মির শাহ আলম আত্মপ্রত্যয়ী এক কর্মবীর

যুক্তরাজ্য সময় সাহিত্য
শেয়ার করুন

“শেষ বেলা” বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, মির শাহ আলাম আত্মপ্রত্যয়ী এক কর্মবীর। উজানে সাঁতার কেটে যুদ্ধজয়ী এক সংগ্রামী মানুষ। কাজ আর সংকল্পের বাস্তবায়নের মধ্যেই খুঁজে নেন জীবনের প্রাপ্তি।

বাংলাদেশ বেতারের পরিচালক (বানিজ্যিক) পদ থেকে অবসরে যাওয়া উপলক্ষে ড. মির শাহ আলমকে নিয়ে লেখা স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ “শেষ বেলা”।

গত সোমবার লন্ডনের নবটেল হোটেলে গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সময় সম্পাদক কবি ও কথাসাহিত্যিক সাঈদ চৌধুরী।

আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ল্যাপারোস্কপিক সার্জন ডাঃ রজত কুমার বিশ্বাস এফসিপিএস। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডাঃ জামিলা আলম এমসিপিএস (গাইনী), হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড (এইচপিএল) বাংলাদেশের প্রডাক্ট ম্যানেজার ড. ফয়সল আহমদ ও রেদওয়ান রহমান, আধুনিক হাসপাতাল সিলেটের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর কয়সর আহমদ প্রমুখ।

বক্তারা মির শাহ আলমের বহুমাত্রিক কর্মকান্ডের ভূয়সী প্রশংসা করে তার মঙ্গল ও দীর্ঘায়ু কামনা করেন।

লেখক সাঈদ চৌধুরীর মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বহু বছর কাজ করার পর কবে অবসরে যাবেন তার জন্য মুখিয়ে থাকেন অনেকে। একটু চাপমুক্ত জীবন, অফুরন্ত অবসরের স্বপ্ন দেখেন চাকরিজীবীরা। শাহ আলম সেরকম মানুষ নন। নিশ্চয়ই তিনি কোন না কোন প্রতিষ্ঠান থেকে অনুরোধ পেয়ে থাকবেন। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়ার মতো মহৎ কাজে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।

শাহ আলম ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ বেতার সিলেটে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। তাঁর বহুমুখী কৌতূহল ও আগ্রহ মানুষকে মুগ্ধ করে। জীবনের প্রয়োজনে, চিন্তা ও মননের বিভায় তিনি যেমন প্রাইভেট শিক্ষকতা করেছেন, তেমনি সক্রিয় ছিলেন আমাদের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে। বেতার ভুবনে অতলস্পর্শী কর্মপরিধি রয়েছে শাহ আলমের। পরিকল্পনা মাফিক কাজ সাজাতে ও হাতে নেয়া কাজ যথাসময় শেষ করতে তিনি সদা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ৯টা থেকে ৫টার রুটিন দায়িত্বে বিশ্বাসী নন শাহ আলম। প্রয়োজনে অফিস সময়ের পর এমনকি সাপ্তাহিক বা সরকারি ছুটির দিনেও তিনি কাজ করেন। কর্ম সম্পাদনে অত্যন্ত সাহসী ও দক্ষ একজন কর্মকর্তা। যত বাধা-বিঘ্নই আসুক না কেন? সর্বদা তাঁর লক্ষ্যে তিনি স্থির ও অবিচল।

সমাজ বিকাশে একজন শাহ আলম সর্বত্র প্রয়োজন। মননশীল কর্মে যেমন রসদীপ্ত, তেমনই জ্ঞানগাম্ভীর্যে সমৃদ্ধ। একাধারে লেখক, সংগঠক, শিক্ষক ও সমাজসেবী। তিনি লিখেছেন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। হয়রত শাহ জালালকে (রহ.) নিয়ে লিখেছেন চমৎকার গবেষণা গ্রন্থ। এসব সৃজনশীল রচনায় তাঁর প্রাজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়।

শাহ আলম বাংলাদেশ সরকারের ৮ম সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় একজন কৃষি অফিসার (বিসিএস ক্যাডার) হিসাবে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে ৯ম বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ১৯৯১ সালে সহকারী পরিচালক হিসাবে বাংলাদেশ বেতার সিলেটে নিযুক্ত হন। ২০০৩ সালে বেতারে আঞ্চলিক পরিচালক হয়ে বরিশালে বদলি হন এবং ২০০৭ সালে আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে আবারো সিলেট ফিরে আসেন।
তিনি বেতারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে বহুমুখি কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। ২০১৪ সালে পরিচালক হিসেবে প্রমোশন পেয়ে শাহ আলম চলে যান ঢাকায়। প্রথমে শিক্ষা তারপর বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সময়ের পরিক্রমায় বাণিজ্যিকের সাথে ট্রাফিক সম্প্রচার কার্যক্রমও তিনি পরিচালনা করেছেন। হাজার হাজার শ্রোতা সমৃদ্ধ ফেসবুক, অনলাইন, ওয়েবসাইট, লাইভ স্টিমিং এবং রেডিও সেটের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানগুলো শ্রোতাদের নিকট পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।

শাহ আলম বললেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলার ধারা বিবরণী শুরু থেকেই সম্প্রচার করে আসছে বাংলাদেশ বেতার। শুধু ক্রিকেটই নয়, ফুটবল সহ দেশের অন্যান্য জাতীয় খেলারও ধারা বিবরণী সম্প্রচার করে থাকে বাংলাদেশ বেতার। আইসিসি ট্রফি জয় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দেশের সব খেলার বল টু বল ধারা বিবরণী সম্প্রচার করেছে বাংলাদেশ বেতার। এখন মোবাইলের মাধ্যমে মানুষ যেকোন স্থান থেকে বাংলাদেশ বেতার শুনতে পায়। বিশেষ করে দেশে এবং বিদেশে শ্রোতারা মোবাইলের মাধ্যমে খেলার ধারা বিবরণী শুনে থাকেন। ক্রিকেট ছাড়াও ফুটবল সহ অন্যান্য খেলা বেতার সম্প্রচার করে থাকে।

মির শাহ আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট, ক্রিকেট বোদ্ধা এবং বাংলাদেশ বেতার যেন একাকার। আমাদের ক্রিকেটারদের যে পরিচয়, ক্রিকেটারদের গর্জন একমাত্র বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমেই আমরা দর্শকদের মাঝে তুলে ধরতে পেরেছি। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচের এক বল এক রান, বল টু বল এভাবেই ধারা বিবরণী করেছে বাংলাদেশ বেতার।

১২টি স্টেশনের মাধ্যমে সারা দেশে পাশাপাশি প্রতিবেশি দেশগুলোতেও ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে শব্দ পৌছে দিতে পারছে বাংলাদেশ বেতার। ফেইসবুকে অডিও লাইভ সম্প্রচার করে থাকে। আগামীতে স্যাটেলাইট এবং অ্যাপসের মাধ্যমে দেশের খেলাধুলা সম্প্রচার করে যাবে বাংলাদেশ বেতার। খেলাধুলার ধারা বিবরণী সম্প্রচারের ফলে যুব সমাজ খেলাধুলার দিকে ঝুকবে।

২০১৮ সালে বাংলাদেশ বেতারের পরিচালক (বানিজ্যিক কার্যক্রম) রোটারিয়ান ড. মির শাহ আলম বিশ্ব বেতার দিবস উপলক্ষে ভারতের ওড়িশা রাজ্যের ভুবনেশ্বরের কল্পনা স্কয়ারে দুদিন ব্যাপি ইন্টারন্যাশনাল রেডিও ফেয়ার অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হন। অনুষ্ঠানের উদ্ধোধন করেন ওড়িশা রাজস্বমন্ত্রী সূর্যনারায়ন পাত্র, বাংলাদেশ বেতারের পরিচালক (বানিজ্যিক কার্যক্রম) রোটারিয়ান ড. মির শাহ আলম, ওড়িশার প্রাক্তন সাংসদ সমীর রঞ্জন পট্রনায়েক ও মেলার আহবায়ক সুব্রত কুমার পতি। মেলায় চীন, আন্তর্জাতিক বেতার (সিআরাআই), ভয়েজ অব আমেরিকা (ভিওএ) সহ আন্তর্জাতিক স্তরের অনেক বেতার প্রতিনিধি অংশ গ্রহণ করেন।

সাউথ এশিয়া রেডিও ক্লাব (সার্ক) বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মির শাহ আলম বেতারের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র নামে এদেশে সর্বপ্রথম স্বল্প পরিসরে বেতারের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর নাজিমুদ্দীন রোডের ভাড়া করা বাড়িতে। ১৯৬০ সালে শাহবাগস্থ কেন্দ্রে বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র স্থানান্তরিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ হিসেবে আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে এই কেন্দ্র আমাদের মহান মুক্তিসংগ্রামে অনন্য ভূমিকা পালন করে। ৩০ জুলাই ১৯৮৩ সালে শাহবাগস্থ সম্প্রচার কেন্দ্রটি জাতীয় বেতার ভবন, শেরেবাংলা নগর, আগারগাঁওয়ে স্থানান্তরিত হয়।

১৯৬১ সালে সিলেট কেন্দ্রে দুই কিলোওয়াট মিডিয়াম-ওয়েভ ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯৬৭ সালে রংপুর ও সিলেট এবং ১৯৭০ সালে খুলনা বেতার কেন্দ্রে ১০ কিলোওয়াট শক্তি সম্পন্ন মিডিয়াম-ওয়েভ ট্রান্সমিটার সংস্থাপিত হয়। আঞ্চলিক বেতার কেন্দ্র দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও লোকজ ধারাকে সংরক্ষণ ও সমুন্নত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতে বেতার অনুষ্ঠানের ধরন ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়। বেতারের অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় জাতীয় উন্নয়ন ইস্যুগুলি গুরুত্ব পেতে থাকে। কৃষি, স্বাস্থ্য ও পরিবার, পল্লি উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, পরিবেশ, প্রকৃতি ও শিশুবিষয়ক অনুষ্ঠান শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জাতির প্রয়োজনে নতুন নতুন অনুষ্ঠান প্রণয়ন ও সম্প্রচারের দায়িত্ব বহুগুণে বেড়ে যায়। পর্যায়ক্রমে বহির্বিশ্ব, ট্রান্সক্রিপশন, কৃষি, বাণিজ্য, মনিটরিং, সঙ্গীত, শিক্ষা, লিয়াজোঁ ও শ্রোতা গবেষণা, বেতার প্রকাশনা, জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি এবং ট্রাফিক সম্প্রচার ইউনিট গঠনের মাধ্যমে সম্প্রচার কর্মকান্ড বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশ বেতার এশিয়া-প্যাসিফিক ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন (এবিইউ), এশিয়া-প্যাসিফিক ইনস্টিটিউট ফর ব্রডকাস্টিং ডেভেলপমেন্ট (এআইবিডি) ও কমনওয়েলথ ব্রডকাস্টিং এসোসিয়েশন (সিবিএ) এর পূর্ণ সদস্য এবং ব্রডকাস্টিং অরগানাইজেশন অব দ্য নন-এলাইন্ড কান্ট্রিজ (বানাক) ও ইসলামিক স্টেটস ব্রডকাস্টিং অরগানাইজেশন-এর সহযোগী সদস্য। বাংলাদেশ বেতার ১৯৮২-২০০৯ সালে মোট ২৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ বেতার সতাধীনতা পুরস্কার লাভ করে।

জনপ্রিয় বেতার ব্যক্তিত্ব মির শাহ আলম একজন সৎ ও মহত মানুষ। যিনি কঠিন পরিস্থিতিতেও সত্যের ওপর অটল থাকেন। ভোগ ও বিলাসিতা তাকে কখনো টানে না। চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সৃজনশীলতা তাঁর জীবনের পাথেয়। সংস্কৃতি ও বিদ্যাচর্চার নানা ক্ষেত্রে তিনি এক সফল উদাহরণ।

মির শাহ আলম ১৯৬২ সালের ১ জানুয়ারী গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মির মনসুর আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা । কর্মজীবনে ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন প্রকৌশলী। তাঁর মায়ের নাম সেতারা বেগম। শাহ আলমের শৈশব কেটেছে আখাউড়া রেলওয়ে কলোনীতে। শিক্ষা জীবন শুরু হয় আখাউড়া, কুমিল্লাতে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে কলেজ শিক্ষা গ্রহণের পর ভর্তি হন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে কৃতিত্ত্বের সাথে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতোকত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে শাহ আলম ১৯৯১ সালের ১৮ জানুয়ারী ডা. জামিলা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পারিবারিক জীবনে তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। পুত্রের নাম জামিল আলম জেবাল ও কন্যার নাম সাতারালুম মানসুরা একুশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *