ভালোবাসা আর ঘৃণা কখনও এক নয় ।। জাকির আবু জাফর

প্রবন্ধ-কলাম শিল্প-সংস্কৃতি
শেয়ার করুন

পৃথিবীতে কেউ কি থাকে চিরদিন! না, থাকে না। থাকার কোনো সুযোগই নেই। কেনো নেই? কারণ মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্ট জগতে কাউকে চিরকাল রাখবেন না, এটিই তাঁর কৌশল। এটিই তাঁর সৃষ্টি-ধারা। এই ধারা ঠিক করেই সৃষ্টি করেছেন তিনি। সেই ধারার অমোঘ নীতি- জন্মালেই মরতে হবে। এবং মরতেই হবে। পৃথিবীতে জন্মের পর যে জিনিসটি নিশ্চিত করে তা হলো- মৃত্যু! আর কিছু হোক না হোক মৃত্যু যে হবে এতে সন্দেহের অবকাশও নেই।

আবার মৃত্যুটিও মহান স্রষ্টার নির্দেশ ক্রমেই ঘটে। তাঁরই নির্ধারিত সময়ে ঘটবে। এর অন্যথা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। থাকে না। থাকছেও না। পৃথিবীর আদি থেকে একটিই নিয়ম জন্ম মৃত্যুর! কখনও কোনোক্রমে কোনো কালে এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি। ঘটবেও না এটিও বলা যায় হলফ করে।

এর সাদা অর্থ দাড়ায়- পৃথিবীর আলোর উৎসবে যে-ই আসুক তাকে ছাড়তেই হবে এ আলো হাওয়ার ধরণী। এটিই সৃষ্টির সূচনা থেকে সমাপ্তির নীতি। জগতে ক্ষমতার নীতিও তা-ই। পদ পদবীও একই নীতির স্রোতে বেগবান। যৌবনকালও তেমনই! আজ আছে কাল নেই- এমনই নীতির খেলা খেলছে পৃথিবী।

আসলেই যেতে হয়, এবং যেতেই হয়। যেতে হবেই। এ আর খুব করে বোঝানোর দরকার হয় তো নেই। সব প্রাণীকেই মৃত্যুর ছোবল ছিনিয়ে নেয় পৃথিবীর বুক থেকে। মাটির ওপরে বুক চেতিয়ে হাটে যারা একদিন মাটি উঠে পড়ে তাদের বুকের ওপর। পায়ের নীচের মাটিতে কত দম্ভ চলে। সেই মাটিই একদিন নিজের পেটে টেনে নেয় মানুষের সমস্ত শরীর!

কে থাকে পৃথিবীতে চিরকাল! ছিলো কি কেউ! কিংবা কেউকি আছে সেই প্রাচীন থেকে আজ তক! আজ যারা দুনিয়ার বুকের ওপর ঘুরে বেড়ায়, বেড়াচ্ছে। একশ বছর পর কেউকি থাকবে বিচরণশীল! না থাকবে না। কেউ না! তবুও কত স্বপ্ন সাজায় মানুষ। কত স্বপ্ন ওড়ায় আকাশে বাতাসে। কত আশা রুয়ে দেয় জীবনের মৃত্তিকায়। তবুও মানুষের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ে লোভের জিহবা। লকলক করে লালসার জিব। নিজেরটা তো বটেই, দখল করে অন্যেরটাও। ন্যায় অন্যায় বিচার করে না। করার বিবেকও নিভে যায়। পাও তো লও! লও তো খাও। খাও তো ভরো! এই তো কাহিনি। যতো আসুক ততই- এমনই নীতি হয়ে ওঠে কারো কারো জীবনে।

এক বাড়ি আছে তো আরেক বাড়ি গড়ো। দেশে হলো তো বিদেশে বানাও! এক দেশে হলো তো আরেক দেশে দরকার। একটি গাড়ি হলে আরেকটি দরকার! আরেকটি হলো তো ছেলে মেয়ের আলাদা আলাদা প্রয়োজন! এক মডেল পুরনো হলে নতুন মডেল চাই। নতুন মডেল হলে আরও দামী মডেল চাই। তারপর সবচেয়ে দামীটাই প্রয়োজন। তারপর এমন দরকার যা সবার উপরে।

কেনো এমন হয়? হয় লালসার ভয়াবহতা থেকে। হয় লাগামহীন লোভের তৃষ্ণা থেকে। হয় সীমাহীন ভোগের পিপাসা থেকে। লোভের ভয়ংকর দিক উন্মোচিত হয় মহানবী হযরত মুহাম্মদ স এর বাণীতে । তিনি বলেছেন – লোভী লোকের উদাহরণ এমনই – একটি স্বর্ণের পাহাড়ও যদি পায় সে, ঠিক তার পাশে পেতে চাইবে আরও একটি স্বর্ণের পাহাড়! কী বিস্ময়কর এ বাণী! এর সোজাসাপটা অর্থ দাড়ায়- মানুষের লোভ কখনও নিবৃত্ত হয় না। কখনও কমে না। কখনও ভাটা পড়ে না। পড়তে পারে না, যদি তা লাগামহীন হয়!

লোভহীনতা এবং ভোগের লাগাম ছাড়া মানুষ যথার্থ মানুষ থাকে না। এর উজ্জ্বল উদাহরণও নেয়া যায় মহানবীর জীবনের অনেক অনেক ঘটনা থেকে। একটি চমৎকার উদাহরণ উল্লেখ করা যাক- একদিন মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. তাঁর সাহাবিদের উপদেশ দিচ্ছিলেন। এমন সময় গ্রাম থেকে একজন বেদুইন এলেন। তিনি মহানবীকে জিজ্ঞেস করলেন – আমি ধনী হতে চাই, কেমন করে হবো? জবাব দিলেন রাসুল স। বললেন- তুমি অল্পে তুষ্ট থাকো ধনী হতে পারবে!

কি বিস্ময়কর বাণী! কি বিস্ময়কর কথা! এর অর্থ কি দাড়ায়? দাড়ায় ধনী হওয়ার বিষয়টি সম্পদের আধিক্যের ওপর নির্ভরশীল নয়! বরং মনের পরিতৃপ্তির ওপর নির্ভরশীল! শ্রম ঘামে যা পাও তাতেই সন্তুষ্ট থাকো। মনের এ সন্তুষ্টিই।

মহানবীর আরও একটি উপমা নেয়া যাক। তিনি একবার তাঁর সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করলেন- সবচেয়ে ধনী বা সম্পদশালী কে? সাধারণ জবাব তো সবাই জানে- যার সম্পদ বেশি সে-ই ধনী। কিন্তু এই সাধারণ জবাবের জন্য কি মহানবী এ প্রশ্ন করবেন! না! মোটেই না। যে কারণে সঙ্গীরা জবাব দিলেন- আল্লাহ আর আল্লাহর রাসুল ভালো জানেন। মহানবী স. বললেন- মনের দিক থেকে যিনি ধনী তিনিই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী বা সম্পদশালী! এর অর্থ এটিই- সম্পদশালী হওয়ার বিষয়টি জাগতিক সম্পদের পরিমাণের সঙ্গে জড়িত নয়। বরং মনের পরিতৃপ্তির সাথে জড়ানো। মনের সন্তুষ্টির সঙ্গে সাঁটানো।

এ ক্ষেত্রে আরও একটি উদাহরণ নিতে পারি। সব নবীদের মধ্যে উঁচু মর্যাদার একজন নবী হযরত মুসা আ.। তাঁর সাথে কথা বলতেন মহান রব! একদিন মানুষের জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে কথা বললেন আল্লাহ তায়ালা। তার একটি হলো – মানুষ ধনী হতে চায়। আমিও মানুষকে ধনী করতে চাই। কিন্ত আমি ধনী হওয়াকে রেখেছি অল্পে তুষ্টির মধ্যে। অথচ মানুষ তা সম্পদের প্রাচুর্যের মধ্যে খুঁজে বেড়ায়! আমি কী করে ধনী করবো মানুষকে! কি বিস্ময়কর কথা!

মানুষ কি ভাবে তেমন করে! ভাবতে পারে কি! কিংবা ভাবার মতো মন আছে কি! মানুষ কি সেই চরিত্রের হতে পেরেছে! নাকি পারে। হ্যা কেউ কেউ হয়েছেন তেমন মানুষ! কেউ কেউ হতে চাইছেন। হচ্ছেনও। কিন্তু সংখ্যায় নিতান্ত নগন্য।

তবে? তবে আর কি! সিংহভাগ মানুষই লোভের রাজ্যে বলিষ্ঠ। অন্যায়ের পথে বীর। লালসার ঘোরে অস্থির! ভোগও প্রতিশোধের ভয়াবহ অঙ্গার বুকে পুরে ছুটছে আর ছুটছে। এখন প্রশ্ন হতে পারে- মানুষের সবচেয়ে বড় লোভ কি? মানুষের সবচেয়ে বড় লোভ হলো- ক্ষমতা এবং সম্পদ। ক্ষমতা পেলে ছাড়তেই চায় না। একটু পেলে আরেকটু চায়। আরও পেলে আরও চায়! সম্পদও তেমনই। যত পায় তত চায়। যত চায় তত বাড়ে চাওয়ার তৃষ্ণা।
তবে ক্ষমতার লোভ সম্পদকে ছাপিয়ে ওঠে। কারণ ক্ষমতা থাকলে সম্পদের অভাব হয় না। ক্ষমতার চুম্বক সম্পদকে টানতে থাকে। ক্ষমতা বাড়তে থাকে আর সম্পদের পাহাড়ও জমতে থাকে।

এভাবে ক্ষমতা যখন বেপরোয়া হয়ে ওঠে তখন লোভও ছাড়িয়ে যায় সকল সীমানা। তখন দুচার দশ লক্ষ টাকায় মন ভরে না। তখন কোটি কোটি চায়। কোটি কোটি হয়ে গেলে তখন মিলিয়ন দরকার। মিলিয়ন হলেই তো বিলিয়ন ট্রিলিয় চাই। তখন আর টাকায় পোষায় না। ডলার দরকার।

তো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার যখন হস্তগত হয়, তখন ক্ষমতা তো দীর্ঘ করাই যায়। লাজ লজ্জায় কাজ কি তখন! তখন শুধু আঁকড়ে থাকার প্রবল ইচ্ছে প্রয়োজন। সে ইচ্ছে হোক যতটা নির্মম! যতটা রক্তাক্ত! যতটা খুন খারাবির! তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। সবার উপরে ক্ষমতা সত্য তাহার ওপর নেই! এমনই মানসিক অসুস্থতা ভর করে। তখন সত্য বলার দরকার পড়ে না। তখন নীতি নৈতিকতার ধার ধারার প্রয়োজনও নেই। তখন মিথ্যা চমৎকার করে বলা যায়! ঠিক মিথ্যাই সত্য হয়ে প্রচার পায়। মিডিয়ার মুখও তখন মিথ্যাকে সত্য বলে উচ্চকণ্ঠ হয়। নিরপরাধ মানুষ হয় বড্ড অপরাধী। যারা অপরাধী সমাজে তারাই চলতে থাকে বুক ফুলিয়ে। অতি ক্ষমতা এবং অতি সম্পদ মানুষকে মানুষ থাকতে দেয় না। মানুষ তখন শ্রেফ অমানুষ হয়ে ওঠে। মানুষের চেহারা তখন কেবলই মুখোশ! এমন মুখোশের আড়ালের লোকটি হায়নাকে হার মানায় কখনও কখনও। তখন ক্ষমতাবান নিজেকে অতি মানব ভাবতে থাকে। নিজেকে ভাবতে থাকে ক্ষমতার স্বামী। ভাবতে থাকে দেশের মালিক। সমস্ত নাগরিক তার নিন্মমানের প্রজা।

নিজেকে ভাবে ন্যায় অন্যায়ের উর্ধে। আইন বিধান কিছুই তাকে ছু্ঁতে পারে না। তার দিক থেকে গুটে যায় বিচারের হাত। কিন্তু মানুষ ভাবে না- বিচারের হাত গুটে গেলেও একদিন মৃত্যুর হাত স্পর্শ করবে তাকে। সে হাত বড় হিম! বড্ড শীতল! সে হাত স্পর্শ করলেই ক্ষমতার দম্ভ নিঃশেষ হবে নিমিষেই। অসীম ক্ষমতার ধারক দুটি হাত নিথর পড়ে থাকবে দুপাশে। শক্তির উন্মাদনায় জ্বলন্ত চোখ দুটি নিভে যাবে সহসা। পাথর হয়ে যাবে চোখের মণি। অঢেল সম্পদ আর ক্ষমতার দণ্ড কোনো কাজেই আসবে না। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পদ বাড়ি গাড়ি রেখে শূন্য হাতে ঢুকে যাবে মাটির নীচে। তখন মাটিই বিদ্রুপ করে বলবে- কি হে পৃথিবীর মহা ক্ষমতাধর ! কি নিয়ে এলে আমার এই অন্ধকার ঘরে! দেখছি তো মানুষের ঘৃণার পাহাড়! দেখছি অবৈধ সম্পদের দুর্গন্ধ! দেখছি মানুষের ওপর জুলুমের বিভৎসতা!

হায় মানুষ বোঝে না জীবনের মানে! জীবন তো অতি পবিত্র এক সৃষ্টি। এর মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব মানুষেরই। অথচ কেনো যেনো মানুষ নিজেকে নিজেই অপমান করে। নিজেকে নিজেই ঘৃণার পাত্র বানায়। মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার মতো আনন্দ কি থাকে জীবনে। মানুষ যখন মানুষ হয় তার মর্যাদা আকাশ সম। শুধু লোভ এবং লালসা মানুষকে আকাশ থেকে নামায় পাতালের গহ্বরে।

জগতে সবকিছুর শেষ আছে। হোক ভালো, হোক মন্দ। অশেষ কিছু নয়। অসীমও নয়। সবচেয়ে ভালো প্রণটিকেও স্পর্শ করবে মৃত্যু। সবচেয়ে খারাপটিকেও। আর মৃত্যু তো জীবনকে নিঃশেষ করে না। নিঃশেষ করতে পারে না। বরং মৃত্যু জীবনের অনন্ত সময়ের দরোজা খুলে দেয় মাত্র। সেই অনন্ত সময়ের শাসনে মানুষের দুহাত যা কুড়ায় তার সব বোঝা বহন করতে হবে তাকে। ভালোর পরিণাম ভালো। মন্দের পরিণাম কেবলই মন্দই।

পৃথিবীর কোনো ক্ষমতার দাঁত আঁচড় কাটতে সাহস হবে না। তখন আফসোসে নিজের হাত চিবিয়ে খাবে নিজেই।
হে পৃথিবীর ক্ষমতাধর মানুষ! নিজেকে জিজ্ঞেস করো একবার- কি নিয়ে ফিরছো তোমার চিরদিনের ঠিকানায়!
হ্যা যদি সেই চিরদিনের প্রতি অবিশ্বাসী হও! হও। কিন্তু তবুও মনে রেখো- ভালোবাসা আর ঘৃণা কখনও এক নয়!

* জাকির আবু জাফর কবি, গীতিকার ও আবৃত্তিকার। সাহিত্য সম্পাদক দৈনিক নয়াদিগন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *