বিবিসির মোদী তথ্যচিত্র : মুখোমুখি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও সরকার

আন্তর্জাতিক সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

শুভজ্যোতি ঘোষ, বিবিসি নিউজ বাংলা, দিল্লি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে তৈরি বিবিসির তথ্যচিত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে আনা দুটি মামলা সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট শুনতে রাজি হওয়ার পর মামলাকারীরা সরকারের তীব্র আক্রমণের মুখে পড়েছেন।

আজ (সোমবার) সকালেই সুপ্রিম কোর্ট জানায়, দেশের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি বেঞ্চে আগামী সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) এই মামলাগুলোর শুনানি হবে।

এর মাত্র কয়েকঘন্টার মধ্যেই ভারতের আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু টুইট করেন, পিটিশনাররা আদালতের মূল্যবান সময় ‘অপচয়’ করছেন।

তিনি লেখেন, “এভাবেই এরা মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের মহামূল্যবান সময় বরবাদ করছেন, অথচ দেশের হাজার হাজার নাগরিক বিচারের জন্য অপেক্ষা করছেন, শুনানির জন্য তারিখ পাচ্ছেন না।”

সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে কিছু না-লিখলেও দেশের শীর্ষ আদালতকেও যে তিনি নিশানা করতে ছাড়েননি, আইনমন্ত্রীর বক্তব্যেই তা স্পষ্ট হয়ে গেছে।

আইনমন্ত্রীর টুইট থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এই মামলাগুলোকে সুপ্রিম কোর্ট যে সরাসরি খারিজ না-করে শুনানির জন্য গ্রহণ করেছে তাতে সরকার একেবারেই খুশি নয়।

এর আগে সরকার যেভাবে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের একটি ইমার্জেন্সি ধারা প্রয়োগ করে ইউটিউব ও টুইটারে বিবিসির ডকুমেন্টারিটি ব্লক করেছে, তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হন আইনজীবী এম এল শর্মা ও সি ইউ সিং।

তাদের জনস্বার্থ মামলায় ওই আইনজীবীরা বলেন, সরকারের আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞা ‘দুরভিসন্ধিপূর্ণ, স্বেচ্ছাচারী ও অসাংবিধানিক’।

এর পাশাপাশি সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে আর একটি আলাদা পিটিশন দাখিল করেন ভারতের বর্ষীয়ান সাংবাদিক এন রাম, অ্যাক্টিভিস্ট-আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ এবং বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি মহুয়া মৈত্র।

এই দুটো মামলাই একত্র করে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপিত পি এস নরসিমহা ও বিচারপতি জে বি পারডিওয়ালাকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চে আগামী সপ্তাহে শুনানি শুরু হবে বলে আজ ঘোষণা করা হয়।

আইনজীবী সি ইউ সিং তার আবেদনে বলেন, সরকার বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিবিসির ওই তথ্যচিত্রের লিঙ্ক সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্লক করে দিয়েছে, কিন্তু সেই নির্দেশের প্রতিলিপি আজ পর্যন্ত প্রকাশ্যে আনেনি।

সাংবাদিক এন রাম বা সংবিধান বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত ভূষণের টুইট সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং আজমিরে এই তথ্যচিত্র দেখানোর জন্য কলেজের ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

তাদের করা জনস্বার্থ মামলাটিতে সুপ্রিম কোর্টকে বিবিসির তথ্যচিত্রটি খতিয়ে দেখে ২০০২ গুজরাট দাঙ্গার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যও দাবি জানানো হয়।

অপর আবেদনকারী এম এল শর্মা প্রশ্ন তোলেন, সংবিধানের ৩৫২ ধারা প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপতি দেশে কোনও জরুরি অবস্থা জারি করেননি, তার পরেও কেন্দ্রীয় সরকার কীভাবে আইনের একটি ইমার্জেন্সি ধারাকে ব্যবহার করতে পারে?

গত ১৭ জানুয়ারি ব্রিটেনের টেলিভিশনে বিবিসির নির্মিত ‘ইন্ডিয়া : দ্য মোদী কোয়েশ্চেন’ নামে এই আলোচিত তথ্যচিত্রটির প্রথম পর্ব প্রচারিত হয়। এর দ্বিতীয় পর্বটি প্রচারিত হয় গত মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারি রাতে।

তদানীন্তন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাক স্ট্র-র নির্দেশে সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০০২ সালের ঐ দাঙ্গার পর গুজরাটে একটি অনুসন্ধানী দলও পাঠিয়েছিল, তাদের সেই রিপোর্টকেও বিবিসির তথ্যচিত্রে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

তবে ভারতে বিবিসির পক্ষ থেকে ওই তথ্যচিত্রটি টেলিভিশনে বা সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচার করা হয়নি।

এদিকে ব্রিটেনে তথ্যচিত্রটির প্রথম পর্ব প্রচারিত হওয়ার দুদিনের মাথায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটিকে একটি ‘প্রোপাগান্ডা’ বা প্রচারধর্মী কাজ বলে বর্ণনা করে এবং এতে ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতা’র পরিচয় ফুটে উঠেছে বলেও মন্তব্য করে।

মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী বলেন, “আমরা মনে করি এই প্রোপাগান্ডা পিস-টির উদ্দেশ্যই হল একটি বিশেষ বিকৃত ন্যারেটিভকে তুলে ধরা। এখানে পক্ষপাত, বস্তুনিষ্ঠতার অভাব এবং অব্যাহত ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণার ছাপ একেবারে স্পষ্ট।”

ভারতে তিনশোরও বেশি সাবেক বিচারপতি, আমলা এবং সুপরিচিত নাগরিকও একটি খোলা চিঠি লিখে এই তথ্যচিত্রটি বানানোর জন্য বিবিসির তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং ভারতে হিন্দু-মুসলিম সংঘাত উসকে দেওয়ার জন্য তাদের দায়ী করেছেন।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকও ইতিমধ্যেই সে দেশের পার্লামেন্টে পরিষ্কার করে দিয়েছেন তিনি ওই তথ্যচিত্রের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত নন।

ওয়েস্টমিনস্টারে হাউস অব কমন্সের সদস্য ইমরান হুসেইন সভায় এই তথ্যচিত্রটির প্রসঙ্গ তুললে প্রধানমন্ত্রী সুনাক মন্তব্য করেন, “পৃথিবীর যেখানেই ধর্মীয় কারণে নির্যাতন হোক না কেন আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই।”

“কিন্তু এই ডকুমেন্টারিতে যে চরিত্রায়ন করা হয়েছে আমি তার সঙ্গে আদৌ একমত পোষণ করি না”, মন্তব্য করেন তিনি।

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিবিসি একটি বিবৃতিতে বলেছে, “সর্বোচ্চ সম্পাদকীয় মান অনুসরণ করে নিরলস গবেষণার ফসল এই তথ্যচিত্রটি, যেখানে বিজেপি-সহ নানা পক্ষের বক্তব্যই প্রতিফলিত হয়েছে।”

এই তথ্যচিত্রে যে সব প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে সেগুলো নিয়ে ভারত সরকারের বক্তব্যও জানতে চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা কোনও জবাব দিতে অস্বীকার করেছে বলেও বিবিসি জানিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *