রাষ্ট্রের একজন সম্মানিত ও সুপরিচিত নাগরিক প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তাকে (অতিরিক্ত সচিব) দাপ্তরিক জরুরি একটি কাজে মোবাইলে কল দেয়। তাদের ফোনালাপ দিয়ে শুরু করছি।
নাগরিকঃ হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। ভাই ভালো আছেন?
অতিরিক্ত সচিবঃ ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে বলছেন?
নাগরিকঃ আমি —অমুক— তিনি তার পরিচয় দেয়।
অতিরিক্ত সচিবঃ (নাগরিকের পরিচয় পাওয়ার পরও রুক্ষস্বরে) আপনি আমাকে ভাই বলছেন কেন? আমি আপনার কেমন ভাই?
নাগরিকঃ (তার এমন অনাকাঙ্খিত আচরণে খুব অবাক হয়ে জানতে চান) কেন আপনাকে ভাই বলা যাবে না? এতে দোষ কোথায়?
অতিরিক্ত সচিবঃ কেন বলবেন? আপনি কি আমার মামাতো, চাচাতো কিংবা খালাতো ভাই লাগেন?
নাগরিকঃ (স্বাভাবিকভাবেই এমন আচরণে বিব্রতবোধ করে) তাহলে আপনাকে কি বলে সম্বোধন করবো?
অতিরিক্ত সচিবঃ আমার নাম ধরে ডাকবেন। বা পদবী ধরে বলবেন। (মূলত তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন উনাকে যেন ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করা হয়)।
নাগরিকঃ দেখুন আমাদের দেশের কালচারে প্রফেশনাল লেবেলে কাউকে সরাসরি নাম ধরে ডাক দেওয়া শোভনীয় দেখায় না।
অতিরিক্ত সচিবঃ না, আপনি আমাকে ভাই বলে ডাকতে পারেন না। এই বলে তিনি লাইন কেটে দেয়। (এতে সুনাগরিক বেশ বিব্রত ও হতাশ হয়।)
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কেউ কেউ আবার মনে করতে পারেন, অতিরিক্ত সচিবকে প্রথমবারেই ‘ভাই’ বলাটা সমীচীন হয়নি। কিন্তু অতিরিক্ত সচিবের সাথে ঐ নাগরিকের এর আগেও বেশ কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছিলো। তখন কিন্তু তিনি ‘ভাই’ সম্বোধন করা নিয়ে মোটেও আপত্তি করেন নাই।
প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তার এমন কথোপকথনেই বুঝা যায় তিনি রাষ্ট্রের নাগরিকদের সাথে ঠিক কেমন আচরণ করেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রের একজন সুপরিচিত নাগরিকের সাথে এমন আচরণ থেকে খুব সাধারণ জ্ঞানেই অনুমান করা যায়, এই পদে (অতিরিক্ত সচিব) আসার আগে পুরো চাকুরী জীবনের বিভিন্ন ধাপে রাষ্ট্রের মালিক তথা সাধারণ নাগরিকদের সাথে ইতিপূর্বে তিনি কেমন আচরণ করেছিলেন।
প্রজাতন্ত্র বা সরকারি কর্মচারীদের আসলে কি বলে ‘সম্বোধন’ করা উচিত? ‘স্যার’, ‘ভাই’, ‘আপা’, ‘জনাব’ নাকি ‘মহোদয়’? সংবিধানের কোথাও এমন কিছু কি আছে যে সরকারি একজন কর্মচারীকে অবশ্যই ‘স্যার’ বলতে হবে অথবা ‘ভাই’ বা ‘আপা’ এসব বলে সম্বোধন করা যাবেনা? তাকেতো ‘স্যার’ বলবে তার অধিনস্ত কর্মচারিরা। রাষ্ট্রের জনগণ বা নাগরিকরাতো তার অধিনস্ত কর্মচারি নয়। তাহলে নাগরিকরা প্রজাতন্ত্র বা সরকারি কর্মচারীদের কিভাবে ‘সম্বোধন’ করা উচিত?
জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করা সরকারি কর্মচারীদের (কর্মকর্তা-কর্মাচারি) সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু জনগণের এই সেবকরা ঠেকায় না পড়লে জনগনকে সহজে সম্মান দিয়ে কথা বলেনা। উল্টো জনগনকে ‘স্যার’ বলতে বাধ্য করে। এসব নিয়ে প্রায়শঃই আমরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম হতে দেখি।
বিষয়টি কিন্তু গভীরভাবে ভাববার। কারণ, এটি এখন মহামারী আকারে ধারণ করেছে। যখন কোন দেশে কোন রোগ মহামারী আকার ধারণ করে তখন তা শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রতিরোধ করতে হয়। তা না হলে সব শেষ হয়ে যায়।
বিগত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমল থেকেই মূলত সরকারি কর্মচারীদের এমন বৈরী মনোভাব, প্রভু বা শাসকসূলভ আচরণ মহামারী আকার ধারণ করে এখন তা ‘চরম পর্যায়ে’ পৌঁছেছে। প্রতিটি সরকারি অফিস বা দপ্তরের পিয়ন থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত অধিকাংশের (৯৫%+) মানসিকতা একই। তারা জনগণ বা নাগরিকদের সম্মান দিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন।
তাদেরকে ‘ভাই’ বা ‘আপা’ বললেই সেবা বন্ধ হয়ে যায়, অসহযোগিতা শুরু হয়, এমনকি জনগণকে চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। ঘুষের বিষয়টি নিয়ে আর নাইবা বললাম। তেল না মেরে কথা বললে, স্যার না বললে তাদের পেটের কোন খাবারই হজম হয়না।
আরও পড়ুনঃ ‘বাংলাদেশ কেন আজ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি?’ -ফাহিম ফয়সাল
কোন কোন সরকারি কর্মচারিতো আবার লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে সরাসরি তর্ক জুড়ে দেয় এই বলে যে, তাকে কেন ‘স্যার’ না বলে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করা হলো। আজকালতো এমন হচ্ছে যে, কোন প্রয়োজনে কারো অফিসে গিয়ে দেখা করতে চাইলে কেন আগে থেকেই তার ‘অ্যাপয়েনমেন্ট’ নেওয়া হলোনা সেটি নিয়ে আপত্তি তোলে। সময় থাকা স্বত্তেও স্বাক্ষাত না করে বরং জনগণকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে হয়রানি করানো হয়। অথচ সরকারি কর্মচারীদের (কর্মকর্তা-কর্মাচারি) উচিত জনগনকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করা। জনগনের সময়ের গুরুত্ব দেওয়া। সরকারি অফিসে গেলে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সালাম, কুশল বিনিময় শেষে সৌজন্যতার খাতিরে হলেও হাত মিলানো, তাদেরকে সম্মান দিয়ে কথা বলা। সম্ভব হলে চা-পানি দিয়ে আপ্যায়নের চেষ্টা করা। তাদেরকে গুরুত্ব দেওয়া। এগুলো হচ্ছে শিষ্টাচার বা সাধারণ ভদ্রতা। এগুলো পারিবারিক শিক্ষা।
একটি বিষয় হচ্ছে- বিশ্বের নানান দেশে ছোটবড় কাউকে সম্বোধন করার ক্ষেত্রে কি চলে? ইংরেজিতে ‘You’ মানে তুমি, আপনি, তুই এই সব। আরবিতে ‘أنت’ (তুই, তুমি, আপনি), হিন্দিতে- ‘आप’ (তুমি, তুই, আপনি), উর্দূতে- আপনি (تم) , তুমি (تم), তুই (آپ), ফ্রেঞ্চ- ‘Toi’ (তুই, তুমি, আপনি), স্প্যানিশে- Tú (তুই, তুমি, আপনি), চায়নিজ- 你 (তুই, তুমি, আপনি)। এখানে আমরা দেখতে পাই কাউকে সম্বোধন করার ক্ষেত্রে তারা কোন ক্লাসিফিকেশন করেনা। এক শব্দেই শেষ করে।
প্রজাতন্ত্রের এই কর্মচারিদের বেতন, বোনাস, ভাতা, পেনশনসহ নানান সুযোগ-সুবিধা সবই হয় এই জনগণের রক্ত পানি করা পরিশ্রমের ভ্যাট, ট্যাক্সের টাকাতেই। দেশের পরিস্থিতি যাই থাকুক না কেন, এই সরকারি কর্মচারীদের বেতন, ভাতা, বোনাস, পেনসন, নানান সুযোগ-সুবিধা কিন্তু বন্ধ হয়না৷ তাহলে কোন অধিকারে আপনারা জনগনকে হয়রানি করেন, জনগণকে অসম্মানিত করেন? স্যার মানে ‘জনাব’ বা ‘মহোদয়’। যদি স্যার বলতেই হয় তবে উভয়পক্ষকেই স্যার বলা উচিত। আর একজন নাগরিক যদি কোন কর্মচারী-কর্মকর্তাকে সম্মান দিয়ে ‘স্যার’ বলে তাতে দোষের কিছু নেই। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় নাগরিকেরা উনাদেরকে সম্মান দিয়ে ‘স্যার’ বলেই সম্বোধন করে। কিন্তু অধিনস্ত কর্মচারী না হলে কোন নাগরিকের কাছ হতে জোর করে ‘স্যার’ শুনতে চাওয়া বা ‘স্যার’ বলে সম্বোধন আদায় করা অবশ্যই দোষের ও নিন্দনীয় বটে।
উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই শিক্ষকের বাইরে কাউকে স্যার বলে ডাকা হয়না। সেখানে সরাসরি তার নাম ধরে ডাকা হয়। যেমন Mr. Khan, ইত্যাদি। কেউ কাউকে স্যার বললে তারা বরঞ্চ আপত্তি করে। তারা বলে তাকে নাম ধরে ডাকতে। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ সম্মানিত মানুষকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে। কিন্তু এই সম্মান দেওয়াটাকে যখন কেউ কেউ ভাবে যে, তাকে সকল ক্ষেত্রেই সম্মান দিয়ে ‘স্যার’ বলতে হবে তাহলে সেটি হচ্ছে তার Ego Problem. আর এমন ‘ইগো’ বা অহংকার একজন মানুষ তথা পরিবার ও সমাজের জন্য বিরটা ব্যাধির কারন।
মানুষ হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। জন্ম, মৃত্যু, শরীর সকলের একই রকম। সবাই সমান। তাই সকল পর্যায়ের মানুষকে সম্মান দেওয়াই হচ্ছে ভদ্রতা, নৈতিকতা, ইতিবাচক মানসিকতার পরিচয়।
তাই নাগরিক সেবা সহজ, সুলভ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক করতে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আরো বেশি জনবান্ধব ও আন্তরিক হতে হবে। কিন্তু তা না করে উল্টো জনগণের ভদ্রতা ও অসহায়ত্বের সুযোগ নেয় প্রজাতন্ত্রের অধিকাংশ কর্মচারী। এই জন্যই দেশে এখন মেধাবীরা থাকতে চায় না, তারা জীবনবাজি রেখে হলেও বিদেশ চলে যায়। ‘ব্রেইন ড্রেইন’ বা মেধা পাচারের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে এই দেশের সরকারি অফিসগুলো বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই বিরূপ ও বিমাতাসুলভ আচরণ।
আপনারা (প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারি) এই রাষ্ট্রের মালিক নন। সুতরাং এই রাষ্ট্রের মালিক তথা এই জনগণকে সম্মান দিয়ে ‘স্যার’ না বলুন অন্তত হাসিমুখে ভাই, বোন কিংবা আপা বলে সম্বোধন করুন। প্রজাতন্ত্রের সেবক হিসেবে আপনাদেরকে এতোটুকু ছাড় দেওয়াই যায়। তা না হলে অচিরেই সকল শ্রেণী-পেশার এই জনগণকেই আপনারা উঠতে বসতে ‘স্যার’ বলতে বাধ্য হবেন।
এই রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক সিস্টেম পুরোপুরি পঁচে গেছে। জনগনকে শাসনের এই সিস্টেম দিয়ে এই ‘রাষ্ট্র গড়া আর সম্ভব নয়’। এই সিস্টেম ঢেলে সাজালেও কোন লাভ হবেনা। প্রবাদ বাক্যের মতো ‘যেই লাউ সেই কদু’ হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়তে বরং এই সিস্টেম বিলুপ্ত করে মেধাবীদের মন্তব্য, পরামর্শে রাষ্ট্রের জন্য নতুন সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট করতে হবে। তা না হলে ছাত্রজনতার সম্মিলিত অংশগ্রহণে হওয়া এই জুলাই বিপ্লব পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যাবে।
লেখকঃ
সংগীতশিল্পী, মিডিয়া প্রফেশনাল, মাল্টিমিডিয়া স্পেশালিস্ট, গবেষক, পলিসি মেকার ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
fahimfaisalofficial.com