মৌলভীবাজার শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প মাঝ পথে এসে থমকে দাড়িয়েছে ॥ বর্ষায় ঢলে শহর ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা

সাম্প্রতিক সিলেট
শেয়ার করুন

হুমায়ূন রশিদ চৌধূরী মৌলভীবাজার থেকে

মৌলভীবাজার শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ প্রায় মাঝ পথে এসে থমকে দাড়িয়েছে। চলতি বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানিতে মৌলভীবাজার শহর-সহ আশাপাশ এলাকা ডুবে যাওয়ার আশঙ্কায় এলাকাবাসী আতংকে ভুগছেন।

তিন বছর আগে মনুনদীর ভাঙ্গন হতে ‘মৌলভীবাজার জেলার সদর, রাজনগর ও কুলাউড়া উপজেলা রক্ষা প্রকল্প’ নামে প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয় সাপক্ষে একটি প্রকল্প হাতে নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। বেশ কিছু যায়গায় প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে, কিন্তু কিছু যায়গায় কাজের অগ্রগতি নেই। কিছু যায়গায় কাজ শুরুই করা যায়নি।

চলমান এ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত শাহবন্দর হতে মৌলভীবাজার নতুন ব্রীজ পর্যন্ত ৬ হাজার ৪৩০ মিটার বাঁধ পুন:নির্মাণ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়ায় উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। এখানকার কাজ শেষ না করলে বর্ষায় ঢল নামলে মৌলভীবাজার জেলা শহর ডুবে যাবে।

স্থানীয় বসিন্দা ফজলুর রহমান বলেন, ‘মনু নদীকে বিশ্বাস করা যায় না। পানি বাড়লেই বিপদ। তাই এই বাঁধ আমাদের জীবন মরণ সমস্যা। এটির উপর জীবন-জীবিকা ও ভবিষ্যত উন্নয়ন নির্ভর করে।’ শহরের পূর্ব প্রান্তে ৮ কি. মিটার বাঁধের কাজ শেষ হলেও বর্তমানে এলাকার নদীর দুই তীরের বিভিন্ন স্থানে ১৩ কি. মিটার জায়গা সরকারী ও ব্যক্তি মালিকানা থাকায় কাজে বিপত্তি দেখা দিয়েছে। এখানে আদালতের নিষেধাঞ্জা জারী রয়েছে। তাই গত তিন মাস থেকে ঐ এলাকায় কাজ বন্ধ। জমির মালিকরা জমি অধিগ্রহণ বাবদ জমির মূল্য চায়। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই খাতে বরাদ্ধ নেই। ফলে বিষয়টি আটকে আছে।

পানি উন্নয়ন বের্ডের মতে, বিষয়টির সুরহার জন্য উচ্চ পর্যায়ের চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে- জানালেন মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল।

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার অন্যতম সমস্যা বন্যা ও পাহাড়ী ঢল। ঢলে বাড়ীঘর, জমি-জিরাত, রাস্থাঘাট সহ বিভিন্ন অবকাঠামো ফি বছর বিনাশ হয়। মৌলভীবাজারবাসী প্রতি বছর বর্ষার আগেই ঘুম হারাম হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ভয়াবহ বন্যার কথা স্মরণ করে আজো মৌলভীবাজারবাসী প্রমাদ গুনেন। ভারতের ত্রীপুরা রাজ্যে থেকে নেমে আসা মনু নদী সীমান্ত ঘেষা মৌলভীবাজারের চাতলাপুর সীমান্তে দিয়ে প্রবেশ করে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কুশিয়ারায় মিলিত হয়েছে। প্রতি বর্ষায় মনু নদী দিয়ে পাহাড়ী ঢল নামে। ঢলের পানিতে জনপদ প্লাবিত করে। নদী তীর ভেঙ্গে গ্রামের পর গ্রাম গ্রাস করে।

এই সর্বনাশ থেকে মৌলভীবাজারবাসীকে রক্ষা করতে জন দাবির প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের জুন মাসে মনুনদীর ভাঙ্গন হতে ‘মৌলভীবাজার জেলার সদর, রাজনগর ও কুলাউড়া উপজেলা রক্ষা প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প হতে নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড ৯৯৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয় সাপেক্ষ। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল। প্রকল্প সমাপ্তির মেয়াদ বেঁধে দেয়া হয় ২০২৪ সালে জুন মাস পর্যন্ত।

৭২ টি প্যাকেজের কাজ:

৭২ টি প্যাকেজে ৬৭টি স্থানে ৩০ দশমিক ২৪০ কি.মি. স্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক কাজ, ৬৪ টি স্থানে ১২ দশমিক ১১০ কি.মিটার চর অপসারণ, ৮৫ দশমিক ৯১০ কি.মি. মনু বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পুনর্বাসন, ২ দশমিক ৫০০ কি.মি. নতুন ফ্লাড ওয়াল নির্মাণ, দশমিক ৭৬৬ কি.মি. পুরাতন ফ্লাডওয়াল নির্মাণ, ২২৮ দশমিক ৫৬ একর ভুমি অধিগ্রহণ। এ পর্যন্ত সাড়ে ৪৪ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।

সরজমিনে দেখা যায় প্রকল্পের বিভিন্ন স্পটে সুবিন্যস্ত করে সিসি ব্লক বিছানোর ফলে সংস্লিষ্ট নদী তীরের বাসিন্দাদের মধ্যে স্বস্থি এসেছে। তীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্যটকারাও ভিড় করেছেন ঐসব স্থানে।

তবে নির্দিষ্ট সময় প্রকল্প কাজ শেষ না হওয়া প্রসঙ্গে মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ‘এটি সরকারের একটি বড় প্রকল্প। ৭২টি প্যাকেজের মধ্যে অনেক স্থানে কাজ শেষ পর্যায়ে। কোন কোন স্থানে কাজে একটু সময় লাগছে নানা কারণে।’ তিনি বলেন, ‘তবে যে সব স্থানে কাজ পিছিয়ে আছে তার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য সময় চেয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে আবেদন জানানো হয়েছে।

বেড়ী বাধের কাজ দ্রুত শেষ করতে মানবন্ধন

অন্যদিকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের মনু নদীর বেড়িবাঁধের কাজ দ্রুত শেষ করার দাবিতে মানববন্ধন করেছে স্থানীয় এলাকাবাসী গত ২০ মার্চ। দ্রুত কাজ শুরু না করলে তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও সহ বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিবেন বলে হুঁশিয়ারী দেন।

মনু নদীর তীরবর্তী রাজাপুর গ্রামে এ মানববন্ধনের আয়োজন করেন স্থানীয় সচেতন এলাকাবাসী। পৃথিমপাশা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য কবির উদ্দিনের সভাপতিত্বে ও সাবেক ইউপি সদস্য আব্বাছ আলীর পরিচালনায় বক্তব্য রাখেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা সিপিবি‘র সভাপতি কমরেড আব্দুল লতিফ, উপজেলা ক্ষেত-মজুর সমিতির নেতা প্রভাষক সৈয়দ মোশারফ আলী, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আকদ্দস আলী, উপজেলা কৃষকলীগের সাধারণ স¤পাদক ফুয়াদ আলম চৌধুরী, প্রভাষক তোফায়েল তালুকদার, পৃথিমপাশা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সদস্য সচিব আব্দুল মুনিম সোহেল প্রমুখ।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, মনু নদীর কুলাউড়া অংশের পৃথিমপাশা ইউনিয়নের ধলিয়ার বেলেরতল, কলিরকোনা, রাজাপুর এলাকায় বেড়িবাঁধে মাটি ও ব্লকের কাজ পায় মেসার্স আরাধনা এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স জামান কনস্ট্রাকশন (জেভি)। ২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর কাজ শেষ করার কথা থাকলেও অদ্যাবদি ১০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের তিন বছর অতিবাহিত হলেও কাজ চলছে কচ্ছপ গতিতে। কাজের জন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে বার বার তাগিদ দিলেও কোন কাজ হচ্ছে না।

তারা বলেন, ২০১৮ সালে মনু নদীর ভয়াবহ বন্যায় কুলাউড়ার অর্ধ শতাধিক গ্রামের প্রায় দুই সহস্রাধিক মানুষের ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। হাজার হাজার একর ফসলি জমি তলিয়ে যায়। সেই সঙ্গে এ ইউনিয়নগুলোর লোকজন প্রতিটি মুহুর্তে বন্যা আতঙ্কে দিন কাটে। বন্যার হুমকিতে রয়েছেন ইউনিয়নের প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আরাধনা এন্টারপ্রাইজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ সাত্তার বলেন, পৃথিমপাশার আলীনগর এলাকায় জিওব্যাগ তৈরির কাজ শেষ। বিল না পাওয়ায় কাজে ধীরগতি হচ্ছে। নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, পৃথিমপাশা ইউনিয়নের তিনটি স্থানে কাজ দ্রুত শেষ করতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে একাধিকবার চিঠি দেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত এখানে ২৫% কাজ সমাপ্ত। রমজানের পরে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করতে রাজি হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *