সুন্দরবনে বাঘের মুখোমুখি । ফরিদী নুমান

পর্যটন ফিচার ভ্রমণ-স্মৃতিকথা সময় সাহিত্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সুন্দরবনে বাঘের ছবি তোলা বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোচিত্রীদের কাছে স্বপ্ন। ২০২২ সালের ৩১ মার্চ আমার সে স্বপ্ন প্রথমবারের মতো পূরণ হয়েছে। সাবাই জানেন এবং বুঝতে পারেন, সুন্দরবনে বাঘের ছবি তোলা জীবনের ঝুঁকি নেয়া একটি চ্যালেঞ্জিং জব। বাঘের ছবি তুলতে গিয়ে আমার যে উপলব্ধি হয়েছে আজ সেটা বলতে চাচ্ছি।

প্রথমেই বলে নেই, আমার মতে বাঘের ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা-লেন্সের পাশাপাশি শরীর-মন এবং সাহসের জোরও থাকতে হয়। তবে সুপ্রসন্ন ভাগ্যও থাকতে হয়। আমি ২০০৪ সালে প্রথমবার সুন্দরবন গিয়েছিলাম। এরপর কোনো কোনো বছর ৮-১০ বারও গিয়েছি। সুন্দরবনের সুলভ-দুর্লভ নানারকম পাখি, নানারকম সাপ, হরিণ, কুমীর, ভোদড়, ডলফিনের ছবি তুলেছি। প্রতিবারই আশা করতাম যদি বেঙ্গল টাইগার বা বাংলা বাঘের ছবি তুলতে পারতাম। এজন্য সুন্দরবনগামী লঞ্চের সামনে বসে থেকে সারাক্ষণ বনের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ ক্লান্ত হয়ে গেছে। তবুও ভাবতাম হয়তো গোলপাতা, সুন্দরী কিংবা কেওড়া বনের ফাঁকে বনের রাজাকে দেখা যাবে। যতদূর জেনেছি বেঙ্গল টাইগার আমাদেরকে ঠিকই দেখে, আমরা তাকে দেখতে পাই না। আমরা যতই ভাবি বাংলা বাঘ খুব হিংস্র প্রাণী, কিন্তু বাস্তবতা হলো হিংস্রতা তার স্বভাবজাত হলেও, বাঘ খুব লাজুক প্রাণী। আড়ালে-আবডালে বসে তার রাজত্বে কে আসা-যাওয়া করে সে তার দেখভাল ঠিকই করে। কাউকে বিপজ্জনক মনে করলেই শুধুমাত্র তার উপর হামলা করে।

সুন্দরবনে বাঘের ছবি তোলার জন্য যখনই ‘বাঘ দেখা গেছে’ এমন তথ্য পেয়েছি, সাথে সাথেই খুব দ্রুততার সাথে সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছি, খুঁজেছি অনেকবার। একবার মোংলার এক ট্যুর অপারেটর এমন তথ্য জানোলো যে, জামতলা টাওয়ার থেকে একজন বিদেশী পর্যটক সাইবার শট ক্যামেরা দিয়ে ছবি এবং ভিডিও করেছে। পরেরদিনই স্বল্প প্রস্তুতি নিয়ে আমরা মোংলা চলে গেলাম। এবং তারপর টানা দুইদিন জামতলা টাওয়ার, খাল এবং সন্নিহিত বনে বাঘের অপেক্ষায় বসে থাকলাম। কিন্তু কোথায় বাঘ? আমরা যেসব এলাকায় তাকে খুঁজে ফিরছি একটু পরেই সেসব এলাকাতেই তার নতুন টাটকা পায়ের ছাপ দেখছিলাম। তারমানে বাঘ আমাদের সাথে ঠিকই লুকোচুরি খেলছিলো।আরেকবার আমার দীর্ঘদিনের নিয়মিত সফরসঙ্গী ইমদাদুল ইসলাম বিটু ভাই আর আমি কটকার টাইগার টিলার কাছে বাঘের গর্জন শুনতে পেয়ে সেদিকে যাচ্ছিলাম, যদি মামাকে দেখা যায়। কিন্তু পেছন ফিরে দেখি আমাদের সঙ্গী-সাথীদের কেউই কাছে নাই, যে যার মতো ভেগে গেছে, আর আমাদের দায়িত্বে থাকা ফরেস্ট গার্ড দূর থেকে চেচামেচি করছে আমাদের জন্য। আমার আরেক সফরসঙ্গী মুগনিউর রহমান মনি’র উদ্যোগে শেরপুরের একটা গ্রুপকে নিয়ে সুন্দরবন গিয়েছিলাম একবার। সুন্দরবনে পক্ষীর খালে বোট-ট্রীপের সময় একটা নীলকান মাছরাঙাকে দেখলাম কিন্তু গ্রুপের সদস্যরা এতোবেশি দুষ্টুমি করছিলো যে মাছরাঙাটির দেখা পাওয়াই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিলো। শেষে বিরক্ত হয়ে গ্রুপের সবাইকে নাস্তা করোনো উছিলায় লঞ্চে নামিয়ে দিয়ে আমি আর মণি ফের পক্ষীর খালে ঢুকছিলাম। আমাদের নৌকার মাঝি গাউস ভাই বললো, স্যার খালের ডানপাশের দিকে তাকান। তাকিয়ে দেখলাম খালের মুখেই বাঘের তরতাজা পায়ের ছাপ। অর্থাৎ আমাদের গ্রুপটিকে নৌকা থেকে লঞ্চে উঠানোর ৪-৫ মিনিটের মধ্যেই বাঘটি খাল পার হয়ে অন্যপাড়ে গিয়েছে। যদি আমরা পেছন ফিরে তাকাতাম, হয়তো বাঘটিকে দেখতেও পেতাম। সম্ভবত বাঘটি খালের পাশের জঙ্গলে আমাদের নৌকার পাশাপাশিই ছিলো

এবছর মার্চ মাসের শুরুতে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের ড. নিয়াজ ভাই সুন্দরবনে একসাথে ৪টি বাঘের দেখা পাওয়ার ঘটনার পুরনো ইচ্ছেটি আবার মাথার ব্রহ্মতালুতে বার বার হাতুড়ি মারছিলো। আমরা তখন চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে হাজারিখিলে কাঠময়ূর খুঁজে বেড়াচ্ছি। ক’দিন পর আবার খবর এলো বনবিভাগের মফিজুর রহমান চৌধুরী ভাই সুন্দরবনে টহল দিতে গিয়ে আবার একসাথে ৩টি বাঘের দেখা পেয়েছেন।

করোনা পেন্ডামিকের কারণে গত দু’বছর সুন্দরবন খুব কম যাওয়া হচ্ছে। তাছাড়া পকেটের নিত্য টানাটানিতে সুন্দরবন যাওয়ার আগ্রহ থাকলেও সাহস পাচ্ছিলাম না। মার্চের ২২ কিংবা ২৩ তারিখের দিকে আমাদের টিমের আদনান সম্রাট সুন্দরবনে প্রোগ্রাম নেয়ার জন্য খুব পীড়াপিড়ি শুরু করলো। আমি বরাবরের মতো আমার অসুস্থ পকেটের কথা বললাম তাকে। সে নিজে থেকে বললো- আপনার সুন্দরবন ট্রিপের স্পন্সর আমি। আর এতেই আমি রাজি হয়ে গেলাম। এরপর আমি সুন্দরবন প্রোগ্রাম আয়োজন শুরু করি।

মোংলার ফেমাস ট্যুরস বিডি-ভ্রমণ বাংলা’র কর্ণধার তানজির এইচ রুবেল বছর দুই আগে গাংচিল লঞ্চটি কিনেছে। এই লঞ্চ কেনার পর থেকেই তার সাথে সুন্দরবনে যাওয়ার জন্য মাঝে-মধ্যেই বলে আসছিলো। রুবেলের সাথে কথা বললাম। তাদের একটি নিয়মিত ট্রিপ ছিলো যেটা ৩০ মার্চ সুন্দরবনে যাবে। ৪দিনের ট্রিপে ২ এপ্রিল সুন্দরবন থেকে ফিরবে। যেহেতু ২ এপ্রিল পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়ে যেতে পারে সেজন্য একদিন এগিয়ে ট্রিপটিকে ২৯ মার্চ থেকে করতে প্রস্তাব দিলে রুবেল সেটা মেনে নিলেন। এরপর সবাইকে সুন্দরবনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বললাম।

আমাদের এবারের দলে ৭জন ছিলাম যারা অনেকদিন ধরেই ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি করি। আমি, আমাদের কিসমত ভাই, এমদাদুল ইসলাম বিটু ভাই, আদনান আজাদ, আদনান হোসেন সম্রাট, ফরিদপুর থেকে জয়েন করেন ডা. সাইফুল আলম, শেরপুর থেকে মুগনিউর রহমান মণি। এছাড়া হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থেকে জয়েন করেছিলেন মোমিনুল হক এবং দেওয়ান ফরহাদ। মোমিন ভাই আগে একবার সুন্দরবন এলেও ফরহাদ ভাই জীবনে এবারই প্রথম সুন্দরবনে এসেছেন।

মার্চের ২৯ তারিখ সূর্য ওঠার আগেই মোংলা থেকে নির্ধারিত লঞ্চ গাংচিলে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে এমাসে বেশ কয়েকটি স্থানে বাঘ দেখা গিয়েছিলো সেসব স্থান দিয়ে খুব ধীর গতিতে বা কখনো থেমে থেমে আমরা বাঘ খুঁজতে থাকি, কিন্তু কোথাও বাঘের টিকিটির দেখা পেলাম না। দ্বিতীয় দিনও ঠিক এভাবেই পার হলো। দুইদিনে কয়েকটি পাখি, ভোদড়, হরিণ ছাড়া আমাদের ক্যামেরায় আর কিছু পেলাম না।।

তৃতীয় দিন সূর্য ওঠার সাথে সাথে একটি সিন্ধু-ঈগল আমাদেরকে স্বাগত জানালো। আমাদের খুব কাছে খানিক ওড়াউড়ি করে ক্যামেরার সাটার গরম করলো। এরপর জামতলা খালে ঢুকে একে এক তিনটে গোখরা সাপ ছাড়াও রামগুই, ঝুটিয়াল শিকরে ঈগল, সুন্দরবনের অতি পরিচিত খয়রাপাখ মাছরাঙা, কালাটুপি মাছরাঙা, ছোট সাহেলি সহ আরো কিছু পাখি বা প্রাণীর সাথে দেখা হলো। জামতলা জেটি-তে নেমে বনের মধ্যে বেশখানিক পথে বেঙ্গল টাইগারের খোঁজ করলাম।

চৈত্র মাসের শরীর পোড়ানো গরম, মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্য আর পায়ের নিচে তপ্ত মাটি- সবমিলে সবার অবস্থা কাহিল। খুব ভোরে বেরোনোর কারণে কারো নাস্তাও হয়নি, সাথে থাকা পানির বোতলগুলোও খালি হয়ে গেছে। জামতলা হেঁটে তেমন কিছু না পেলেও উপমহাদেশের দুর্লভ বড়েঠোঁট নলফুটকি পাখিটিকে পেয়েছিলাম। চৈত্রের তপ্ত-তাওয়ায় ভাজা হতে হতে আর সমুদ্রের মোহনায় সুপতি গাংয়ে বিশাল বিশাল ঢেউয়ের নাগরদোলায় চড়ে বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ আমরা লঞ্চে ফিরে আসি। লঞ্চে ফিরেই হাপুস-হুপুস নাস্তা সারলাম সবাই। আর এরপরই প্রায় সবার শরীরেই ক্লান্তি ভর করলো। দু’একজন ছাড়া প্রায় সবাই লঞ্চের কেবিনে কিংবা চিপা-চাপায় যে যেখানে পারলো ঘুমিয়ে পড়লো। সাইফুল ভাই তার কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে আমাকে বলেই ফেললেন, বিকেলে অফিস পাড়ায় যাওয়ার জন্য তাকে যেনো ডাকা না হয়। এমনিতেই কিসমত ভাইর পায়ে রিং পরানো, তিনি কিছু না বললেও বুঝলাম তার অবস্থাও কাহিল।

এরমধ্যে সমুদ্র থেকে উত্তাল তরঙ্গ সুপতি নদীতে ভেসে থাকা আমাদের ছোট্ট লঞ্চ গাংচিলকে দুলিয়ে দুলিয়ে খেলতে শুরু করেছে। আমাদের তরুণ সারেং এনামুল লঞ্চটিকে ভাটির দিয়ে নিয়ে চলতে লাগলো উত্তাল ঢেউয়ের কাছ থেকে রক্ষা পেতে। অন্তত ১৫ কিলোমিটার যাওয়ার পর একটা বড় খালের মাঝে সে নোঙর ফেললো। কটকা’র অফিস পাড়ায় বিকেলের পরিকল্পনা বাতিল করে আমরা যেখানে নোঙর করেছি সেখানকার আশে-পাশে ইঞ্জিন নৌকায় ঘোরাঘুরির পরিকল্পনা নিলাম। তাতে অতি ক্লান্তজনরাও আমাদের সাথে যেতে পারবে।

বিকেল তিনটার পর আমরা সবাই ইঞ্জিন নৌকায় চেপে বসলাম। লঞ্চে আমরা যত হই-চই করিনা কেনো, নৌকায় বসলে সবাই একেবারে চুপচাপ। কোনকিছু নজরে এলে ইশারায় কথা বলতে হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর হাতের বামে একটি শাখা খালে ঢুকলাম আমরা। এবার নৌকার ইঞ্জিনও বন্ধ করে দিতে হলো। মাঝি হাতের বৈঠা দিয়ে নৌকা বাইছে। তখন বৈঠার ছপ ছপ শব্দ, কিছু পাখির কুজন আর আমাদের ক্যামেরার সাটারের শব্দ ছাড়া মনে হলো পৃথিবীতে আর কোনো শব্দ নেই। এই শাখা খালে আমরা কয়েকটি পাখি পেলাম বটে, সেগুলো আমাদের কাছে নতুন কিছু না। তাই সেখান থেকে ফিরে চললাম। বড় খালে এসে ফের নৌকার ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়া হলো। কিছুদূর যাওয়ার পর হাতের বামে আরো একটি খাল দেখলাম। কিন্তু খালটি বেশি সরু আর পানি কম মনে হওয়ায় খালটিতে আর ঢোকা হলো না।

সময় তখন বিকেল চারটা বেজে চৌচল্লিশ মিনিট। বড় খালটির পশ্চিম পাশ ধরেই আমাদের ইঞ্জিন নৌকাটি চলছিলো। হঠাৎ কেওড়া গাছের পাতার ফাঁকে বাঘের মতো হলুদ রঙের বড় কিছু একটা দেখতে পেলাম। ওটা কি বাঘ? নাকি বাঘের মতো কেউ? ব্যাপার বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিচ্ছিলাম। প্রায় একই সময়ে আমাদের এই ট্রিপের আয়োজক রুবেল অস্ফূট চিৎকার করে উঠল…. বাঘ বাঘ বাঘ। হঠাৎ নৌকার মধ্যে তীব্র বিদ্যুৎধারা বয়ে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে সবাই চমকে গেলো। কিন্তু কোথায় বাঘ? যারা তখনো বাঘটিকে দেখেনি, তারা মাটিতে কিংবা পানিতে বাঘ খুঁজতে লাগলো। যে ছেলেটা বোট চালাচ্ছিলো সেও তখনো বাঘটিকে দেখে নাই।

বাঘটি ছিলো কেওড়া গাছের ঝোঁপের মাঝে পানিতে এলিয়ে পড়া একটি সোমত্ত বাইন গাছের উপর বসা। আমাদের নৌকাটি সেই বাইন গাছের নিচে চলে গিয়েছিলো প্রায়, আর বাঘটিও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। জোরে লেজ নেড়ে সেও আমাদেরকে সতর্ক করছিলো। রুবেল চিৎকার করে বোট চালকেকে যখন সতর্ক করলো, নৌকাটিকে হঠাৎ ঘুরিয়ে নেয়ার পর সবাই দেখলো সামনে মাথার উপরে আমাদের অনেকদিনের প্রত্যাশিত বেঙ্গল টাইগার। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সুন্দরবনের আদরের রাজপুত্তুর রয়েল বেঙ্গল টাইগার শান্ত হয়ে বাইন গাছের একটি বাকানো ডালকে সিথান বানিয়ে সেখানে মাথা রেখে আমাদের দেখছিলো, আর অনবরত তার লম্বা লেজটিকে দুলিয়ে যাচ্ছিলো। অসম্ভব আদুরে চেহারার এক আহ্লাদী ভঙ্গিমা তার। মনে হচ্ছিলো বাড়ির পোষা বিড়াল। তার শরীর পরিস্কার ঝকঝকে, একটুও কাঁদা নেই। মনে হচ্ছিলো সাবান-শ্যাম্পু মেখে গোসল করে আমাদের ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবে বলে সেজে-গুজে এসেছে। তার অভিব্যক্তিতে আমাদের কারোর মনে একটু ভয় কাজ করেনি।

সুন্দরবনে প্রথমবারের মতো বাঘের মুখোমুখি হয়ে কি অনুভূতি হয়েছিলো তা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না। তবে প্রচন্ড উত্তেজনা সবার মধ্যে ভর করেছে এটা নিশ্চিত বলা যায়। আমার ক্যামেরার সেটিং ঠিক ছিলো কিনা তা দেখা হয়নি, অনবরত মেশিনগানের মতো কন্টিনিউয়াস মুডে সাটার চেপে চলেছি। যখন ক্যামেরা সেটিংসের কথা মনে পড়লো ততক্ষণে অন্তত দু-তিনশো সাটার চেপে ফেলেছি। দেখলাম ছবিগুলো মনপুত হয়নি। বাঘটি যেখানে ছিলো সেখানে আলো স্বল্পতাও ছিলো। সম্রাটই বললো- লেন্সের এক্সটেন্ডর খুলে ফেলতে। এক্সটেন্ডর খুলে এবং ক্যামেরা সেটিংস ঠিক করে আবার ছবি তোলা শুরু করলাম। নৌকা চালককে ইঞ্জিন বন্ধ করতে মানা করে শুধু বাঘটিকে কেন্দ্র করে যাওয়া-আসা করতে বলা হয়েছে। বাঘের চোখে চোখ রেখে ক্লোজ বা বিগ ক্লোজ অথবা লং শটে ছবি তুলেছে সবাই।

প্রায় এক ঘন্টা ধরে কমপক্ষে এক হাজার থেকে তিন হাজার ছবি তুলেছি একেক জন। একজনের তো ক্যামেরার কার্ড ফুরিয়ে গেছে, আরেকজন পুরনো একটি কার্ড বার বার ফরমেট দিচ্ছে, কিন্তু ক্যামেরা ফরমেট নিচ্ছে না। কেউ কেউ ভিডিও করেছে। কেউ কেউ মোবাইলেও ছবি তুলেছে। বাঘের সাথে সেলফি তোলার দুর্লভ সুযোগও নিয়েছেন কেউ কেউ।

ইতিমধ্যে সূর্য জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গিয়ে সাঁঝের আঁধারের কাছে দিনকে সমর্পণ করেছে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসায় আলোক স্বল্পতায় আমাদের ক্যামেরার সাটারের স্পীড নেমে গেছে। ভালো ছবি হবে না বিধায় আমরা আমাদের লঞ্চে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পেছনে তখনো বসে থাকলো আমাদের সকলের আদরের প্রিয় বেঙ্গল টাইগার, বাংলা বাঘ।

এখানে একটি বিষয় বলে রাখি, খুব সচেতনভাবেই বিকেলে আমরা যে অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করছি এবং বাঘের ছবি তুলেছি, সেই লোকেশনের কথা খোলাখুলি বা পরিষ্কার করে বলছি না। এই নির্দেশনা আমাদের টিমের সমস্ত সদস্যকেই দেয়া হয়েছে। এর দু’টি কারণ। প্রথমতঃ লোকেশনটি প্রকাশ পেলে এখানে পর্যটকসহ নানা ধরণের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়বে, এতে বাঘটির উপর একরকম উপদ্রব হতে পারে। দ্বিতীয়তঃ বিষয়টি ভয়াবহ। সুন্দরবনে নানা ধরণের চোরা শিকারী আছে, তারাও তৎপর হয়ে উঠতে পারে। এতে বাঘটি নিরাপত্তা হুমকীতে পড়তে পারে।
পরেরদিন অর্থাৎ পহেলা এপ্রিল ছিলো সুন্দরবন থেকে আমাদের ফেরার দিন। এদিনও কিছু ছবি তোলার কথা ছিলো, কিন্তু বাঘের ছবি তোলার উচ্ছ্বাসের পর অন্যসব বিষয় নিয়ে ছবি তোলার প্রতি আগ্রহ তেমন ছিলো কারো। লঞ্চের আড্ডায় কার কেমন ছবি হলো, বাঘ নিয়ে নানান গল্প করেই বেশি সময় কাটলো। ইতিমধ্যে ছবি প্রসেস করে দুর্বল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কোনমতে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে একটি ছবি ছেড়ে দিলাম। পরে সেটা খুব দ্রুত নানাভাবে ভাইরাল হয়ে গেলো। চেনা-অচেনা অনেক মানুষ সেই ছবিটি শেয়ার করলো। লাইক-কমেন্টে ভরে গেলো আমার ফেসবুক। কয়েকটি জাতীয় দৈনিক ছাড়াও অনেকগুলো অনলাইন নিউজপোর্টালে সেটা প্রকাশ পেলো।

আমাদের তোলা বাঘটিকে নিয়ে নানাজনের সাথে কথা এবং মতবিনিময় হয়েছে। বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে এটি একটি সাব-এডাল্ট বা কিশোর পুরুষ বাঘ। বয়স আনুমানিক তিন/সাড়ে তিন বছর হতে পারে।

রমজান মাস শুরু হওয়া ছাড়া কিছু ব্যস্ততার কারণে গত তিন সপ্তাহ ছবিগুলোকে ভালো করে দেখা হয়নি। আজ ছবিগুলো খুলে গভীরভাবে পর্যক্ষেণ করছিলাম। ছবিগুলো দেখে আমার মনে হচ্ছে, বাঘটি জোয়ারের সময় সাঁতরে এসে বাইন গাছটিতে বসেছিলো। এরপর ভাটা শুরু হওয়ায় পানি নেমে যাওয়ার পরও সেখানে সে নিশ্চিন্ত মনেই বিশ্রাম নিচ্ছিলো। সরসরি পানি থেকে গাছে ওঠার কারণে বাঘটির শরীরে তো বটেই পায়েও কোনোরকম কাঁদার চিহ্ন দেখা যায়নি। বাঘটি নিজে শিকার করেছে কিনা বলা মুশকিল, তবে তার পেট দেখে মনে হচ্ছিলো, ভরপেট খেয়ে এসেছে। বাইন গাছে বসে সে বার বার ঘুমানোর চেষ্টা করছিলো। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েই মাঝেমধ্যে অলসভাবে চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করছিলো। তার চোখে-মুখে, তার আচরণে কোনো হিংস্র ভাব দেখা যায়নি।

বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের যতগুলো ছবি আছে, আমি নিশ্চিত আমাদের তোলা ছবিগুলো তারমধ্যে সুন্দরতম ছবি। আমরা ছবি তোলার পাশাপাশি বন্যপ্রাণী এবং তার পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণে দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতার দায়ে সবাইকে সচেতন করতে চাই। ভালো থাকুক আমাদের সবগুলো বন এবং বনের প্রাণী।

ছবি: ফরিদী নুমান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *