বাংলাদেশিদের নিয়ে লেবার পার্টির নেতার বক্তব্যে ব্রিটেনের রাজনীতিতে তোলপাড়

প্রবাসী যুক্তরাজ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

ব্রিটেনের বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা স্যার কিয়ার স্টারমার অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তার জের ধরে তুমুল বিতর্ক চলছে দেশটির রাজনীতিতে। ব্রিটেনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অবৈধ অভিবাসী থাকার পরও বাংলাদেশ নিয়ে আলাদা বক্তব্যে মি. স্টারমার নিজ দল ও বাংলাদেশি কমিউনিটির তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন।

আগামী চৌঠা জুলাই যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে গত সোমবার ডেইলি সান আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মি. স্টারমার অবৈধ অভিবাসী হিসেবে উদাহরণ টানতে গিয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টানেন। তার এ বক্তব্যে বিপাকে পড়েছেন লেবার পার্টির মনোনয়ন পাওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীরা। নির্বাচনের আগে ওই বক্তব্যে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশিরা।

ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম দ্যা টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়েছে, অবৈধ অভিবাসী নিয়ে মি. স্টারমারের এই বক্তব্য তীব্র ক্ষোভ ও সমালোচনা তৈরি করেছে বাংলাদেশ কমিউনিটিতে। এমনকি এই বক্তব্য দেয়ার পর নিজ দলের সদস্যদেরও তোপের মুখে পড়েছেন লেবার পার্টির এই নেতা।

দলীয় নেতার এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় লেবার পার্টির টাওয়ার হ্যামলেটস-এর ডেপুটি লিডার ও কাউন্সিলর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাবিনা আখতার লেবার পার্টি থেকে পদত্যাগ করেছেন। নিজের এক্স একাউন্টে পদত্যাগের কথা জানিয়ে সাবিনা আখতার বলেছেন, “দলের নেতা যখন আমার কমিউনিটিকে আলাদা করে এবং আমার বাংলাদেশি পরিচয়কে অপমান করে, তখন আমি আর দল নিয়ে গর্ব করতে পারিনা।’

ব্রিটিশ গণমাধ্যম স্কাই নিউজের খবরে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশিদের নিয়ে এমন বক্তব্যে তোপের মুখে এর ব্যাখ্যা দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে মি. স্টারমার। যেখানে তিনি বলেছেন, “আমি কাউকে আঘাত দিতে চাইনি। আপনারা যে আমার কথায় কষ্ট পেয়েছেন এনিয়ে আমি উদ্বিগ্ন”।

বিতর্কের শুরু যেখান থেকে

যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচনের আগে ডেইলি সানের ইলেকশন শো-ডাউন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার। সেসময় একজন অবৈধ অভিবাসী ইস্যুতে তার অবস্থান জানতে চান। জবাবের একপর্যায়ে বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে টেনে স্টার্মার বলেন, “যারা বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে এদেশে এসেছেন, তাদের ফেরত পাঠানো হতে পারে। কয়েকটি দেশের মানুষের এখানে আসা বন্ধ করতে পারি আমরা।”

রুয়ান্ডা অ্যাসাইলাম প্ল্যানকে ‘ব্যয়বহুল’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যে দেশ থেকে তারা এসেছেন, সেখানেই তাদের ফেরত পাঠানো হবে। আমি নিশ্চিত করব সেটা।” ২০২২ সালের এপ্রিলে রুয়ান্ডা অ্যাসাইলাম প্ল্যান নামের একটি অভিবাসন নীতি প্রস্তাব করেছিল ব্রিটিশ সরকার। এতে বলা হয়, যুক্তরাজ্যে অবৈধ অভিবাসী বা আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের পূর্ব আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় পুনর্বাসনের জন্য স্থানান্তর করা হবে।

বাংলাদেশি কমিউনিটি ও লেবার পার্টিতে প্রতিক্রিয়া

লেবার নেতা স্যার কিয়ার স্টারমারের এই মন্তব্যে বাংলাদেশের নাম ব্যবহার হওয়ার কারণে ক্ষোভ বাড়ে বাংলাদেশ কমিউনিটিতে। এ মন্তব্যের পর সাম্প্রতিক ব্রিটেনের গণমাধ্যমে আলোচনায় ছিল এ সংবাদ। যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশি যে ৩৪ জন লড়ছেন তাদের মধ্যে লেবার পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন আট জন। এর মধ্যে আছেন বর্তমানে এমপি রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রুপা হক ও আপসানা বেগম।

ব্রিটেনের গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, স্টারমারের সাম্প্রতিক বক্তব্যে ক্ষুব্ধ কেউ কেউ আবার নির্বাচনে কোনও দলীয় প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী বেছে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশি অধ্যুষিত যেসব এলাকায় বর্তমানে লেবার পার্টির বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রয়েছেন, সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কিয়ার স্টার্মারের মঙ্গলবারের বক্তব্য তুলে ধরে নিজেদের পক্ষে ভোটার টানার চেষ্টা করছেন।

পদত্যাগ করা টাওয়ার হ্যামলেটের ডেপুটি লিডার সাবিনা আখতার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “আমি লেবার পার্টি থেকে পদত্যাগ করেছি। আমি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাউন্সিলের প্রথম নারী স্পিকার এবং লেবার পার্টির একজন গর্বিত সদস্য ছিলাম। আমি সারা জীবন দলকে রক্ষা করেছি এবং এর জন্য খুব গর্বিত ছিলাম। কিন্তু এটা স্পষ্ট, আমার এবং আমার কমিউনিটির কাছে এ ধরনের মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।’

ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন লেবার পার্টির নির্বাচনী প্রার্থী আপসানা বেগমও। বুধবার এক ভিডিও বার্তায় আপসানা বেগম বলেন, “আমি স্পষ্টভাবে বলছি, আমি যতদিন আছি, অভিবাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দোষারোপ সহ্য করব না। আমাদের বাংলাদেশি সম্প্রদায় ১৯৭৮ সালে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন করে। সেই আন্দোলনে ইস্ট লন্ডনে ২৫ বছর বয়সী আলতাব আলী নিহত হন।

“তখন আমাদের স্লোগান ছিল- ‘আমরা এখানে ছিলাম, আমরা এখানে থাকব’। আপনারা আমাকে ভোট দিলে শক্তিশালী আওয়াজের জন্য ভোট দিচ্ছেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত থাকেন। যিনি সংসদে গিয়ে যেকোনও উপায়ে আমাদের অভিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার এবং সম্মান রক্ষা করবে।”

টানা চারবার নির্বাচিত এমপি রুশনারা আলী বলেছেন, “কোনও দেশকে এভাবে এককভাবে বলা ঠিক নয়। এটা ভুল হয়েছে। আমি আমার নেতাদের জানিয়েছি, এভাবে এককভাবে বললে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।”

লেবার পার্টির বিবৃতি ও স্টারমারের দু:খ প্রকাশ

বাংলাদেশি কমিউনিটিতে তীব্র ক্ষোভের মুখে এর ব্যাখ্যা দিয়েছে লেবার পার্টি। বাংলাদেশের সঙ্গে লেবার পার্টির সম্পর্ক তুলে ধরে দলটি জানায়, স্টারমার কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এমন মন্তব্য করেননি।

টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়, বাংলাদেশি কমিউনিটিতে তীব্র ক্ষোভের মুখে এর ব্যাখ্যা দিয়েছে লেবার পার্টি। বাংলাদেশের সঙ্গে লেবার পার্টির সম্পর্ক তুলে ধরে দলটি জানায়, স্টারমার কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এমন মন্তব্য করেননি। লেবার পার্টির বিবৃতিতে বলা হয়, তাদের দলের সঙ্গে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ কমিউনিটির সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর ও বন্ধুত্বপূর্ণ। স্টারমার নিজেও কয়েকবার বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছেন উল্লেখ করেছেন বলেও জানান হয় এতে।

এই বক্তব্যের পর বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন বাংলার কাছে একটি সাক্ষাৎকার দেন মি. স্টারমার। সেই সাক্ষাৎকারেটি নিয়ে রিপোর্ট করেছে ব্রিটেনের দ্যা টেলিগ্রাফ। এটিএন বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মি. স্টারমার বলেন, এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। এই ধরনের বক্তব্য দেয়া আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আমি কাউকে আঘাত করে বক্তব্য দেই নাই।

যেখানে তিনি আরও বলেন, “লেবার পার্টি ও বাংলাদেশিদের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে অনেক সুদৃঢ়। এখানকার বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের সাথেও আমার সুসম্পর্ক রয়েছে। সান পত্রিকার ওই শো’তে নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি এটিএন বাংলাকে বলেন, “আমি মনে করে আগামীতে লেবার পার্টি সরকার গঠন করলে বাংলাদেশ ব্রিটেন দুই দেশ একত্রে কাজ করতে পারবো। এর ফলে দুই দেশই উপকৃত হবে”।

টেলিগ্রাফের ওই খবরে বলা হয়, নিজ দলের প্রতিনিধি ও নেতাদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়ার পরই ক্ষমা ও ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন মি. স্টারমার। যেখানে তিনি বৃটেনের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের অবদানের কথা স্বীকার করেন এবং এই অবদানের জন্য দেশটিতে থাকা বাংলাদেশ কমিউনিটির প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি।

বাংলাদেশ ব্রিটেন অভিবাসন চুক্তিতে কী আছে?

যুক্তরাজ্যে অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে সম্প্রতি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ। গত মাসে দেশ দুটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠকেই এটি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন খারিজ হওয়া, অপর দেশের অপরাধী এবং ভিসার মেয়াদ পার হয়ে যাওয়া অভিবাসীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সহজ হবে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার।

ব্রিটেনের প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য টেলিগ্রাফ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত বছরের মার্চ মাস থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ১১ হাজার বাংলাদেশি ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে ১১ হাজার বাংলাদেশি ব্রিটেনে এসেছেন ছাত্র, কর্মী কিংবা ভ্রমণ ভিসা নিয়ে। এরপর তারা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করে তারা ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসের চেষ্টা করছে।

লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশন থেকে জানানো হয়েছে, আগে ইইউ’র সঙ্গে থাকা চুক্তির আওতায় ব্রিটেন থেকে অবৈধ নাগরিকদের ফেরত পাঠানো হলেও ব্রেক্সিটের পর দেশটির সাথে কোনো চুক্তি ছিল না। তাই এই সমঝোতা করা হয়েছে। তবে, এটি ছাড়াও এতদিন নাগরিকদের ফেরত পাঠানো যেত।

গত এক দশকে ভিসা নিয়ে যুক্তরাজ্যে যাওয়া এক লাখ ২০ হাজারের বেশি মানুষ রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। এই আবেদনকারীদের মধ্যে সবার উপরে রয়েছেন পাকিস্তানি নাগরিকরা। প্রায় ১৭ হাজার ৪০০ পাকিস্তানি আশ্রয় প্রার্থনা করে আবেদন করেছেন। তারপরই বাংলাদেশের অবস্থান। ভারতীয় ৭,৪০০ জন, নাইজেরীয় ৬,৬০০ জন এবং আফগানিস্তান থেকে যাওয়া ৬,০০০ জন রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন।
যুক্তরাজ্য গত বছর ২৬ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠায়, যা তার আগের বছরের তুলনায় ৭৪ শতাংশ বেশি। – বিবিসি বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *