিস্ফোরক নয়, নিপুণভাবে তৈরি করা পরিকল্পিত অনাহার, দুর্ভিক্ষও এক বিরাট অস্ত্র! আর তার ‘হাতে গরম উদাহরণ’, সুদান থেকে শুরু করে গাজা ভূখণ্ড পর্যন্ত৷ মানবাধিকারের এই চূড়ান্ত লঙ্ঘনে বিশ্বজুড়ে ক্রমশ বাড়ছে প্রতিবাদ৷

‘‘পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ বর্তমানে যুদ্ধ ও গণহত্যার একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷ এটি মানবিক আইনবিরোধী৷” অ্যামেরিকার গণহত্যা প্রতিরোধ সংগঠন ‘প্রিভেন্টিং অ্যান্ড এন্ডিং মাস অ্যাট্রোসিটিস’-এর প্রবীণ উপদেষ্টা শায়না লুইস স্পষ্ট জানালেন ডিডাব্লিউকে৷

সুদানের এল ফাশার শহরের কথা বলছিলেন শায়না৷ গত এক বছর ধরে অবরুদ্ধ এই শহর, ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে শহরের খাবারের ভাণ্ডার৷ বিপর্যস্ত প্রায় ৩০ হাজার বাসিন্দা৷ জাতিসংঘের খাদ্য অধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত মাইকেল ফাখরি ব্রিটেনের সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘‘ইসরায়েল গাজাকে অনাহারে রাখছে৷ এটি একটি যুদ্ধাপরাধ৷” প্রায় একই সুরে গাজা ভূখণ্ডের কথা তুলে ধরেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-সহ মানবাধিকার সংগঠনগুলি৷
গাজায় মানবিক বিপর্যয়, অনাহারে মারা যাচ্ছে শিশুরা

অনাহার হয়ে উঠছে পছন্দসই ‘যুদ্ধাস্ত্র’

ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের গবেষকদের দাবি, এই শতকের প্রথম দিকে কিন্তু এত দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর দেখা যায়নি৷ কিন্তু ক্রমশ সেই চিত্র বদলাচ্ছে, বাড়ছে সংঘাত, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অনাহার৷ নেদারল্যান্ডসের আইন সংস্থা গ্লোবাল রাইটস কমপ্লায়েন্স-এর অনাহার সংক্রান্ত প্রকল্পের আইনি উপদেষ্টা রেবেকা বাকোস ব্লুমেনথালের মতে, যুদ্ধে অনাহারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের নিষ্ঠুরতা শতাধিক বছরের প্রাচীন৷ তবে, ২০১৫ সাল থেকে নতুন করে সেটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে৷

গত দশকে নাইজিরিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান, সুদান, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে এই জাতীয় মন্বন্তর দেখা দিয়েছে৷ খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এই তালিকায় রেখেছেন রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার ঘটনাও৷ অ্যামেরিকার টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের প্রধান গবেষক অ্যালেক্স ডি ওয়ালের কথায়, ‘‘সারা বিশ্বের খাদ্যসুরক্ষা বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে কিন্তু যুদ্ধজাত দুর্ভিক্ষও বাড়ছে৷”

ডি ওয়াল আরো বলেন, যুদ্ধের সময় অনাহার দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে৷ এবং ‘যুদ্ধাপরাধী দেশ’ প্রথম থেকেই যে অনাহার ঘটানোর পরিকল্পনা করে থাকতে পারে, তা-ও মিথ্যা নয়৷ তার কথায়, হামলাকারী জানে যে, সংঘাতের স্বাভাবিক ধারায় দুর্ভিক্ষ ঘটবে, তাদের সেটি প্রতিরোধ করার সুযোগও রয়েছে৷ কিন্তু তারা তা কিছুতেই প্রতিরোধ করবে না৷

পরিকল্পিত অনাহার যুদ্ধাপরাধ, মানছে বিশ্ব

ব্লুমেনথাল ব্যাখ্যা করেন, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত, অনাহারকে প্রায়শই একটি উন্নয়ন সংক্রান্ত মানবিক সমস্যা হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু এখন এর অপরাধমূলক দিকগুলিতে আরো বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।

২০১৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে ২৪১৭ নম্বর প্রস্তাব পাস করে৷ তাতে যুদ্ধের ফলে ঘটানো ইচ্ছাকৃত অনাহারের তীব্র নিন্দা করা হয়৷

২০১৯ সালে রোম স্ট্যাটুট-এ পরিবর্তন এনে অনাহারকে যুদ্ধাপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে৷ ব্লুমেনথালের কথায়, দক্ষিণ সুদান এবং ইথিওপিয়া-টিগ্রেতে সংঘাতে জাতিসংঘের তদন্ত কমিশনও বিশেষভাবে অনাহারকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে। তিনি বলেন, ‘‘বর্তমানে বহু আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংগঠনগুলি অনাহারকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করছে এবং প্রতিবাদের ডাক দিচ্ছে৷ বিশেষ করে, গাজা ভূখণ্ডের ঘটনা আরো চোখে আঙুল দিয়ে বিষয়টি তুলে ধরছে৷”

এই প্রথম অনাহারকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক পরোয়ানা জারি হয়েছে৷ সুদানে তদন্ত চালাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট৷

বিশেষ করে, ২০২৪ সালের নভেম্বরে ইসরায়েলের রাষ্ট্রপতি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং প্রাক্তন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে জারি করা আইসিসির পরোয়ানা, যেখানে বিশেষভাবে অনাহারকে যুদ্ধাপরাধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷ বিষয়টিকে একটি ‘ঐতিহাসিক মাইলফলক’ মনে করেন ব্লুমেনথাল৷
অনাহার যারা ঘটায়, উপযুক্ত শাস্তি হবে তাদের?

‘‘বিষয়টি জটিল, কিন্তু আমি মনে করি, এমন বহু ঘটনা রয়েছে, যেখানে অপরাধ প্রমাণ করে শাস্তি দেওয়া সম্ভব৷ স্রেফ তাদের আদালতে তুলতে হবে৷” ডিডাবলিউকে জানালেন ডি ওয়াল৷

ব্লুমেনথালও এ বিষয়ে একমত৷ তিনি বলেন, ‘‘অনেকে মনে করেন, যুদ্ধ হলে তো দুর্ভিক্ষ অনিবার্য৷ কিন্তু তদন্তে দেখা গিয়েছে, অনেক সময়েই এই অনাহার মনুষ্যসৃষ্ট, ইচ্ছাকৃত৷” তবে তিনি আশাবাদী, ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষকে খেতে না দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় যারা, তারা একদিন ঠিক বিচারের মুখোমুখি হবে৷ ক্যাথরিন শায়ের/এসটি ডিডাব্লিউ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *