রূপসী ওয়েলসের কোলে ছোট্ট এক বাংলাদেশ

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

সাংবাদিক ও গ্রন্থকার দেওয়ান ফয়সল ‘রূপসী ওয়েলসের কোলে ছোট্ট এক বাংলাদেশ’ বইটি উপহার দিয়েছেন। তিনি আমার কাছে গ্রন্থ সমালোচনা আশা করেছেন। সাহিত্যে নোবেলজয়ী লেখকদের নিয়ে একটি গবেষণামূলক কাজের জন্য সামান্য দেরী হয়ে গেল।


আমাকে বই অথবা ম্যাগাজিন উপহার দিলে আমি খুবই আনন্দিত হই। আর লেখকের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আমার ভালোলাগার বিষয়টি প্রকাশ করতে চেষ্টা করি। হয়তো সেকারণেই সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত বহু লেখকের উল্লেখযোগ্য বই আমার সংগ্রহে আছে।

আমি একজন মনযোগী পাঠক। লেখক হিসেবে খুব সিরিয়াস হলেও পাঠের দিক থেকে বেশ উদার এবং নিবেদিতপ্রাণ। লেখার ত্রুটি আবিষ্কার আমার কাজ নয়, বরং প্রতিটি লেখা থেকে রত্ন খুঁজে বের করা আমার অভ্যাস। সৃষ্টিশীল লেখকদের উন্মেষ ঘটাতে আমার মনে এক ধরনের স্পৃহা কাজ করে।

আমার ধারণা, নিজস্ব চিন্তাকে জ্ঞানের আলোকে পাঠকের কাছে পৌছে দেবার প্রয়াস নবীন-প্রবীণ সব লেখকের মধ্যেই থাকে। দেওয়ান ফয়সল সাংবাদিকতার মাধ্যমে সে কাজটি যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে করে চলেছেন।

লেখক ফয়সল অনেকদিন থেকে রেষ্টুরেন্টের সাথে জড়িত। লেখক ও পাচকদের মধ্যে এই জায়গায় একটা অদ্ভুদ মিল রয়েছে। উভয় সম্প্রদায় নিজের মতো করে অন্যকে তৃপ্তি দেন।

আমার ‘ইউকে এশিয়ান রেস্টুরেন্ট ডাইরেক্টরি’তে একটি চ্যাপ্টার ছিল অ্যাওয়ার্ড উইনিং রেস্টুরেন্ট। এটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার সময় গ্রেট বৃটেনের উল্লেখযোগ্য শহরে গিয়েছি। তখন খাবার তৈরীতে নানা রকম আধুনিক পদ্ধতির সাথে পরিচিত হয়েছি। জানা হয়েছে রেস্টুরেন্টের ভেতরের অনেক রহস্য।

একজন শেফ (পাচক-পাচিকা) নিত্যদিন সব কিছু সমান স্বাদযুক্ত করতে পারেন না। রান্নায় একদিন লবন বেশি, আরেকদিন মিষ্টি বেশি হয়। কোন দিন আবার হলুদ বেশি হতে পারে। স্মার্ট শেফ বা বাবুর্চি এটাকে কায়দা করে ধামচাপা দিয়ে থাকেন। রসুন বেশি হলে লেবুর রস, ভিনেগার বা চিনি একটু বাড়িয়ে দেন। রোস্ট বা রেজালায় লবণ বেশি হলে মালাই আর কাবাবে লবণ বেশি হলে লেবুর রস বা চিনি যোগ করেন। ভুনা খাবার ও দো-পেঁয়াজায় লবণ কমাতে হলে চিনি ও টকদই ব্যবহার করেন। হলুদ বেশি হলে তেজপাতা দিয়ে অতিরিক্ত গন্ধ সামাল দেন।
জীবনী, ডায়েরি, স্মৃতিকথা বা প্রবন্ধের মতো নন-ফিকশন লেখায় অনেক লেখকের ক্ষেত্রেও এমনটি লক্ষ্য করা যায়। কোন কিছুর ঘাটতি হলে অন্যটা চালিয়ে দেন। এতে অবশ্য স্বাদ পুষ্টিতে স্বাভাবিকতা ফিরে আসে। যদিও সামাজিক, আধ্যাত্মিক বা রাজনৈতিক বর্ণনায়ও শিল্প ফর্ম মানতে হয়। জ্ঞান এবং বিনোদন সকল ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য।

যেহেতু ভাষার মূল উপকরণ বাক্য এবং বাক্যের মৌলিক উপাদান শব্দ। লেখক সেখানে শব্দ নিয়ে খেলেন। তাতে লেখকের অনুভূতি, সৌন্দর্য ও বুদ্ধিমত্তার আঁচ পাওয়া যায়। ইন্দ্রিয় দ্বারা জাগতিক বা মহাজাগতিক চিন্তা চেতনা শিল্প হয়ে ধরা দেয়। লেখকের বাস্তব জীবনের অনুভূতিই বাক্যে প্রকাশ পায়।

নোবেল জয়ী জাপানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক কাজুও ইশিগুরোর উপন্যাস পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, যে কোন লেখার একটি সাধারণ চরিত্র শিল্প সম্মতভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হলে অসাধারণ হয়ে যেতে পারে। বিশাল বাড়ীতে একজন বাটলার, খাবারের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন ভৃত্য তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হয়ে পাঠক মনে অনেক আনন্দ দিয়েছে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ও জার্মান রাষ্ট্রদূত রিবেনট্রপের বৈঠকে খাবার প্রদানের দায়িত্ব পালন করেছেন বাটলার স্টিভেনস। সেদিন উভয় পক্ষের সার্ভিস প্রদানের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে স্টিভেনস পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক বড় ভূমিকা পালনের দাবিদার হয়েছেন।
‘রূপসী ওয়েলসের কোলে ছোট্ট এক বাংলাদেশ’ বইটি একটি স্মারক গ্রন্থের আদলে সাজানো। ২০২২ সালের ২৩ আগষ্ট বইটির প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয় কার্ডিফ সিটি হলের কাউন্সিল চেম্বারে। এতে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কার্ডিফের লর্ড মেয়র কাউন্সিলার গ্রাহাম হিনচি, মিনিষ্টার ফর জাষ্টিস জেইন হাট এমএস, ডেপুটি মিনিষ্টার সোস্যাল সার্ভিস জুলি মরগান এমএস, আনা ম্যাক মরিন এমপি, বাংলাদেশ হাই কমিশনের মিনিষ্টার (পলিটিক্যাল) এএফএম জাহিদুল ইসলাম ও অনারারী কনসাল অব ফিনল্যান্ড জুলিয়ান ফিলিপস।

বইটি ছাপা ও প্রকাশনা অনুষ্ঠান আয়োজনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন কার্ডিফের কাউন্সিলার দিলাওয়ার আলী (ল্যান্ডফ নর্থ), ওয়েলস বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান দিলাবর হোসেন এবং সাংবাদিক ও সংগঠক মকিস মনসুর। অনুষ্টানে কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন আব্দুল লতিফ কয়ছর, মুক্তার আহমদ, কাউন্সিলার আলী আহমদ প্রমুখ।

এর আগে ১২ আগষ্ট ২০২২ তারিখে ’ওয়েস্টার্ন মেইলে’ গ্রন্থ সম্পর্কে লেখক দেওয়ান ফয়সলের সাক্ষাৎকার পূর্ণ পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপা হয়। ওয়েলসে সম্ভবত প্রথম বাংলাদেশী যার ইন্টারভিউ ওয়েষ্টার্ন মেইলে প্রকাশিত হয়েছে।

লেখক বইয়ে বর্ণনা করেছেন আমাদের পূর্ব পুরুষের প্রথম এদেশে আসার ইতিহাস। ১৯৩৪ সালে জাহাজে রওয়ানা দিয়ে বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরে ১৯৩৭ সালে তারা যুক্তরাজ্যের ওয়েলসে এসে পৌছান। তারা কিভাবে ওয়েলসে বসতি স্থাপন শুরু করলেন তার বিস্তারিত বিবরণ।
আছে সেভার্ন ব্রিজ সহ পারিপার্শ্বিক বর্ণনা। ইংল্যান্ড আর ওয়েলসের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেছে বিখ্যাত সেভার্ন ব্রীজ। ওয়েলসের পরিচিতির সাথে রয়েছে রোমান সাম্রাজ্যের শাসনামলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, স্বাধীকার আন্দোলনে সাহস এবং বীরত্বের ইতিহাস, এক নাগাড়ে ১০ বছর ওয়েলসের ফার্ষ্ট মিনিষ্টার রাইট অনারেবল রডরি মর্গান প্রসঙ্গ এবং ১৯১৪/১৫ সালে ডেপুটি লর্ড মেয়র কাউন্সিলার আলী আহমদের সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য প্রসঙ্গ।

আরো রয়েছে চ্যারিরটি সংগঠন, ওয়েলসের বাংলা স্কুল, ওয়েলসের কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের সাফল্য, সেখানকার বাংলা সাংবাদিকতা, কার্ডিফ শহীদ মিনার, মৌলভী বাজার ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশন, ওয়েলস বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স, কার্ডিফ বাংলাদেশ এসোসিয়েন, গ্রেটার সিলেট কাউন্সিল- সাউথ ওয়েলস, বাংলাদশ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন কার্ডিফ, মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসীদের অবদান, ওয়েলসে মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশীদের অবস্থান, বাংলাদেশী ব্যবস্থাপনায় মসজিদসমুহ, ওয়েলসের কয়েকটি দর্শণীয় স্থান ইত্যাদি।

ওয়েলসে এজাতীয় প্রথম বাংলা বই হিসেবে ‘রূপসী ওয়েলসের কোলে ছোট্ট এক বাংলাদেশ’ আমাদের কমিউনিটিতে বেশ সাড়া জাগিয়েছে।
দেওয়ান ফয়সল দীর্ঘ দিন থেকে সাংবাদিকতার সাথে জড়িত। দেশে থাকাকালে কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আমোদ-এর হবিগঞ্জ প্রতিনিধি ছিলেন। এরপর খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রবাহ পত্রিকার হবিগঞ্জ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৮৩ সালে বিলেত চলে আসেন। লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নতুন দিন পত্রিকায় নিউজ এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

দেওয়ান ফয়সল (দেওয়ান রফিকুল হায়দার ফয়সল) ১৯৫৮ সালের ৭ ডিসেম্বর সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানার দূর্লবপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তিনি একজন অমায়িক বন্ধুবৎসল ও নিরহংকার মানুষ। আগামীতে আরো নতুন নতুন গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে লেখকের বিকাশ ও সমৃদ্ধি এবং সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

* সাঈদ চৌধুরী– সময় সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *