রাজত্ব ছেড়ে সিংহাসন ছেলের হাতে তুলে দিলেন ডেনমার্কের রানি

ইউরোপ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

জ্যাকলিন হাওয়ার্ড এবং অলিভার স্লো

ডেনমার্কের রানি দ্বিতীয় মারগ্রেথ নতুন বছরের শুরুতে একটি টেলিভিশন ভাষণে আকস্মিকভাবে রাজত্ব ত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪ই জানুয়ারিতে পদত্যাগ করবেন, ওই দিন তার রানি হিসেবে সিংহাসনে আরোহণের ৫২ বছর হবে।

“আমি আমার ছেলে ক্রাউন প্রিন্স ফ্রেডেরিকের কাছে সিংহাসন ছেড়ে দেব,” তিনি ঘোষণা দেন। ৮৩ বছর বয়সী দ্বিতীয় মারগ্রেথ বর্তমানে বিশ্বের একমাত্র রাজত্বকারী রানি। ইউরোপের যতো দেশে রাজা রানি রয়েছেন তার মধ্যে তিনিই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সিংহাসনে আছেন।

১৯৭২ সালে তার বাবা রাজা নবম ফ্রেডেরিকের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় মারগ্রেথ সিংহাসনে আসীন হন। ওই টেলিভিশন ভাষণে রানি জানিয়েছেন যে, ২০২৩ সালের প্রথম দিকে তার পিঠে অস্ত্রোপচার হয়। এরপর তিনি রাজত্ব ত্যাগের কথা ভাবতে শুরু করেন।

“এই অস্ত্রোপচার স্বাভাবিকভাবেই আমাকে ভবিষ্যতের বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে যে – পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার সময় এসেছে কিনা,” তিনি বলেন। “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এখনই সঠিক সময়,” তিনি বলেন। এতোটা বছর ধরে রাজপরিবারের পাশে থাকার জন্য তিনি ডেনিশ জনসাধারণকে ধন্যবাদ জানান।

ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন রানিকে তার কাজের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, “এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজ দায়িত্ব এবং পদ হস্তান্তর হয়ে এলেও এটা বোঝা কঠিন যে কখন সিংহাসন পরিবর্তনের সময় এসেছে।” যুক্তরাজ্যের মতো ডেনমার্কেও সাংবিধানিক রাজতন্ত্র রয়েছে।

পরবর্তী রাজা ক্রাউন প্রিন্স ফ্রেডেরিক

ক্রাউন প্রিন্স ফ্রেডেরিক ১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে ডেনমার্কে আমোদ স্ফুর্তি করা রাজপুত্র হিসাবে পরিচিত ছিলেন।কিন্তু তিনি ১৯৯৫ সালে আরহাস ইউনিভার্সিটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করার পরে সেই ধারণা বদলাতে শুরু করে।

তিনিই দেশটির প্রথম রাজপরিবারের সদস্য যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করেছেন। পড়াশোনার সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ডে বিশ্ববিদ্যালয়েও সময় কাটিয়েছেন, সেখানে তিনি ফ্রেডেরিক হেনরিকসেন ছদ্মনামে ভর্তি হন।

পরে তিনি ডেনিশ নৌবাহিনীতে কাজ করেন, সেখানে তাকে “পিঙ্গো” ডাকনাম দেওয়া হয়। এর কারণ প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যম দ্য মেইলে। ওই খবর অনুসারে, স্কুবা ডাইভিং কোর্স চলাকালে ফ্রেডেরিকের পরনে থাকা ওয়েটস্যুটটি পানিতে ভর্তি হয়ে যায়। পরে তাকে পেঙ্গুইনের মতো হাঁটতে হয়েছিল।

২০০০ সালে গ্রিনল্যান্ড জুড়ে চার মাসের স্কি অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। এ কারণে তিনি দুঃসাহসী বা ডেয়ারডেভিল ব্যক্তি হিসাবে আখ্যা পান। এছাড়া স্লেজিং এবং স্কুটার দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তিনি হাসপাতালেও ভর্তি ছিলেন।

“আমি নিজেকে কোন দুর্গে বন্দী করতে চাই না। আমি আমার মতো একজন মানুষ হতে চাই।” তিনি একবার বলেছিলেন, যে সিংহাসনে আরোহণের পরেও তিনি তার এসব সখের সাথে যুক্ত থাকবেন। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি ডেনমার্কের রাজা হতে চলেছেন।

তবে ৫৫ বছর বয়সী এই ক্রাউন প্রিন্সের কোন আনুষ্ঠানিক রাজ্যাভিষেক বা মুকুট পরানোর অনুষ্ঠান হবে না। যেমনটা ব্রিটেনের ঐতিহ্যবাহী রাজকীয় রীতিতে দেখা যায়। তার পরিবর্তে, কোপেনহেগেনের অ্যামালিয়ানবার্গ প্রাসাদ থেকে ফ্রেডেরিকের সিংহাসনে আরোহণের কথা ঘোষণা করা হবে।

তিনি ডেনমার্কের রাজা এবং দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে তার পদ গ্রহণ করবেন। ডেনমার্কে রাজতন্ত্র মূলত একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র – যার অধীনে গ্রিনল্যান্ড এবং ফ্যারো দ্বীপপুঞ্জও রয়েছে।

ক্রাউন প্রিন্স ফ্রেডেরিক, ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের মতো প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি তার আবেগের জন্য পরিচিত। তিনি ভবিষ্যতে ডেনমার্ককে তার মতো পরিচালনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

তার স্ত্রী, প্রিন্সেস মেরি, অস্ট্রেলিয়ান দ্বীপ তাসমানিয়াতে বড় হয়েছেন। ২০০০ সালে অলিম্পিক গেমসের সময় সিডনির একটি পানশালায় এই জুটির দেখা হয়। তিনি তখন আইনজীবী ছিলেন।

তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন যে, যখন ফ্রেডেরিকের সাথে তার দেখা হয় তিনি জানতেন না যে তিনি ডেনমার্কের রাজপুত্র। তিনি বলেছিলেন: “আধ ঘণ্টা পরে কেউ আমার কাছে এসে বলে, ‘আপনি কি জানেন তারা কারা?’

আধুনিক ধ্যানধারণা চর্চার কারণে কেউ কেউ তাদেরকে আধুনিক মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্বকারী বলে মনে করেন। তারা তাদের চার সন্তানকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে লালন-পালন করার চেষ্টা করেছেন, তাদের সরকারি স্কুলে পড়িয়েছেন।

ব্রিটিশ রানি দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন রানি মারগ্রেথ

রানি মারগ্রেথ ডেনমার্কের একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব এবং দেশটির অনেক মানুষ আশা করেছিলেন তিনি তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সিংহাসনে থাকবেন।

ড্যানিশ সাংবাদিক টাইন গোটশে বিবিসিকে বলেছেন, “আপনাদের কাছে রানি এলিজাবেথ যেমন, রানি মারগ্রেথ আমাদের কাছে তেমনই ছিলেন।”

২০২২ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিয়েছিলেন মারগ্রেথ এবং তারা একই বছরে তাদের নিজ নিজ জয়ন্তী উদযাপন করেছিলেন।

তিনি যখন জন্ম নিয়েছিলেন তখন তিনি কখনও রানি হবেন বলে আশাও করা হয়নি। কিন্তু যখন তিনি ১৩ বছর বয়সে পা রাখেন, তখন নারীদের সিংহাসন গ্রহণের অনুমতি দিয়ে ডেনিশ আইনে পরিবর্তন আনা হয়।

এক দশকেরও বেশি আগে, রানি মারগ্রেথ কথায় ফুটে ওঠে যে তিনি প্রয়াত ব্রিটিশ রানির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
“আমি একটি বিষয় বুঝতে পেরেছি যে এই জাতির জন্য আমাকে আমার জীবন অবশ্যই উৎসর্গ করতে হবে যেমনটা তিনি করেছেন, এবং এ কারণেই তিনি আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।”

রানি এলিজাবেথের মৃত্যুর আগে তারা দুজনই বিশ্বের অবশিষ্ট নারী সার্বভৌম ছিলেন। এলিজাবেথ ৭০ বছর রাজত্ব করেছেন।

মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট প্রত্যাখ্যান, ছিলেন চিত্রশিল্পী

রানি মারগ্রেথকে আদর করে ডেইজি নামে ডাকা হয়। তিনি তার ধূমপানের অভ্যাস এবং মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহার না করার জন্য ব্যাপক পরিচিত ছিল। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ছাড়া তিনি নিজেকে “খুব সুখী” ঘোষণা করেছেন।

সিংহাসনে থাকাকালীন, রানি মারগ্রেথ একজন চিত্রশিল্পী হিসাবে কাজ করে গিয়েছেন এবং শিল্পকলার প্রতি তার ভালবাসার জন্য তিনি সুপরিচিত ছিলেন। তার প্রত্নতত্ত্বের প্রতিও অনুরাগ রয়েছে এবং তিনি বেশ কয়েকটি খননে অংশ নিয়েছিলেন।

তিনি যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করেছেন, কেমব্রিজের গার্টন কলেজ এবং লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে ছিল তার পদচারণা। ১৯৬৭ সালে, তিনি ফরাসি কূটনীতিক হেনরি দে লেবোর্দে দে মনপেজ্যাটকে বিয়ে করেন। যিনি ২০১৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মারগ্রেথের রাজকীয় সঙ্গী হিসাবে কাজ করেছেন।

মারগ্রেথের রাজস্ব

কেউ কেউ তাকে বিশ্বের দীর্ঘতম রাজত্বকারী রানি হিসেবেও বিবেচনা করেন। ব্রুনাইয়ের সুলতান তার চাইতেও বেশি সময় সিংহাসনে থাকলেও, দেশটি স্বাধীন হয়েছিল ১৯৮৪ সালে।

তিনি ডেনমার্কের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় সিংহাসনে আসীন রানি। এই বছরের শুরুতে তিনি নরওয়ের রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানের রাজত্বকালও ছাড়িয়ে যান।

গোটশে বলেন, ডেনমার্কের রাজ ক্ষমতা হস্তান্তর একইসাথে বেদনা এবং উদযাপনের এক মিশ্র অনুভূতির মুহূর্ত। “তিনি সবসময় আমাদের পাশে ছিলেন, আমাদের সবার সাথেই তার বয়স বেড়েছে,” গোটশে বলেন।

“দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে ক্রাউন প্রিন্স খুব ভাল অবস্থানে আছেন, কেননা এরপর তার উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা আছে – এটি খুব যুক্তিসঙ্গত যা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।”

প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন রানীকে তার কাজের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, “দেশের আপামর জনসাধারণের পক্ষ থেকে, আমি মহামতি রানিকে তার আজীবন ত্যাগ এবং রাজ্যের জন্য অক্লান্ত প্রচেষ্টার কারণে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই।”

“আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা রানি দ্বিতীয় মারগ্রেথ ছাড়া আর কাউকে ওই পদে ভাবতে পারেন না।” “তিনি ডেনমার্কের প্রতীকের মতো এবং বছরের পর বছর ধরে আমরা মানুষ এবং জাতি হিসাবে কেমন এর সাথে রানির শব্দ ও অনুভূতি মিশে আছে।”

প্রতি বছর নববর্ষের প্রাক্কালে, ডেনমার্কের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তার বক্তব্য সম্প্রচার করা হয়। এই বছর, তিনি রাজ্য ত্যাগের ঘোষণার পাশাপাশি, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার গুরুত্ব নিয়েও কথা বলেছিলেন।

ইউরোপ জুড়ে আধুনিক সমাজের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে অন্যান্য রাজকীয় পরিবারের মতো, ডেনিশ রাজপরিবারও তাদের রাজপরিবারের সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত বছর ক্রাউন প্রিন্স ফ্রেডেরিকের ছোট ভাই প্রিন্স জোয়াকিমের সন্তানদের রাজকীয় উপাধি কেড়ে নেওয়ার পরে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ দেখা দেয়। – বিবিসি নিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *