সংবিধানের একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী জাতীয় ঐক্যের প্রতীক: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সম্ভব, দরকার শুধু শুভবুদ্ধির উদয়

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

ব্যারিস্টার নাজির আহমদ

এরশাদ সাহেবের প্রায় এক দশকের শাসনামল ছিলো বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনে “অন এন্ড অফ” এ ভরপুর, আন্দোলনের মাত্রা বাটখারার মতো ওঠানামা করতো। তবে এর তীব্রতা আসে শেষের দিকে। ঐ আমলের পুরো সময়ের জাতীয় নির্বাচনগুলো (সংসদীয় তথা সাধারণ নির্বাচন, রাষ্টপতি নির্বাচন ও হ্যাঁ-না ভোট) ছিল প্রহসনে ভরা। ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়া লাগতো না, গেলে বরং বলা হতো আপনার ভোট দেয়া হয়ে গেছে!

কথিত আছে- এক চাচা ভোট দিতে গেলে কর্তব্যরত নির্বাচনী কর্মকর্তা বললেন, চাচা আপনার ও চাচির (ঐ চাচার স্ত্রীর) ভোট দেয়া হয়ে গেছে। চাচা জানতে চাইলেন তোমার চাচির ভোট কেমন আগে দেয়া হয়েছে। কর্তব্যরত কর্মকর্তা আধা ঘণ্টা আগে বললে চাচা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অফিসার কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করলে চাচা বললেন, আমি কত দুর্ভাগা যে, আধ ঘণ্টা আগে আসলে তোমার চাচীর সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যেত, কেননা তোমার চাচি সাত বছর আগে এই দুনিয়া ছেড়ে গেলেন, কিন্তু একটিবারের জন্যও আমাকে দেখতে আসলেন না। অথচ আধ ঘণ্টা আগে ভোট দিতে আসলেন! এই ছিল তখনকার ভোটের নমুনা।

মূলত: সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তারাই ভোটের কাজটি সারতেন। ঐ আমলের প্রজন্ম আমরা। আশির দশকে ভোটার হলেও জীবনের প্রথম ভোট দিতে পেরেছি ১৯৯১ সালে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। তবে এরশাদ সাহেবকে নির্বাচনের ব্যাপারে একটি ক্রেডিট না দিলে সম্ভবত বিশ্লেষণে কৃপণতা করা হবে – তার আমলে স্থানীয় নির্বাচনগুলো কিন্তু অনুষ্ঠিত হতো অপেক্ষাকৃত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে।

তখন দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন হতো না। নির্বাচনে দৃশ্যত দলীয় ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ছিল অনুপস্থিত। নিজের দেখা – শহর ও মফস্বলে প্রাণচাঞ্চল্যতার সাথে ও উৎসবমুখর পরিবেশে তখন অনুষ্ঠিত হতো স্থানীয় নির্বাচন। নির্বাচনে এই উৎসবমুখর পরিবেশ ও হস্তক্ষেপ না থাকার কারণ সম্ভবত: ছিল নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না থাকা ও স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন না হওয়ার বাস্তবতা।

সাধারণ নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও হ্যাঁ-না ভোটকে নিয়েই মূলত: যতসব প্রহসন ছিল এরশাদ সাহেবের আমলে। এমন অবস্থায় তার আমলের শেষের দিকে অর্থাৎ আশির দশকের শেষ ও নব্বই দশকের গোড়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে জাতি তখন বহুধাবিভক্ত নির্বাচন নিয়ে – কার অধীনে নির্বাচন হবে? কেউ কাউকে বিশ্বাস করছিলো না। তখন সবাই দাবি ও উদাত্ত আহ্বান জানালেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য। কিন্তু তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। তাকে কনভিন্স করার জন্য ব্যারিস্টার ইসতিয়াক আহমদ ও ড. কামাল হোসেনসহ (বয়সের ভারে ড. কামাল হোসেন এখন মূহ্যমান হলেও তখন আইনাঙ্গনে প্রচণ্ড প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন) প্রতিথযশা আইনজীবীরা দেখা করলেন তাঁর সঙ্গে। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শেষমেষ রাজি হলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ। তবে শর্ত দিলেন তাঁকে তাঁর স্বপদে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে। সংবিধানে এই অবস্থা এবং এভাবে পূর্বপদে যাবার বিধান ছিল না।

এমতাবস্থায় এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের শেষ সময়ে তিন-জোট তাদের রূপরেখায় লিখিত অঙ্গীকার করলেন যে, যে দলই ক্ষমতায় যাক বা সরকার গঠন করুন না কেন একা না পারলে সবাই মিলে সংবিধান সংশোধন করে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ সাহেবের নির্বাচন পরিচালনায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর কার্যাবলী ও স্বপদে ফিরে যাওয়াকে বৈধতা দিবেন। তার সাথে সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠা করা হবে বাংলাদেশের অরিজিনাল সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতি পরিবর্তন করে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার চালু করার মাধ্যমে।

জাতির ক্রান্তিকালে, জাতির এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ প্রথমে উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিলেন তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের পদত্যাগের পর। ঠিক এরপর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করলে তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ হলেন রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি (Acting President)। তিনি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে তিন মাসের ভিতর বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সত্যিকার অর্থে অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ এবং উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করলেন যা দেশে বিদেশে বিপুলভাবে সমাদৃত হলো।

১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে কোনো একক দল সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না। বিএনপি পেল ১৪০টি আসন, আওয়ামী লীগ পেল ৮৮টি আসন, জাতীয় পার্টি পেল ৩৫টি আসন ও জামায়াত পেল ১৮টি আসন। সরকার গঠন করতে লাগে ১৫১টি আসন। কোনো দলই এককভাবে সরকার গঠন করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন পেল না।

জামায়াতের সমর্থন নিয়ে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করার কেবল মেজরিটি পেলেও সংরক্ষিত আসনসহ তাদের দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি হয়নি বা ছিল না সংবিধান সংশোধন করার জন্য। এমতাবস্থায় তিন-জোটের অঙ্গীকারনামার আলোকে বড় দুটি দল তথা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে সংবিধানের একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী পাশ করে যথাক্রমে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে তাঁর পূর্ব পদে ফিরে যাবার পথ সুগম করে দেয়া হয় এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি থেকে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির ব্যবস্থায় ফিরে আসা হয়।

আওয়ামী লীগ কি এমনিতেই সমর্থন করেছে? মোটেই না। বরং এটা করা ছিল তাদের লিখিত অঙ্গীকার ও বাধ্যবাধকতা। বিএনপি’র পরিবর্তে আওয়ামী লীগও যদি সরকার গঠন করতো তাহলে তারাও বিএনপির মতো বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে তাঁর পূর্ব পদে ফিরে যাবার পথ সুগম করে দিত এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতি সরকার চালু করতো সংবিধান সংশোধন করে এবং বিএনপি তাতে সমর্থন করতো। কেননা এটা ছিল তিন-জোটের লিখিত অঙ্গীকার। ভিন্নতা করার পরিবেশ ও বাস্তবতাও তখন ছিল না। করলে শাসনতান্ত্রিক ডেডলক লেগে যেত।

By default বা indirectly আরেকটা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ত্রয়োদশ সংশোধনীকে ঘিরে। পাঠকদের স্বরণ থাকার কথা- নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী দলগুলো তুমুল আন্দোলন গড়ে তুললো। তখন বিএনপি ক্ষমতায়। প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী দলগুলো ঘোষণা দিলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। বিএনপি এই দাবি মানছিলো না। ফলে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি একতরফা নির্বাচন করে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সন্নিবেশ করে কয়েক দিনের মধ্যে সংসদ ভেঙে দিয়ে তারা পদত্যাগ করলেন। আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী দলগুলোর দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার এবং বিএনপি সেই দাবি মেনে নিয়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশ করে তা সংবিধানে সন্নিবেশ করলো। তাই ভিন্ন প্রক্রিয়ায় হলেও পরোক্ষভাবে এক জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছিল এই সংশোধনীকে নিয়ে।

ত্রয়োদশ সংশোধনী একপাশে রেখেও বলা যায় একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী প্রকৃত অর্থে জাতীয় ঐকমত্যের প্রতীক। এটাই প্রকৃত ইতিহাস। অনেকে জিজ্ঞেস করেন ঐ ধরনের ঐকমত্য কি আর জাতির জীবনে আসবে? অবশ্যই আসতে পারে। রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। রাজনীতিতে Art of compromise হচ্ছে রাজনীতিবিদদের অন্যতম প্রধান গুণ। এটি করতে প্রয়োজন ব্যক্তি ও দলের চেয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া।

বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় ঐকমত্য কোনো unprecedented বা নজীরবিহীন ঘটনা নয়। বরং একাধিক precedent বা নজীর আছে বাংলাদেশের গত ৫২ বছরের ইতিহাসে। নব্বই দশকে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাবার পরও এবং সংবিধান সংশোধন করার মতো দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি না থাকার পরও জাতীয় প্রয়োজনে বড় দল দুটি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংবিধানের একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী পাশ করেছেন।

দেশ আজ গভীর সংকটে। এখন সংবিধান সংশোধন করা অবশ্যই সম্ভব। এখন তো বরং আরও সহজ তা করা। অন্য দলের সাপোর্টেরও দরকার নেই। এখন দুই-তৃতীয়াংশই নয় বরং ক্ষমতাসীন দলের একাই আছে তিন-চতুর্থাংশ মেজরিটির চেয়েও বেশি। শুধু দরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও ব্যক্তিদের সদিচ্ছার।

লেখক- বিশিষ্ট আইনজীবী, বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *