মানবাত্মার পিপাসা ও পরিতৃপ্তি । জাকির আবু জাফর

প্রবন্ধ-কলাম সময় চিন্তা
শেয়ার করুন

আত্মার একটি জগৎ আছে। যাকে বলে- রূহের জগৎ! ইসলামী পরিভাষায় একে বলা হয়- আলমে আরোয়াহ বা আত্মার পৃথিবী! এ পরিভাষায় আলমে আরোয়াহ ছাড়াও আছে আরো তিনটি জগৎ- আলমে দুনিয়া বা পৃথিবীর জগৎ। আলমে বারজাখ বা কবরের জগৎ। আলমে আখেরাহ বা জীবনের চূড়ান্ত ফলাফলের জগৎ।

পৃথিবীতে আসার আগে আলমে আরোয়াহতেই অবস্থান করে সব রূহ বা আত্মা। রূহের জগৎ থেকেই পৃথিবীতে আসে মানুষ। পৃথিবীতে আসার পক্ষে মহান আল্লাহ তায়ালা তার জন্য মাতৃগর্ভে প্রস্তুত করেন একটি রূহ বহনকারী শরীর। যে শরীরে অবস্থান নেয় আত্মাটি।

মজার বিষয় হলো, রূহের জগতে যেসব আত্মা একে অপরের সাথে পরিচিত হয়। কাছাকাছি আসে। পৃথিবীতেও তারা পরিচিত হয়। কাছাকাছি আসে। সম্পর্কিত হয় পরস্পরের সাথে। সম্বন্ধিত হয় একে অন্যের সঙ্গে। নির্মিত হয় সম্বন্ধ-সেতু। সেই সূত্রেই এ পৃথিবীতে সম্পর্ক হালকা হয়। গভীর হয়। মজবুত হয়। দৃঢ় কিংবা ঢিলেঢালা হয়। হয় পরস্পর স্বামী স্ত্রী। মূলত সম্পর্কটি আত্মার সাথে আত্মার। চোখের সাথে চোখের নয়। দেহের সাথে দেহেরও নয়। যা আমরা দেখি মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক হিসেবে।

কেন আত্মার সাথে আত্মার সম্পর্ক হয়? হয়, কারণ পরস্পর পছন্দের ঘ্রাণ যখন নিকটতম হয়। কাছাকাছি হয় আত্মার সাথে আত্মার বৈশিষ্ট্য। মানুষে মানুষে বৈশিষ্ট্যগত মিলঝিলে মূলত কাছাকাছি হয় মানুষ। এখানে দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে খুব। দৃষ্টিভঙ্গিগত মিলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেখার চোখ সবার সমান নয়। একটি ঘটনা একজন একরকম দেখে। অন্যজন দেখে অন্য রকম করে। বিষয় একটি। কিন্তু দু’জন দু’ভাবে গ্রহণ করে তাকে। দেখার এই যে চোখ বা দৃষ্টি এটি সম্পর্ক নির্মাণে কাজ করে। সবচেয়ে বেশি কাজ করে চিন্তার ক্ষেত্রটি। একে চিন্তার উচ্চতাও বলা যেতে পারে। চিন্তার উচ্চতা যদি সমান না হয় তবে সম্পর্ক তেমন করে জমে না। তেমন করে মজবুত হয় না সম্পর্কের বাঁধন। এসব কিছু একাকার করে গ্রহণ করে মানুষের আত্মা।

রূহ বা আত্মার জগৎ আমাদের এই পৃথিবীর কোথাও অবস্থান করে না। পৃথিবীতে এর ঠিকানাও নেই। এ কারণে প্রাণের কোনো অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে হয় না। আধুনিক বিজ্ঞান এ কথার প্রমাণ পেয়েছে স্পষ্ট। পেয়েছে, পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয় না। রূহ বা আত্মা এ পৃথিবীর কোনো বিষয় নয়! এটি অন্য কোনো জায়গার। অন্য কোনো কোণ থেকে আসে। অন্য কোনো আয়োজনে পৃথিবীতে এর অস্তিত্ব। যে আয়োজন হয় না পৃথিবীর কোথাও। অর্থাৎ পৃথিবীর বাইরে থেকেই আসে রূহ বা আত্মা। একইভাবে মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হলেও রূহ বা আত্মা উপরেই চলে যায়। চলে যায় পৃথিবীর সীমানা ছেড়ে ঊর্ধ্বলোকে। মৃত্যুর পরও আত্মা বা রূহের বসবাস পৃথিবীতে হয় না।

বিস্ময়কর সত্যি হলো, মানুষের শরীরে যতক্ষণ আত্মা অবস্থান করে, ততক্ষণই জীবিত সে। যেই না আত্মা উড়াল তোলে অমনি সে মৃত। যার জন্য আত্মা সম্পর্কে আমাদের মৌলিক ক’টি বাক্য বুঝতে হবে গভীরভাবে, আত্মা মহান রবের নির্দেশ মাত্র! আত্মা সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে খুব কম জ্ঞানই দিয়েছেন। আত্মা একটি আধ্যাত্মিক বিষয়, একে জাগতিক বস্তু ধারণ করে মাত্র। এটি একটি আলোঋদ্ধ শক্তি। দেহ শেষ হয়, আত্মার শেষ নেই। দেহ মরে যায়, আত্মা অমর। দেহ সাময়িক, আত্মা চিরকালের। চিরকালের এ আত্মাই মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে ও রাখবে। পরকাল বা আখিরাতের জীবনে পৃথিবীর আত্মাই জীবন্ত হয়ে উঠবে। উঠবে পৃথিবীর শরীর নিয়ে! যাকে বলা হয় পুনরুত্থান দিবস।

একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সব আত্মাই সাধারণভাবে পবিত্র। পবিত্র আত্মাই প্রবেশ করে মানুষের দেহে। মাতৃগর্ভে মানুষ থাকে নিষ্পাপ। আত্মাও থাকে কলুষমুক্ত। আত্মা তখনই অপবিত্র হয় যখন মানুষ একে মন্দ কাজের সঙ্গী করে তোলে। একে পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত করে। ডুবিয়ে দেয় অসুন্দরের ঘোলাজলে।

আত্মার পবিত্রতা নষ্ট করে মানুষ নিজেই। যে কারণে আত্মা পবিত্র ও অপবিত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। পবিত্র-অপবিত্র বিষয়টি কোনো ধারণা নয় শুধু। বরং এটি একটি বাস্তব উপলব্ধি। এ উপলব্ধিও চিরন্তন। পৃথিবীতে মানুষের সূচনা থেকেই এ অনুভ‚তি সচ্ছল। প্রথম মানব হজরত আদম আ: থেকে এর অভিযাত্রা। এ উপলব্ধিই মূলত মানুষ থেকে মানুষকে আলাদা করে তোলে।

আত্মাকে কলুষিত করে কিছু বিষয়। যেসব বিষয় জন্মগতভাবে জুড়ে দেয়া আছে মানুষের সাথে। আত্মাকে পবিত্র করার পক্ষে মানুষকে পরিহার করতে হয় বিষয়গুলো।

কিন্তু লোভের লালায় আত্মা ভিজিয়ে তোলে মানুষ। লালসার জলে সে সাঁতরায় নিত্য। হিংসার আগুনে ঝলসায় অহরহ। বিদ্বেষের দহনে দুঃখ পেতেই থাকে। পরশ্রীকাতরতায় নষ্ট করে নিজের সুখ। সবচেয়ে বড় কথা সুখের লোভে ক্রমাগত দুঃখ খরিদ করে মানুষ। সে লালসার জালে বন্দী হয়। কামনার আগুনে পুড়তে থাকে। তখনই পিয়াসায় কাতর হতে থাকে আত্মা।

এখানে জিজ্ঞাসা জাগতেই পারে, কিসের পিপাসা জাগে আত্মার শরীরে? কিসের তৃষ্ণা জাগে। কেন পিপাসার্থ হতে হবে আত্মাকে? আত্মার কি মুখ আছে, বুক আছে! নাকি আছে পেট! কেন তবে পিপাসায় কাতর হবে সে? না আত্মার পেট নেই। পিঠ নেই। বুক নেই, মুখও নেই। তবুও পিপাসা জাগে আত্মার। তৃষ্ণায় কাতর হয় সে। তবুও শুকিয়ে ওঠে তার ভেতর রাজ্য।

সত্যি হলো মানুষ যখন নিজেকে লালসার পাঁকে বন্দী করে, লোভের জিহবা দীর্ঘ হতে থাকে তখন। তখন হিংসার অনল উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বুকের ভেতর। মনে জ্বলতে থাকে প্রতিহিংসার বারুদ। তখন আত্মার পবিত্রতা নষ্ট হতে থাকে। ধীরে ধীরে হিং¯্র হয়ে ওঠে সে। কঠিন কঠোর হয়ে ওঠে। মমতার স্পর্শ পায় না। প্রেরণার আবহ থাকে না। সত্যের আনন্দও নিভে যায়। ঠিক তখন সে মানুষটি অন্য মানুষকে অকারণ আক্রমণ করে। অপ্রয়োজনে শত্রæ গণ্য করে। সহসা অন্যকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে নেয়। অন্যকে ঠেকিয়ে রাখার আয়োজন করে। অন্যের ক্ষতি চিন্তা করে। উচ্ছেদ কামনা করে। অধিকার লুণ্ঠন করে। দখল করে অন্যের সম্পদ। কোটি নয়, শতকোটি এমনকি হাজার কোটিতেও মেটে না তৃষ্ণার আগুন। বেপরোয়া হয়ে ওঠে সহসা। হিসাবহীন খায় সে। বৃক্ষ খায়। বনজঙ্গল খায়, এমনকি নদীও খেয়ে ফেলে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, এ ধরনের আত্মা মাটি ছাড়া আর কিছুতেই পরিতৃপ্ত হয় না। অর্থাৎ মৃত্যু ছাড়া এদের আত্মা আর কিছুতেই দমে না।

আত্মার এই পিপাসাযুক্ত কোনো ব্যক্তি যদি ক্ষমতার দণ্ড পায় তো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে সব। সে কোনোভাবেই তার প্রতিপক্ষকে দাঁড়াতে দেয় না। তার মতের বাইরে কোনো মতো থাকতে পারে না। আর কারো অবস্থান সহ্য হয় না তার। শুধু তার পক্ষাবলম্বনকারীরাই থাকে তার গুডবুকে। তার অন্ধ অনুসারীরাই পায় তার সুনজর। তার কাছে থাকে না অন্য কারো অধিকার। সব অস্বীকারের ঔদ্ধত্যে উন্মাদনা ছড়ায় সে। এ ক্ষেত্রে কোনো সত্যাসত্য থাকে না তার নীতির খাতায়। জ্ঞানী-গুণী প্রজ্ঞাবানও তার কাছে হয়ে যান নস্যি।

আত্মার পিপাসা যাকে অস্থির করে, তার স্বস্তি মেলে না কোথাও। তার ভেতর গোটা জগৎ পুরে দিলেও অস্থিরতা ছাড়ে না তাকে। তার মনোজগতে তৈরি হয় বিশাল শূন্যতা। এ শূন্যতা পূরণের লোয়াজিমা কোনো কিছুতেই পূর্ণতা পায় না। সে হয় আত্ম-অহঙ্কারী! আত্মম্ভরিতায় হয় ঔদ্ধত্য। আত্মপ্রীতি অন্ধ করে তোলে তাকে। নিজের গান গেয়ে সুখ পায় সে। আত্মপ্রকাশে ভীষণ মরিয়া। তার ভেতর থেকে নিভে যায় আত্মসম্মান বোধ। তখন সে কথা বললে মিথ্যা বলে। কাজ করলে অন্যায় করে। ক্রমাগত সত্য অস্বীকার করে। যা করে তা বলে না। যা বলে তা করে না। ঘটে একটি। বলে তার বিপরীত। ঘটায় নিজে। দোষ চড়ায় অন্যের ঘাড়ে। কারো অবদান স্বীকার করে না। সব কৃতিত্ব একজনের হয়ে ওঠে। নিজের ছায়া ছাড়া আর কারো ছায়াও স্বীকার করতে চায় না। এমন অবস্থায় যদি কেউ ক্ষমতায় নিরঙ্কুশ হয়! তো ক্ষমতাই তাকে উন্মাদ করে তোলে। তখন হিতাহিত জ্ঞানও ক্ষয়ে যায় তার। কোনো বাক্যে আর লাগাম থাকে না তার। সর্বত্র সীমা লঙ্ঘনের ঢেউ উত্তাল করে তাকে।

তখনই আত্মার পিপাসা মানুষকে এক রোখা করে তোলে। একজন শাসককে স্বৈরাচারে পরিণত করে। তার মতের বিরুদ্ধে উত্তোলিত থাকে ঘৃণার তরবারি। তবে তার তল্পিবাহক হলে চৌদ্দ ক্ষুণ মাপ।

এখন প্রশ্ন হলো আত্মার পরিতৃপ্তি কী? কী প্রভাব বিস্তার করে পরিতৃপ্ত আত্মা? কেমন করে পরিতৃপ্ত হয় সে। এখানেও দৃষ্টিভঙ্গিটি গুরুত্বপূর্ণ। কী চান তিনি! কিভাবে চান! কেন চান! এসব জিজ্ঞাসাও জাগে। তিনি চান মানুষের কল্যাণ। চান পরোপকার। চান, ভালো থাক সবাই। তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন ন্যায়বিচার ও ইনসাফকে। অন্যের দুঃখ কষ্ট নিজের করে অনুভব করেন তিনি। অন্যের সুখে সুখী হন। অন্যের সাফল্যে হেসে ওঠেন। সাধ্যমতো উপকার করেন সবার। না হলে অন্তত ক্ষতি করেন না কারো। তার দৃষ্টি স্বচ্ছতায় উদ্ভাসিত। মন পরিচ্ছন্নতায় উন্নত। উদারতায় আকাশস্পর্শী। খ্যাতির পিছু ছোটেন না তিনি। লোকদেখানো কাজ থেকে দূরে থাকেন। কামনা, বাসনা ও লালসার তেজে কাজ করেন না। কাজটি করেন প্রয়োজনে। করেন দায়িত্ববোধ থেকে। পৃথিবীর জাঁকজমক স্পর্শ করে না তাকে। দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখেন তিনি। আমানত রক্ষা তার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের মান সম্মান রক্ষা করেন তিনি। ব্যক্তিগত সুখ দুঃখের ঊর্ধ্বে তার অবস্থান। তার মুখ থাকে উজ্জ্বল। ঠোঁটের কোণে থাকে মুচকি হাসির রেষ। তিনি ধীরস্থির। ধৈর্যের হাত ধরে চলেন। চেহারায় থাকে না দুশ্চিন্তার ছাপ। চোখ দু’টি জীবনের দিকে উন্মুক্ত। কোনো কিছু তার কাছে সত্যের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে না। কোনো মানুষের তুষ্টির পক্ষে কাজ করেন না তিনি। নিজেকে লুকান না। বরং তিনি হয়ে ওঠেন খোলা বই। যে কেউ তাকে পাঠ করার সুযোগ পান সহজে। তার গভীর থেকে বেড়ে ওঠে পরিতৃপ্তির শ্বাস। এই তো আত্মার পরিপূর্ণতা! এই তো আত্মার পরিতৃপ্তি! অনেক সম্পদের মালিক ধনী নন। প্রকৃত ধনী হলো পরিতৃপ্ত আত্মার মানুষ। যার সম্পদ নেই তিনি গরিব নন। প্রকৃত গরিব সে যার আত্মায় হাহাকার থাকে সম্পদের। আরো চাই আরো চাই করে লম্বা হয়ে ওঠে লোভ। রাসূল সা:-এর একটি বাণী, তোমাদের যাত্রা পরকালের দিকে। অথচ মুখ হলো পৃথিবীর দিকে।

সাদা কথায়, পৃথিবীর দিকে মুখ হলে আত্মা পিপাসায় কাতর হবেই। আর যদি মুখ থাকে পরকালের দিকে সে আত্মা হবে পরিতৃপ্ত।

লেখক : কবি, কথাশিল্পী, শিশু সাহিত্যিক ও গীতিকার E-mail : zakirabuzafar71@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *