মিয়ানমারে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে জান্তা!

এশিয়া সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

মাসুম খলিলী

গত দুই সপ্তাহে মিয়ানমারের সামরিক পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ২৭ অক্টোবর, জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির একটি জোট মিয়ানমারের শান রাজ্যের উত্তরে শাসক বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত আক্রমণ শুরু করে বেশ কয়েকটি শহর দখলে নেয়। তারা চীনের গুরুত্বপূর্ণ ওভারল্যান্ড বাণিজ্য রুটগুলি বিচ্ছিন্ন করে এবং কয়েক ডজন সামরিক ফাঁড়ি দখল করে। অপারেশন ১০২৭ নামের এই আক্রমণগুলিতে কয়েক হাজার অভিজ্ঞ, সুসজ্জিত যোদ্ধা একসাথে একাধিক স্থানে অভিযান চালায়। তারা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনীর সামনে যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। সামরিক শাসনের এখনকার দুর্বল অবস্থা দেখে আরও কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী জান্তা বিরোধি লড়াইয়ে শামিল হতে পারে।

অপারেশন ১০২৭ এর নেতৃত্বে রয়েছে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স। অভ্যুত্থানের পরে প্রথম আবির্ভূত হওয়া বেশ কয়েকটি প্রতিরোধ বাহিনীও এই হামলায় অংশ নেয়। তারা যুদ্ধকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ের কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং সামরিক বাহিনী শান রাজ্যে শক্তিবৃদ্ধি করছে। ১৩ নভেম্বর, আরাকান আর্মি এক বছর ধরে চলা অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে পশ্চিমে রাখাইন রাজ্যে নতুন আক্রমণ শুরু করে। এরপর সামরিক বাহিনী অবিলম্বে বিমান হামলা এবং দূরপাল্লার আর্টিলারি ব্যারেজ চালু করলেও এসব এখনও পর্যন্ত অপারেশন ১০২৭ মোকাবেলায় কার্যকর হয়নি৷ তবে, তারা বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটিয়েছে এবং শান-এ প্রায় ৬০ হাজার ও সারা দেশে ২ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত করেছে। জাতিসংঘের মতে, অভ্যুত্থানের পর থেকে বাস্তুচ্যুত বেসামরিক মানুষের মোট সংখ্যা এখন বিশ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

বিভক্ত হবে মিয়ানমার?

মিয়ানমারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ এর মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। দেশটির ৬৮ শতাংশ ভূমির উপর সামরিক জান্তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। জান্তা বিরোধি সশস্ত্র লড়াই ব্যাপকতা পাবার পর থেকে সেনা নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই শহর এলাকায় সীমিত হতে থাকে। এখন একের পর শহরও সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ২ নভেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে, জান্তা নেতা মিন অং হ্লাইং প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করার প্রতিশ্রুতি দেন। প্রাথমিক হামলার প্রায় দুই সপ্তাহ পর, তিনি অভ্যুত্থানের পরবর্তী জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদের প্রথম অনির্ধারিত বৈঠক ডাকেন। এই বৈঠকে জান্তা সরকারের রাষ্ট্রপতি সতর্ক করে দেন যে, মিয়ানমার ভেঙে খন্ড বিখন্ড হয়ে যেতে পারে। এর পর জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে প্রতিশ্রুতি দিয়ে উত্তর শান রাজ্যের আটটি ক্ষতিগ্রস্ত জনপদে সামরিক আইন জারি করে। কিন্তু প্রধান সড়কে বিরোধীদের অতর্কিত হামলা এবং বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ধ্বংসের কারণে সেনাবাহিনীর মোবাইল স্ট্রাইক ডিভিশন মোতায়েন করা যাচ্ছে না।

জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), আরাকান আর্মি (এএ) ও তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির (টিএনএলএ) সমন্বয়ে গঠিত নর্দার্ন অ্যালায়েন্স ব্রাদারহুড উত্তর শান জুড়ে বিশাল এলাকা দখল করে চীনের সাথে সীমান্তে জান্তার প্রবেশ সংযোগ কার্যকরভাবে অবরুদ্ধ করে দেয়। ২৭ অক্টোবর শুরু হওয়া অপারেশন ১০২৭ এর আওতায় জান্তা প্রতিরোধ শক্তি ১৫০ টিরও বেশি সামরিক ফাঁড়ি দখল করেছে। দখলে নেওয়া শহরের এই তালিকা দিন দিন বাড়ছে। নতুন অভিযানে প্রতিরোধ দলগুলোর অব্যাহত অগ্রগতি বিগত ৩২ মাসের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এটি জান্তার পতন সম্ভব করে তুলতে পারে বলে এখন আশা সৃষ্টি হয়েছে।
মিয়ানমারের দেশজুড়ে গৃহযুদ্ধের এক বিস্তৃত ইতিহাস রয়েছে। তবে ২০২১ সাল থেকে যুদ্ধটি যেভাবে চলছে তার সাথে আগের ধারাবাহিকতার পার্থক্য রয়েছে। জান্তার বিরুদ্ধে এখনকার প্রতিরোধ প্রায় সর্বজনীনভাবে ঘৃণ্য কিন্তু গভীরভাবে আবদ্ধ একনায়কত্বের বিরুদ্ধে জনপ্রিয় বিদ্রোহ দ্বারা চালিত। এই প্রতিরোধ যুদ্ধগুলি এখন নতুন গতিপথ পাচ্ছে।

সামরিক বাহিনীর জন্য এখনকার নির্মম সত্যটি হলো তাদের সামনে ভবিষ্যৎ দিন দিন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। জান্তা শাসন অনেক জায়গায় মাত্রার বাইরে প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে আর হারানো এলাকা পুনরুদ্ধার করার অবস্থা আর থাকছে না। ২৭ অক্টোবরের পর থেকে সেনাবাহিনী (তাতবাদাও) কোনো উল্লেখযোগ্য পাল্টা আক্রমণ চালানোর সক্ষমতা হারাতে বসেছে। জান্তা সৈন্যদের এক এলাকা থেকে অন্য অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হলে তারা সেখানে থাকুক বা চলে যাক, তবে কিছু না কিছু হারাতেই হচ্ছে। এ অবস্থায় সেনাদের বাহিনী ত্যাগ একটি নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

নতুন যুদ্ধের সূত্রপাত

যে দলগুলো থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স তৈরি করেছে তারা সবই গত এক দশকে সামরিক বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হুমকি হিসেবে আবির্ভূত। এমএনডিএএ ও টিএনএলএ উভয়ই দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যের উত্তরের বিভিন্ন অংশে আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই করে এসেছে।

এমএনডিএএ বেশিরভাগ জাতিগত হান চীনা সংখ্যালঘু কোকাংদের নিয়ে গঠিত। তারা কোকাং স্ব-শাসিত অঞ্চল হিসাবে পরিচিত চীনা সীমান্তে একটি বিশাল ছিটমহল নিয়ন্ত্রণ করত এবং এর রাজধানী লাউকাইং ছিল অনিয়ন্ত্রিত জুয়া ও অন্যান্য অবৈধ শিল্পের কেন্দ্রস্থল। ২০০৯ সালে যে সমস্ত সশস্ত্র দল যারা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল তাদের অবশ্যই সামরিক কমান্ডের অধীনে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ইউনিটে রূপান্তর করতে হবে মর্মে তৎকালীন সামরিক শাসনের একটি আদেশ মেনে নিতে তারা অস্বীকৃতি জানায়। এ কারণে সামরিক বাহিনী সশস্ত্র গ্রুপটিকে জোন থেকে বহিষ্কার করে এবং এর জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বী কোকাং দল থেকে সীমান্ত রক্ষী নিয়োগ করে।

২০০৯ এর বহিষ্কারের পর থেকে, এমএনডিএএ দূরবর্তী পাহাড়ে গিয়ে বিদ্রোহি হিসাবে জোনের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠিত হয়। তারা ২০১৫ সালে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা নেয়। এ সময় সংঘর্ষে সামরিক বাহিনীতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং ৩০ হাজারেরও বেশি শরণার্থী চীনে পালিয়ে যায়। এখানে এমএনডিএএ ও টিএনএলএ এর ওভারল্যাপিং স্বার্থ রয়েছে, যা তাদের একটি যৌথ অভিযান শুরু করতে উৎসাহিত করে।

এর বিপরীতে, আরকান আর্মির শান রাজ্যে আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই এবং অপারেশনে তারা সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তারপরও দলটির জন্য থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সে অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। এর নেতৃত্ব চীনা সীমান্তের নিকটবর্তী বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত ভূমি থেকে কাজ করে; এই এলাকা থেকে তারা বেশিরভাগ অস্ত্র পায় এবং সেখানে আরকান আর্মির গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে।

ব্রাদারহুড জোট ২৭ অক্টোবর তার প্রাথমিক বিবৃতিতে বলেছে যে উত্তর শানে তার কৌশলগত উদ্দেশ্য ছাড়াও, ‘নিপীড়নমূলক সামরিক একনায়কত্ব নির্মূল করতে, সমগ্র মিয়ানমার জনগণের একটি যৌথ আকাঙ্ক্ষার সাথে’ তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জড়িত তিনটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী তাদের আঞ্চলিক লক্ষ্যগুলি জোরদার করার উপর মনোযোগ দিয়ে দেশের অভ্যুত্থান-পরবর্তী অস্থিরতা থেকে বেশিরভাগ সময়েই নিজেদের দূরে রেখেছিল। এর পরিবর্তন ঘটেছে এখন।

ছবি: ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অন্তর্গত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা উত্তর শান রাজ্যের (দ্য কোকাং) একটি দখলকৃত জান্তা ফাঁড়ি থেকে জব্দ করা একটি সাঁজোয়া যান এবং হাউইটজার নিয়ে পোজ দিচ্ছেন

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

* মাসুম খলিলী সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *