ভেনামি চিংড়ির মাধ্যমে বৈশ্বিক ব্যবসায় নতুন মাত্রা লাভ করেছে সীমার্ক গ্রুপ

অর্থনীতি বাংলাদেশ যুক্তরাজ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

উচ্চফলনশীল ভেনামি চিংড়ির চাষ বাংলাদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। উপকূলবর্তী এলাকায় দুই লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে এখন চিংড়ি চাষ হয়। ‘হোয়াইটলেগ শ্রিম্প’বা সাদা পায়ের চিংড়ি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উচ্চ উৎপাদনের ফলে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এটি পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের চিংড়ি প্রজাতি। অধিক উৎপাদন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য এই প্রজাতির মাছের চাহিদা বিশ্বব্যাপী দিন দিন বেড়ে চলেছে।

উন্নত বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ চাহিদা পুরণ করছে ভেনামি চিংড়ি। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, একুয়েডর, মেক্সিকো ইত্যাদি দেশে ভেনামি চিংড়ির চাষ রাষ্ট্রীয়ভাবে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। বাংলাদেশে ভেনামির পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয় ২০১৯ সালে। সাধারণত সনাতন পদ্ধতিতে হেক্টরপ্রতি ৪/৫ শত কেজি বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হয়, সেক্ষেত্রে ভেনামি চিংড়ি হেক্টরপ্রতি হয় ৮ থেকে ১০ হাজার কেজি।

ব্রিটিশ বাংলাদেশি শীর্ষ ব্যবসায়ী ও সীমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান ইকবাল আহমদ ওবিই জানালেন, সীমার্ক গ্রুপ বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি চাষের জন্য প্রথম নিবন্ধন লাভ করে। এ জাতীয় চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে তাদের অত্যাধুনিক এবং নান্দনিক প্রয়াস সুধী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পানি ও বর্জ্য শোধন, বায়ু সঞ্চালন ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় তারা উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করছেন। খাদ্য প্রয়োগ এবং রোগের তথ্য সংরক্ষণেও সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়।

সীমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান আরো বললেন, কিং প্রন্স, বাগদা চিংড়ি এবং ভেনামি চিংড়ি আমরাই প্রথম ইউরোপের বাজারে নিয়ে এসেছি। গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। নিজস্ব ট্রলার, কারখানা, প্রক্রিয়াজাত করণ এবং অত্যাধুনিক কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা থাকায়, উৎস থেকে সরবরাহ পর্যন্ত নিখুতভাবে সেবা নিশ্চিত করতে আমাদের কোন অসুবিধা হয়না। পর্যাপ্ত পরিমান রেফ্রিজারেটেড গাড়ি থাকায় ২৪ ঘন্টার মধ্যে ইউরোপের কেন্দ্রীয় স্তরে পণ্য সরবরাহ করতে কোন রকম ব্যত্যয় ঘটেনি।

ইকবাল আহমদ ওবিই দৃঢ়তার সাথে জানান, এ ধরণের উচ্চফলনশীল ভেনামি চিংড়ি চাষ দেশের চাহিদা পুরনের পাশাপাশি রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বড় ধরণের ভূমিকা পালন করবে। এজন্য বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষের জন্য বায়োসিকিউরিটি-সহ ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। গ্রাহকদের সর্বোচ্চ মানের পণ্য নিশ্চিত করা হয়। এভাবে সীমার্ক তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং দক্ষতার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বিশাল বাজার তৈরী করেছে।

বাংলাদেশের চট্টগ্রামে এই কোম্পানির ১ লাখ বর্গফুট প্রসেসিং প্ল্যান্টে দৈনিক ১০০ টন সামুদ্রিক খাবার উৎপাদিত হয়। সীমার্ক সামগ্রিকভাবে প্রতি ঘন্টায় এক মিলিয়ন চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত করে।

ইকবাল আহমদ ওবিই ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশে হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছেন। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দূর প্রাচ্যে সীমার্ক গ্রুপের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক দিন দিন আরো ব্যাপকতা লাভ করেছে। সামুদ্রিক খাবার প্রবর্তনের মাধ্যমে নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরী করছে। সীমার্ক ইউরোপের অন্যতম প্রধান প্রসেসর, রপ্তানিকারক এবং হিমায়িত খাবারের পরিবেশক। বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি আমদানি করে প্রক্রিয়াজাতকরণের পর সেই চিংড়ি ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।

হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলে বিবেচিত সীমার্ক গ্রুপের কিংপ্রন বিশ্বজুড়ে এখন আকর্ষণীয় নাম। মেট্রো, ম্যাক্রো এবং ব্রেক ব্রোসের মতো বড় মাপের অপারেটরদের পাশাপাশি অন্যান্য সুপারমার্কেট এবং ফুড সার্ভিস গ্রুপ-সহ গ্রাহকদের সাথে সারা বিশ্বে সিমার্কের পণ্যগুলির অতুলনীয় খ্যাতি রয়েছে। এসবপণ্য উল্লেখযোগ্য এয়ারলাইন্স, হোটেল এবং রেস্তোরাঁয় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

সীমার্ক গ্রুপের আমদানি, উত্পাদন এবং রপ্তানির বিস্তৃতি ঘটছে। ব্ল্যাক টাইগার এবং ভেনামি চিংড়ি, মিঠা পানির রাজা চিংড়ি, পাঙ্গাসিয়াস ফিলেটস, তেলাপিয়া, সিবাস, স্কুইড এবং কাটলফিশের মতো মানসম্পন্ন সামুদ্রিক খাবারের চাহিদা বেড়েছে। সব ধরনের চিংড়ি এবং মিঠা পানির মাছের জন্য বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সীমার্ক গ্রুপ খ্যাতি লাভ করেছে। পেস্ট্রি এবং বেকারি পণ্য-সহ খাদ্য পরিষেবা শিল্পের জন্য কাঁচা মুরগির চাহিদা পুরণে তারা নতুনত্ব এনেছেন।

ইউরোপের বৃহত্তম সুপারমার্কেট, পাইকারী বিক্রেতা এবং খাদ্য পরিষেবা সংস্থাগুলির বিশাল আড়ত জুড়ে সীমার্ক গ্রুপের সাপ্লাই চেইন নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। ঐতিহ্যবাহী সামুদ্রিক খাবার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের মাছ, পোল্ট্রি, শুকনো খাবার-সহ ফুড মার্কেটের ১ হাজারের অধিক আইটেম নিয়ে গর্ব করার মত স্তরে পৌছেছে।

বাংলাদেশের পন্য বিশ্ববাজারের পৌছে দেয়ার ক্ষেত্রে ইকবাল আহমদ ওবিই’র সীমার্ক গ্রুপ সাফল্যের নতুন দিগন্তে পৌছেছে এবং বৈশ্বিক ব্যবসায় নতুন মাত্রা লাভ করেছে। ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান ১৯৭৬ সালে যাত্রা শুরু করে ১৯৯৮ সালে ‘কুইনস অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সপোর্ট’ লাভ করে। এর পর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

ইকবাল আহমদ ওবিই ২০১৪ সালে ব্রিটেনের রপ্তানিতে অবদান রাখায় দেশটির বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি বিষয়ক সরকারি তদারকি সংস্থা ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্ট’ সম্মাননা লাভ করেন। ব্রিটেনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় রপ্তানির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখায় একদল ব্রিটিশ ব্যবসায়ী-সহ তিনি ‘ইউকেটিআই এক্সপোর্ট চ্যাম্পিয়ন-২০১৫’ পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯৯ সালে তিনি লাভ করেন এশিয়ান বিজনেস অ্যাওয়ার্ড। সেবছর ইউরোপের ব্যবসা জগতের সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস পুরস্কার অর্জন করে সীমার্ক। ২০০১ সালে ইকবাল আহমদ ব্রিটেনের রানী কর্তৃক ওবিই (অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার) উপাধি লাভ করেছেন।

সীমার্ক বাংলাদেশে পরপর ৩ বছর সমুদ্র খাবার রপ্তানিতে শীর্ষস্থানে অবস্থান করে। এরপর ইকবাল আহমদ ওবিই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সম্মানজনক জাতীয় রপ্তানি ট্রফি (গোল্ড) লাভ করেন। ২০১২ সালে তিনি জিতে নেন আন্তর্জাতিক সেরা ব্যবসায়ী পুরস্কার। প্রায় ৫০টি দেশের ১৪০টি শহরের সাড়ে ছয় হাজার ব্যবসায়ী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।

ইকবাল আহমদ ওবিই এক যুগ আগে প্রভাবশালী দৈনিক সানডে টাইমসের তালিকায় ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে আলোচনায় উঠে আসেন। একই সাথে বৃটেনের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় স্থান লাভ করেন।

সীমার্ক গ্রুপে রয়েছে ম্যানচেস্টারের অন্যতম সেরা রেস্তোরাঁ ভারমিলিয়ন, ইবকো এন্টারপ্রাইজ, ইবকো ফুড ইন্ডাস্ট্রি, সীমার্ক ইউএসএ, যুক্তরাজ্যের অন্যতম সফল হিমায়িত খাদ্য সরবরাহকারী ইবকো লিমিটেড, ছোট থেকে মাঝারি আকারের ব্যবসার জন্য ম্যানচেস্টার এবং লন্ডনে অবস্থিত জনপ্রিয় পাইকারি আউটলেট ‘রেস্টুরেন্ট হোলসেল।

এছাড়া রয়েছে নিবন্ধিত অলাভজনক আন্তর্জাতিক ত্রাণ ও উন্নয়ন সংস্থা ইকবাল ব্রাদার্স ফাউন্ডেশন, যেটি বাসস্তান, দাতব্য স্বাস্থ্যসেবা, স্যানিটেশন এবং শিক্ষার উন্নয়নে সক্রিয় রয়েছে। ইকবাল আহমদ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে শিশুদের নিয়ে কাজ করার জন্য ম্যানচেস্টার শহর থেকে ‘লিজেন্ডস অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন ইকবাল আহমদ ওবিই।

ক্রমাগত উন্নতির জন্য সীমার্ক টেকনিক্যাল টিমে প্রতিনিয়ত যোগ্য ও মেধাবী লোকবল বাড়াচ্ছে। ব্যবসা ও সেবা ক্ষেত্রে ক্রমাগত শ্রেষ্ঠত্বের দিকে ধাবমান সীমার্ক গ্রুপ পণ্যের নিরাপত্তা, গুণমান এবং গ্রাহক পরিষেবার জন্য সর্বোচ্চ সুবিধা প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

* সাঈদ চৌধুরী সময় সম্পাদক, কবি ও কথা সাহিত্যিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *