রাজঅতিথির গণহজ্জ

ধর্ম ও দর্শন মতামত সময় চিন্তা সময় টিভি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

ড.যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হকঃ সৌদি সরকারের মেহমান হিসেবে আমি হজ্জে যাচ্ছি, আমার বাসায় এটি জানাজানি হওয়ার পর থেকে আমি এক প্রকার বিদ্রোহের মুখোমুখি হলাম। আমার সহধর্মিনী হজ্জযাত্রার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করলেন। ছেলেগুলোও জোর কোরাসে তাদের মাকে সমর্থন করলো।

নানাবিধ অসুবিধা আছে জেনেও শান্তির স্বার্থে আমি রাজি হলাম। আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু, মহৎপ্রাণ (নাম প্রকাশ করছি না)-এর সার্বিক সহযোগিতায় একেবারে শেষ মুহূর্তে তাঁর হজ্জযাত্রা নিশ্চিত হয়। আমি রওয়ানা দিলাম সৌদি সরকারের মেহমানের সাথে, সে যাত্রা করল একটি এজেন্সির হাজিদের সাথে। তার আপন চাচা হজ্জযাত্রী হওয়ায় সফরে অসুবিধা ছিল না।

আমাদের হোটেল ছিল কিছুটা দূরে, রি’ যাখের-এর নবোটেল। হোটেল হতে ২৪/৭ মাসজিদুল হারামে গাড়ি আসাযাওয়া করত। কিন্তু গাজ্জা স্টেশনে যেখানটায় আমারদেরকে নামিয়ে দেওয়া হত, সেখান হতে প্রায় ১৫ মিনিট হেঁটে হারাম শরীফে যেতে হত। পক্ষান্তরে ওদের হোটেল ছিল আজয়াদে, হারামের অনেক নিকটে। কিন্ত আজয়াদ ও গাজ্জা হারামের বিপরীত দুই দিকে অবস্থিত। প্রতি বেলা সে আমার জন্য অপেক্ষা করত। জনদঙ্গলে পাড় হয়ে আমি গাজ্জা হতে আজয়াদ গিয়ে তাঁকে মসজিদুল হারামে নিয়ে আসতাম। সে উমরাও করেছে আমার সাথে।।

৭ জিলহজ্জ রাতে গ্রুপের হাজিদের সাথে সে মিনায় চলে যায়। 8 তারিখ সন্ধ্যায় আমরা আরাফাতে গমন করি। আমার এক ব্যবসায়ী শিক্ষার্থী থেকে আরাফার একটি মানচিত্র পেয়েছিলাম। ৮ তারিখ রাতে সেটি স্টাডি করলাম। ৯ তারিখ সকালে রাজঅতিথিদের তাঁবু হতে বের হয়ে মাত্র ১৫ মিনিট হেঁটে আমার স্ত্রীদের তাঁবু আবিষ্কার করি। কিছুক্ষণ পর তাঁর সাথে দেখা হয়। ‘সন্ধ্যায় দেখা হবে; এমন ওয়াদা করে আমি নামিরার পাশে রাজঅতিথিদের তাঁবুতে ফিরে যাই।

আরাফায় অবস্থানের ফরজ পালন শেষে বিকেলে অতিথিবৃন্দ যখন গাড়িতে আরোহণ করছিলেন তখন আমি সমন্বয়ককে জানালাম, আমি বের হচ্ছি, আপনাদের সাথে হোটেলে দেখা হবে হাজ্জের সকল কাজ সম্পন্ন করে, ১২ জিলহাজ্জ রাতে

আবার ছাতা নিয়ে বের হলাম। ওদের গাড়ি আসল রাত দশটায়। এজেন্সিমালিক ও মুয়াল্লিমকে বলা ছিল। ওদের গাড়িতে ৫ ঘন্টা অবস্থান করে রাত তিনটের দিকে মুযদালিফায় পৌছলাম। মাগরিব-এশা আদায় করে, পাথর কুড়িয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নিলাম। ফজরের পর আবার রওয়ানা করলাম। আমার ধারণা ছিল না, এ যাত্রা কত দীর্ঘ। এজেন্সিওয়ালাদের টিকিটি নেই। ওরা কি পালিয়ে গেছে, না আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি, জানি না। প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা অবিশ্রান্ত হেঁটে জামরায় পাথর নিক্ষেপ করলাম। মুযদালিফা থেকে জামারায় ট্রেনে আসা যায় বলে শুনেছি। কিন্তু আমাদের পথ-ঘাট চেনা ছিল না। ১০ জিলহজ্জ ঈদের দিন ছিল। বিষয়টি মনে পড়ল, সৌদি নিরাপত্তাকর্মীদের অভিবাদনে, ওরা আমাদেরকে দেখে ‘বাংলাদেশ! ঈদ মুবারক‘ ধ্বনি দিচ্ছিল।

জামারা আল-আকাবায় পাথর নিক্ষেপের পর তাওয়াফের উদ্দেশ্যে মাসজিদুল হারামে পা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আমার ছিল। কিন্তু আমার সহধর্মিনী অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যে গৃহবধূ বা গৃহকন্যা ঘর হতে বের হয়েই রিকশা বা অন্য কোন বাহনে পা রাখে, দশ-বারো কিমি হেঁটে আসার পরও তার চলচ্ছক্তি বহাল থাকবে, এটা কল্পনা করা যায় না।

বাধ্য হয়ে বসে পড়লাম সিসা বিন-দাউদের সামনের রাস্তার ফুটপাতে, ভাগ্যিস! তখন উঁচু উঁচু হোটেলগুলো ফুটপাতে ছায়া দিয়ে যাচ্ছিল। আমি ডানে-বামে আধ-কিমি ছুটোছুটি করলাম, না একটাও খালি ট্যাক্সি পেলাম না। প্রায় দু’ঘন্টা বসে আছি রাস্তায়, এমন সময় আমার সেই ছাত্রকে দেখলাম যে কীনা আমাকে সরবরাহ করেছিল আরাফার নিখুঁত মানচিত্র, চিৎকার দিয়ে তাকে ডাকলাম। সে বলল, স্যার আপনি এ অবস্থায়! আমি বললাম, একটা গাড়ি জোগাড় করো। সে আমাদেরকে বলল তাকে অনুসরণ করতে। একটু নিচের রাস্তায় গিয়ে একটি গাড়ি ভাড়া করল। সেদিনের ভাড়ার ব্যাপারে মন্তব্য করার ভাষা নেই, ৫০ রিয়ালের স্থলে ৫০০ রিয়াল। যা হোক! ছাত্রটি আমার কাছে ভাড়া প্রকাশ করল না, ভাড়া দিতেও দিল না। আমার এক আত্মীয়ের বাসায় পৌঁছে কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম নেয়ার পরই কেবল আমরা তাওয়াফ করার সাহস জোগাড় করলাম।

আমার স্ত্রীর নাজুক অবস্থা দেখে তাকে বলেছিলাম, তোমার উকিল হিসেবে আমি পাথর নিক্ষেপ করব, তুমি তাঁবুতে অবস্থান করো। সে কিছুতেই রাজি নয়। ১১ তারিখও পাথর নিক্ষেপের জন্য পদব্রজে আসা-যাওয়া করতে হল মিনা হতে। ১২ তারিখ ট্রেনের রাস্তা চিনে নিলাম। তবুও দেড়-দুই কিলোমিটার হাঁটতে হল। সেদিন সিসা বিন দাউদ হতে একটি গাড়িতে হারামে ফিরেছিলাম জনপ্রতি এক শত রিয়াল ভাড়া দিয়ে, যা সাধারণত ২০ রিয়ালের বেশি হয় না।

১৩ জিলহজ্জ আমাদের মাদীনা যাত্রা। ১২ জিলহজ্জ রাতে তাওয়াফুল বিদা আদায় করলাম, এক অনির্বচনীয় সিগ্ধ পরিবেশে। মাতাফ এমনিতে তুলনামুলকভাবে শীতল থাকে, চারপাশের ফোঁটাছিটানো ফ্যানের কারণে, তাছাড়া মাতাফের মেঝে দ্বিপ্রহরেও উষ্ণ হয় না। কিন্তু শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশীর চাঁদ আকাশে, টাওয়ারচূড়ায় ঘড়ির পাশে কি এক সিগ্ধ, মোহনীয়, আলো ছড়ায় ও শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়। এ শান্ত, সৌম্য ও মোহনীয় পরিবেশ আমার মনে এমন এক অনুভূতির সৃষ্টি করল, যা মনে হয় কোন তাওয়াফে অনুভূত হয়নি। বারবার শব্দে ও নৈঃশব্দে উচ্চারণ করছিলাম, খোদা! তাওফিক দাও! আবারো আবারো তোমার ঘরে আসার, এমন শান্ত-সিগ্ধ পরিবেশে মোহাবিষ্ট চোখে তোমার ঘরকে দেখার।
তাওয়াফ শেষ। রাজার মেহমান হলেও আল্লাহ তাআলা গণমানুষের মত হজ্জ পালনের তৌফিক দিয়েছেন। আমার মোবাইলে চার্জ না থাকায় চারদিন ধরে রাজঅতিথিদের সাথে যোগাযোগ ছিল না। দেরি করার সুযোগ নেই। ছুটলাম হোটেলে। কাল সকালে মদিনার গাড়ি ধরতে হবে রাজঅতিথিদের সাথে।

(বি.দ্র. বুড়ো মানুষদের দেখে আমরা তামাশা করে বলি, এ বয়সে কেন হাজ্জ করতে এসেছে? কিন্তু আমি কোন বুড়োকে ব্যর্থ হতে দেখিনি। দশ-বারো কিমি হেঁটে তাঁরা ঠিকই পাথর নিক্ষেপ করেন। যে নারী ঘরের বাইরে গেলেই রিকশা বা গাড়িতে পা ফেলে সেও ৪/৫ ঘন্টার বিরামহীন পদবিক্ষেপে রাম আল-জিমার সম্পন্ন করে। নিশ্চয়ই হাজ্জীগণ আল্লাহর বিশেষ রহমত ও সাহায্যপ্রাপ্ত হন।)

লেখকঃ চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *