হিজাব কি শুধুমাত্র ফ্যাশনে সীমাবদ্ধ নাকি এটি ফরজ বিধান

ফিচার লাইফ স্টাইল সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

শান্তির ধর্ম বলা হয় ইসলামকে। কিন্তু কেন? কারণ, ইসলামে মানবজীবনে যা কিছু কল্যাণকর তার সকল বিষয়ে বলা আছে। জীবন চলার পথে কি করা যাবে আর কি করা যাবে না তার সকল কিছু সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ইসলামে। এবং বিষয়গুলো বৈজ্ঞানিকভাব প্রমানিত।

আল্লাহ তায়ালা নারী জাতিকে সুন্দররূপে সৃষ্টি করেছেন। আর দুনিয়ার যাবতিয় সকল সুন্দরকে রাখতে হয় সযতনে।

এই যেমন আপনার একটি সুন্দর দামি ঘড়ি আছে, একটি দামি গাড়ি আছে, স্বর্ণের গহনা বা হীরের নেকলেস আছে কিংবা দামি একটি মোবাইল ফোন আছে। আপনি কি সেটিকে সবসময় অরক্ষিত উপায়ে রাখবেন? উন্মুক্তস্থানে রাখবেন? যদি না রাখেন তবে তা কেন? কারণ, সুন্দর বা দামি বস্তুটি চুরি বা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

তেমনি নারীরা যেহেতু সুন্দর সেহেতু আল্লাহ তায়লার বিধান হচ্ছে, নারীরা সবসময় পর্দা করবে, নিজেকে আড়াল করে রাখার জন্য হিজাব পরবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে।’ (সূরা : নূর, আয়াত : ৩১)

কোরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত পোশাককে হিজাব বলে। পর্দার আরবি শব্দ হচ্ছে হিজাব। এর শাব্দিক অর্থ প্রতিহত করা, বাধা দান করা, গোপন করা, আড়াল করা, ঢেকে রাখা ইত্যাদি।

ইসলামে পর্দা প্রথার মূল উদ্দেশ্যে সৌন্দর্য প্রকাশ করা নয়, বরং সৌন্দর্য গোপন করা। ইসলাম আগমনের পূর্বে নারীসমাজ পৌঁছে গিয়েছিল এমন এক অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য আর অবহেলার ঘোর অমানিশায়, যেখানে তাদের গণ্য করা হতো বাজারের পণ্য হিসেবে।

নারীসমাজের ওপর বয়ে চলা এমনই এক কৃষ্ণকালো সর্বগ্রাসী দুর্দশার সাতকাহন থেকে মুক্তি দিয়ে ইসলাম তাদের স্থান দিয়েছে মর্যাদার সর্বোচ্চ আসনে।

পঞ্চম হিজরি মোতাবেক ৬২৭ হিজরি থেকে মুসলিম নারীদের জন্য তাদের ইজ্জত-সম্মান আর নিজস্ব স্বকীয়তা রক্ষার মৌলিক হাতিয়ার হিজাব বা পর্দার বিধান কার্যকর করা হয়েছে। আর তখন থেকেই আমাদের কন্যা-জায়া আর জননীরা একে অত্যাবশ্যকীয় বিধান জ্ঞান করে তা পালন করে আসছেন, আলহামদুলিল্লাহ!

কিন্তু ভাবার বিষয় হচ্ছে, কালের বিবর্তনে আমার মা-বোনদের পালন করা পর্দাপদ্ধতিতে যে ধরনের পরিবর্তন ও নবায়ন, রূপায়ণ ঘটেছে আর সৃজনশীলতার নামে সৌন্দর্যবর্ধনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তা ইসলামি শরীয়তের মানদণ্ডে কতটুকু গ্রহণযোগ্য?

বর্তমানে যেই চোখ ঝলসানোনোনা ধরণের হিজাব আর বোরকা আমরা দেখছি, একটু ভেবে দেখুনতো তা কি ইসলামি শরীয়তের রূপরেখা মেনে শরীয়তের কাম্য পন্থায় হচ্ছে?

আজকাল অনেকে চোখ ধাঁধানো সরু আর আঁটসাঁট বোরকা পরিধান করছে। হরেক রকম বুটিকের আকর্ষণীয় স্কার্ফ মাথায় জড়িয়ে হিজাব ব্যবহার করছে। বাহারি ডিজাইন করা লেহেঙ্গাসদৃশ বোরকার সঙ্গে ফিনফিনে স্কার্ফ বাঁধছে, বোরকা পরিধান করার পরও জনসমক্ষে উন্মুক্ত বাহুদ্বয় আর অনাবৃত পদযুগল দেখিয়ে চলছে।

বাহারি অলংকার আর গয়নায় শোভিত করে উন্মুক্ত পরিবেশে নিজেকে নিমন্ত্রণমূলক পদবিক্ষেপে পরিণত করছে। সুরভিত ঘ্রাণ, সুউচ্চ হিল আর অনুরণিত শব্দতরঙ্গে নরমনে কড়া নাড়ছে। চেহারার সৌন্দর্য আর মনোমুগ্ধকর বর্ণের সুদীপ্ত আভা প্রদর্শন করছে।এসবের দ্বারা কি আদৌ ইসলাম ঘোষিত মাতৃজাতির রক্ষাকবচ পর্দার শরয়ী মানদণ্ড পূরণ হচ্ছে? না, একেবারেই না। এসবের দ্বারা হিজাবের শরয়ী চাহিদা মোটেও পূরণ হচ্ছে না। কারণ হিজাব কোনো ফ্যাশনের উপকরণ কিংবা সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যম নয়। হিজাব একটি অবশ্য পালনীয় বিধান, যা মহান আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মদির প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নারীর ওপর ফরজ করেছেন। এর প্রবর্তক স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা।

কাজেই আমরা এতে কোনো পরিবর্তন-পরিবর্ধন করতে পারি না। পারি না কোনো বিকল্প পন্থার উদ্ভাবন করতে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহ ও রাসূল (সা.) কোনো নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন নর-নারীর জন্য নিজেদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না।’ (সূরা : আহজাব, আয়াত : ৩৬)

ইসলামী শরীয়তের মানদণ্ডে হিজাব:
হিজাব একটি ফরজ বিধান। একটি ইবাদত। নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় শরয়ী হাতিয়ার। এটিকে পালন করার জন্য রয়েছে সুনির্ধারিত পদ্ধতি। মনের চাহিদা আর আত্মপূজার পোশাক হিজাব হতে পারে না। হিজাব হতে হবে এমন, যা সারা শরীরকে এমনভাবে ঢেকে রাখতে সক্ষম, যেন শরীরে কোনো ভাঁজ বোঝা না যায়। সেই সঙ্গে হাত-মুখও অবশ্যই ঢেকে রাখতে হবে।

পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে,
وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاء بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاء بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُوْلِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَى عَوْرَاتِ النِّسَاء وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

‘ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা : নূর, আয়াত : ৩১)

এ আয়াতে ‘খুমুর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা খিমারের বহুবচন। আর খিমার ওই কাপড়কে বলা হয়, যা নারীরা মাথায় ব্যবহার করে এবং তা দ্বারা মুখ, গলা ও বক্ষ পানিভরা কূপের মতো আবৃত হয়ে যায়। সুতরাং মুখ, গলা আবৃত করার নির্দেশের দ্বারা চেহারা আবৃত করার নির্দেশ প্রমাণিত হয়। কারণ নারীর মুখমণ্ডল তার যাবতীয় রূপ ও সৃষ্টিগত সৌন্দর্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। কেউ যখন বিয়ের জন্য পাত্রী দেখে তখন মুখই দেখে। কাজেই মুখ কী করে পরপুরুষের সামনে উন্মুক্ত রাখা যেতে পারে?

হিজাব হতে হবে এমন, যেন তা নিজেই কোনো ধরনের সৌন্দর্যবর্ধক না হয়। সেটি যেন এত আকর্ষণীয় না হয় যে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর মুমিন নারীদেরকে বলে দিন যেন তারা তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে…আর যা সাধারণত প্রকাশ পায়, তা ছাড়া তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না।’ (সূরা : নূর, আয়াত : ৩১)

কাজেই নিজেই সৌন্দর্যবর্ধন করে আকর্ষণ সৃষ্টি করবে এমন পোশাক পরিধান করা ও জনসমক্ষে তা দেখানো বৈধ হতে পারে না। কারণ হিজাব তো সেটি, যা বেগানা পুরুষের সামনে সৌন্দর্য প্রকাশে অন্তরায় সৃষ্টি করে। অতএব, বোরকা বা হিজাব পরিধান করেও যারা নিজেদের পোশাকি ঝলক প্রকাশে অস্থির, তারা কী ভেবে দেখবে সে কেমন পর্দা করে চলেছে?

বিশ্ব নবী রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘…এক দল নারী এমন, যারা পোশাক পরিধান করেও উলঙ্গ থাকে। তারা অন্যদের নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করবে, নিজেরাও অন্যদের প্রতি ঝুঁকবে। তাদের মাথা উঠের পিঠের কুঁজের মতো হবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এমনকি জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।’ (মুসলিম, হাদিস : ২১২৮)

অতএব, হে মুসলিম মা-বোন, আপিন সাবধান হোন! আপনার পোশাক যেন আপনার জান্নাত থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ না হয়। আপনার হিজাবি পোশাক যেন সংকুচিত ও অন্তর শোভা পরিদৃশ্যকারী না হয়। দেহের প্রলুব্ধকর অঙ্গের প্রস্ফুটন না ঘটায়।

হিজাব হতে হবে এমন, যেন তা পুরুষ্য পোশাকের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ না হয়। কোনো ভিন্নধর্মাবলম্বীর পোশাকের মতো করে তৈরি না হয়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসূল (সা.) সেসব পুরুষকে অভিসম্পাত করেছেন, যারা নারীদের পোশাক পরিধান করে আর সেই নারীদের অভিসম্পাত করেছেন, যারা পুরুষদের পোশাক পরিধান করে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪০৯৮)

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসূল (সা.) আমার গায়ে জাফরান ব্যবহৃত কাপড় দেখে বললেন, এসব হলো কাফিরদের পোশাক, তুমি তা পরিধান কোরো না।’ (মুসলিম, হাদিস : ৫৫৫৫)

হিজাব হতে হবে এমন, যেন তা ব্যক্তিগত অহংকারবোধ ও প্রসিদ্ধি লাভের উদ্দেশ্যে পরিধান করা না হয়। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রসিদ্ধি লাভের পোশাক পরিধান করবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন। অতঃপর সে কাপড় তাকে প্রজ্বলিত করবে।’ (ইবন মাজাহ, হাদিস : ৩৬০৭) পোশাকের এই শর্ত নারী-পুরুষ সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

হে মুসলিম মা-বোন! আপনার হিজাব যেন সৌন্দর্য বিকাশ কিংবা তরুণদের রিপু সুড়সুড়ি দেওয়ার উপাদানে সজ্জিত না হয়। আপনার হিজাব যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) অসন্তুষ্টির কারণ না হয়। আপনি হিজাব পরিধান করুন সেভাবে, যেভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন। তাহলেই পালন হবে পর্দার ফরজ বিধান। মিলবে পরকালীন মুক্তি আর চিরকাম্য জান্নাত।

তাই, হিজাবকে ফ্যাশন হিসেবে নয়, পর্দা হিসেবে ব্যবহার করুন। আপনার মেয়ে সন্তানকে ছোটবেলা হতেই হিজাব পরানোর অভ্যেস করুন। হিজাব বা পর্দার গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত করুন। দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভ করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *