বাংলাদেশ কেন আজ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি? -ফাহিম ফয়সাল

প্রবন্ধ-কলাম মতামত সময় টিভি সময় সাহিত্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

ফাহিম ফয়সালঃ
ইতিহাস ধরে যখন আমরা কয়েক শতাব্দী পূর্বে ফিরে তাকাবো তখন দেখতে পাবো কতোটি ধাপে এবং কিভাবে আন্দোলন, সংগ্রাম করে সর্বশেষ পূর্ব পাকিস্তান থেকে আজকের বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। তবে স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আসলে কি আমরা স্বাধীন হতে পেরেছি, স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারছি? সকলের মনে তা আজ এক বিরাট প্রশ্ন।

কারণ, স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতে কে না চায়? সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর প্রাণী হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন। মানুষ গবেষণা করে আবিস্কারের নেশায় চাঁদে, মঙ্গলগ্রহে যাচ্ছে। আবার এই মানুষই আরেকজন মানুষের উপর শক্তি প্রদর্শন করে। নিজ স্বার্থ চরিতার্থে অত্যাচার, নির্যাতন, নিপিড়ন, হত্যা করে নিজের ‘ক্ষমতা জানান’ দেয়। এই মানুষই আবার মানুষকে বশে রাখতে নানান ফন্দিফিকির বের করে, যাকে ‘সভ্য’ ভাষায় ‘আইন’ বলা হয়। সব কিছুর পেছনেই রয়েছে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার বিরাট এক ‘কৌশল’ বা ‘পলিসি’।

পৃথিবীর রাষ্ট্রব্যবস্থায় এখন ৩ ধরনের নিয়ম চালু আছে। রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও গণতন্ত্র।

এরমধ্যে যেসকল দেশে ‘রাজতন্ত্র’ চলে সেখানে জনগণের ভোটের অধিকার বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হয়না। কারণ, রাজতন্ত্রে জনগণের সকল সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সে সকল দেশে রাজা, আমির, শেখরা তাদের রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে জনগনের সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার পর সে দেশের আইন অনুযায়ী নিজেদের ইচ্ছেমতো দেশ চালায় বা ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করে। যেমন- সৌদী আরব, ভুটান, মরক্কো, ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ডেনমার্ক, স্পেন, নরওয়ে ইত্যাদি।

ছবিঃ ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্র

বর্তমান পৃথিবীতে অনেক দেশে ‘স্বৈরতন্ত্র’ চালু আছে। স্বৈরতন্ত্র হচ্ছে ‘এক ব্যক্তির শাসন’। একে অনেকে সামরিকতন্ত্র হিসেবেও আখ্যায়িত করে। কারন, কিছু কিছু দেশে সামরিক শাসকরাই দেশ চালায়। স্বৈরতান্ত্রিক দেশ চলে কোনো বিশেষ ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতায়, যিনি সে দেশের জনগণ, সংবিধান, আইনের রীতিনীতি অগ্রহ্য করে এককভাবে সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এবং তার একক নির্দেশনায় দেশকে শাসন করেন। তখন তাকে ‘স্বৈরশাসক’ বলা হয়।

একটি দেশে রাজনৈতিক বহুদল থাকলেও স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন একটি দল বা গোষ্ঠী প্রথমে গণতান্ত্রিক উপায়ে (ভোটের মাধ্যমে) বা অন্যকোনভাবে ক্ষমতা দখল করার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময় রাষ্ট্র ক্ষমতা আঁকড়ে থাকে। যে সকল দেশে স্বৈরাচাররা ক্ষমতার মসনদে বসে থাকে তারা জনগনের মতামত বা রাষ্ট্রের আইনের কোন তোয়াক্কাই করেনা। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য বা সূচকের শীর্ষে রয়েছে- উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, চীন, ভারত, উরুগুয়ে, এস্তোনিয়া, তাইওয়ান ইত্যাদি দেশ। আর একেবারে তলানিতে রয়েছে- সোমালিয়া, ইয়েমেন এবং সিরিয়া। গত কয়েকবছর যাবত বাংলাদেশও গণতন্ত্রের নামে মূলত স্বৈরতান্ত্রিক দেশের খাতায় নাম লেখালেও তা খুব দ্রুতই মুক্ত হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমীক্ষা অনুযায়ী ‘নিকৃষ্টতম স্বৈরতান্ত্রিক’ দেশগুলির তালিকায় রয়েছে- ভারত, আফগানিস্তান, ব্রাজিল, মিয়ানমারের নাম। সম্প্রতি বাংলাদেশেও যদি স্বৈরশাসন টিকে যেতো তবে ‘নিকৃষ্টতম স্বৈরতান্ত্রিক’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নামও নিঃসন্দেহে অন্তর্ভূক্ত হতো।

স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে কিছু দেশ আছে যারা স্বৈরশাসক হলেও জনগণের স্বার্থে কাজ করে। আবার অনেক দেশ আছে জনগণের স্বার্থের কথা না ভেবে নিজের ইচ্ছেমতো দেশ চালায়। তাদের জন্য সাধারণ মানুষ ছোটখাট অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেও ভয় পায়। কারণ, স্বৈরশাসকরা সাধারণত তাদের বিপক্ষে কথা বললেই মানুষের উপর নানাভাবে জুলুম, নির্যাতনের পাশাপাশি প্রাণ নিতেও দ্বিধাবোধ করেনা। এরা কারো কথা বা পরামর্শের ধারও ধারেনা। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে স্বৈরশাসনের যে চিত্র ফুটে উঠেছিলো তার পুরোটি এমনই ছিলো।

আর রইলো ‘গণতন্ত্র’। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থাকে। যারা মূলত রাষ্ট্র ও জনতার উন্নয়নের স্বার্থে কাজ করে। কিন্তু তারা জনগনের ম্যান্ডেট নিয়ে নির্বাচন করে ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসতে পারে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনতাই সকল সিদ্ধান্তের মালিক। জনতাই সকল শক্তির উৎস। জনতা যাকে চাইবে সে দল বা গোষ্ঠীকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি হয় নাগরিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটে অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের মাধ্যমে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল রাজনৈতিক দলের মত প্রকাশের অধিকার থাকে। ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দল বা মতের উপর জুলুম, নির্যাতন করেনা। এককথায় দলমত নির্বিশেষে সবার বাক স্বাধীনতা থাকে। পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশসহ অসংখ্য রাষ্ট্র চলছে এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। কিন্তু যখনই এর ‘ব্যতয়’ ঘটে তখনই বাঁধে নানান বিপত্তি।

গণতন্ত্র সম্পর্কে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে- “একটি দেশকে গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত বলে গণ্য করতে হবে না; বরং দেশটিকে গণতন্ত্রের মাধ্যমে উপযুক্ত হতে হবে।” (“A country does not have to be deemed fit for democracy; rather, it has to become fit through democracy.”) সূত্র: oecd-development-matters.org

আমরা কমবেশি সবাই জানি, বিভিন্ন দেশের কোন কোন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, মেয়র, এমপি, কাউন্সিলররা যখনই নীতিগতভাবে কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হয় এবং এর দ্বায়ভার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের উপর এসে পড়ে তখন তারা ‘স্বেচ্ছায় পদত্যাগ’ করে। কারণ, তাদের কাছে ভোটের আগের ম্যান্ডেট বা ওয়াদা রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার এটি বিরাট শক্তি। কিন্তু তার জন্য সে সকল রাষ্ট্র আইনের শাসন নিশ্চিত করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে দল বা গোষ্ঠী রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে তারা জনসাধারণের মতামতগুলোকে সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। কারণ তারা জনসাধারণের ভোটে, জনগনের জীবনমানের উন্নয়নের পাশাপাশি এক কথায় জনতার জন্য কাজ করতেই ক্ষমতায় বসে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যারাই ভোটে বিজয়ী হয় তখন তারা এককভাবে তাদের দলের জন্য কাজ করেনা। তারা কাজ করে রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন ও সকল শ্রেণী-পেশার জনসাধারণের (নিজ দল ও বিরোধীদল) জীবনমানের উন্নয়ন নিয়ে। তারা তখন নির্দিষ্টভাবে তাদের দল বা বিরোধী দলের নয়; তারা তখন রাষ্ট্রের পরিচালনা শক্তি। অনেক ভালো ভালো কাজ করার পরও ছোটখাটো কিছু ভুলের কারণে জনতা যদি তাদেরকে ভোট না দেয়, সমর্থন না করে তবে তারা আর রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসতে পারেনা।

একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনগন দ্বারা ক্ষমতার বিষয়গুলো এমনভাবে তৈরি হয় যা গণতন্ত্র হিসেবে তাদের (জনগন) দ্বারা অধিষ্ঠিত হয়। যা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন, ব্যক্তি অধিকার রক্ষা এবং রাজনৈতিক জীবনে নাগরিকদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। (The positions of power in a political system referred to as democracy are held by the people who make up that system. It is based on the principles of having elections that are free and fair, having the rule of law, protecting individual rights, and encouraging citizen participation in political life.) সূত্র: havefunwithhistory.com

ছবিঃ ভোটাধিকার

অধিকাংশ উন্নত দেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বা পলিসি হচ্ছে- কোন ব্যক্তি ‘২ বারের অধিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী’ হতে পারবেন না। কারণ, তারা সবসময় রাষ্ট্র ও জনগণের উন্নয়ন চায়। এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা কোন ‘আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের’ মডেল হতে পারেনা। এই জন্যই ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মডেল দেশগুলোয় ২ বারের বেশি কেউ রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান হতে পারেন না। তাইতো ঐ দেশগুলোকে আমরা উন্নতদেশ হিসেবে গণ্য করি।

ঠাণ্ডা মাথায় যদি একটি কথা ভাবি তাহলে দেখতে পাই, আমরা কেন রাশিয়া, ইউক্রেন, উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, সিরিয়াসহ এমন দেশগুলোতে যেতে চাই না। কারণ এসকল দেশ অস্থিতিশীল। অস্থিতিশীল দেশে কোন কিছুরই নিশ্চয়তা নেই।

তাহলে শিরোনামের আলোকে গণতান্ত্রিক দেশ হয়েও বাংলাদেশের সমস্যা কোথায়? আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে, স্বাধীনতার এতো বছর পরে এসেও আমরা শতভাগ দেশ-জনতার পক্ষে ‘পলিসি ডেভেলপমেন্ট’ করার পাশাপাশি কিভাবে এর প্রয়োগ হতে পারে তা এখনও ভাবিনি বা করতে ব্যর্থ হয়েছি।

ব্যক্তিগতভাবে আমার মতে যে কোন দেশই স্বাধীন হওয়ার সর্বোচ্চ ১৫-২০ বছরের মধ্যে দেশ ও জনগণের স্বার্থে সকল ধরনের সুদূরপ্রসারী পলিসি ডেভেলপমেন্ট করার পাশাপাশি জনগনের স্বার্থে তার প্রয়োগও নিশ্চিত করে। এটি হচ্ছে একটি ‘আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য’। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের এই সোনার বাংলাদেশে স্বাধীনতার এতোবছর পর এসেও এমন পলিসি ডেভেলপমেন্ট করা হয়ে উঠেনি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে মেধাবী, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক মানুষের বড্ড বেশি অভাব আমাদের। আমাদের মাঝে মহামারীর মতো আকার ধারণ করেছে ‘বিদেশপ্রীতি’। সবাই শুধু দেশটাকে চুষে-খেয়ে বিদেশ চলে যেতে চাই। কারণ এতোদিনে আমাদের বিশ্বাস জন্মে গেছে, এই দেশের সকল কিছুই অনিশ্চিত। এই মানসিকতা কিন্তু একদিনে হয়নি।

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে আজ অব্দি যতো ধর্ম, বর্ণ, জাতী, গোষ্ঠী এসেছে সবখানেই ভালো খারাপ দুই ধরনের চরিত্রের মানুষ ছিলো, আছে এবং থাকবে। তাই বলে কি খারাপের সাথে তাল মিলিয়ে সবাই খারাপ হয়ে যাবে? এমনটা হলে শান্তি আসবে কি করে? আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হবে কি করে? দেশ ছেড়ে চলে গেলে, দেশের বৈধ-অবৈধ সম্পদ, বৈধ-অবৈধ অর্থ বিদেশে নিয়ে গেলে আসলে লাভ কার এটি কিন্তু বুঝতে হবে।

ধরুন, আপনি ব্যবসা করেন। আপনার ব্যবসায় কেউ এসে ‘সেচ্ছায় অর্থ বিনিয়োগ’ করতে চাইলো। আপনি কি তাকে নিষেধ করবেন নাকি সাদুবাদ জানিয়ে আলোচনা করে ইতিবাচক হলে তার অর্থ বিনিয়োগ নেবেন? বিদেশ চলে যাওয়া অনেকটা এমনই। অধিকাংশ সময়েই তারা (অন্য রাষ্ট্র) দেখবেনা তাদের দেশে অন্য দেশের যারা যাচ্ছে তারা যে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে তা কি বৈধ নাকি অবৈধ। কারণ দিনশেষে ঐ অর্থতো তাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধই করবে। এগুলো তাদের পলিসিতেই রয়েছে।

আপনি যখন কোন দেশে যেতে চাইবেন তখন তারা দেখবে আপনার ‘কি আছে’? এই ‘কি আছে’ এর মধ্যে প্রধানত থাকে- অর্থ, মেধা, সৃজনশীলতা, সুস্থতা, শারীরিক সক্ষমতা ইত্যাদি। উল্লেখিত এগুলোর কোন না কোনটা আপনার অবশ্যই থাকতেই হবে। তা না হলে আপনার স্বপ্নের দেশে কেন উন্নত কোন দেশেই আপনি যেতে পারবেন না।

আমাদের দেশটি গড়তে হলে ‘বৈশ্বিক খেলা’ বা ‘বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতি’ নিয়ে আপনাকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। আপনি নিরাপত্তা, অনিশ্চয়তার দোহাই দিয়ে দেশ ছাড়তে চাচ্ছেন। কিন্তু তা পাশের কোন দেশে নয় কেন? কেন আপনার লক্ষ্য থাকে ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার উন্নত দেশগুলোর দিকে যাওয়ার। তারা মূলত আপনাকে নেয় না, তারা নেয় আপনার অর্থ, মেধা, সৃজনশীলতা, সুস্থতা, শারীরিক সক্ষমতাকে। যা তার দেশ গড়ায় কাজে লাগবে। এবং এটি তাদের জতীয় পলিসি।

এবার আসুন, ‘বাংলাদেশ কেন আজ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি’ এই বিষয়ে। কারণ, আমরা সবাই দেশ ছাড়তে চাই। আমরা নিরাপত্তা চাই। আমরা নিশ্চয়তা চাই। আমরা স্থিতিশীল জীবনযাপন করতে চাই। এগুলো চাওয়ার মানসিকতা আমাদের কেন হলো? এই মানসিকতা কি রাতারাতি হয়ে গেলো? এগুলো গভীরভাবে ভাবতে হবে। শুধু ভাবলে হবেনা আমাদেরকে এগুলো নিয়ে ‘আজ এবং এখন’ থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। অন্যের দিতে তাকিয়ে থাকলে চলবেনা। ব্যক্তিপর্যায় থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। যোগ্য ও মেধাবীদের মূল্যায়ন করতে হবে। কাজের সুযোগ করে দিতে হবে।

শুধুমাত্র যোগ্য ও মেধাবীদের মূল্যায়ন না করে মেধাহীন, চাটুকার, দুর্নীতিবাজদের মূল্যায়ন করার পাশাপাশি নানা সেক্টরে ক্ষমতা দেওয়ায় সকল কিছুরই ‘অপব্যবহার’ হচ্ছে। দেশ থেকে আজ হুহু করে পানির স্রোতের মতো ‘ব্রেইন ড্রেইন’ বা ‘মেধা পাচার’ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সোনার ছেলে-মেয়েরা যে দেশের আলো-মাটিতে বড় হয়েছে শুধুমাত্র এসকল সমস্যার জন্যই তারা দেশের কথা না ভেবে, নিজেদের মেধা দেশের জন্য কাজে না লাগিয়ে বরং অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। আর সে মেধাগুলোকে উন্নত দেশগুলো শুধুমাত্র ‘পার্থিব জীবনের নিশ্চয়তা’ দিয়ে তাদের দেশের উন্নয়নের স্বার্থে নিরবে কিনে নিচ্ছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পলিসির অভাবে আমরা যে কবে থেকে তলাবিহীন ঝুড়ি হয়ে গেছি তা আমরা নিজেরাও জানি না।

ব্রেইন ড্রেইন এমন একটি ঘটনা যেখানে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বা জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিরা দ্বন্দ্ব, সুযোগের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বাস্থ্য ঝুঁকি ইত্যাদির কারণে তাদের মূল স্থান ত্যাগ করে। (Brain drain is a phenomenon where individuals with technical skills or knowledge end up leaving their place of origin because of conflict, lack of opportunity, political instability, health risks, etc.) সূত্র: econlib.org

ছবিঃ ব্রেইন ড্রেইন বা মেধা পাচার

গত কয়েকবছরের বড় বড় এবং নজিরবিহীন অসংখ্য দুর্নীতির কারণে তরুণ ও মেধাবীরা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। কারণ তারা দেখছে, এতো এতো পড়ালেখা করেও তারা কিছু করতে পারছেনা। কিন্তু অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত, অযোগ্য লোকজন দুর্নীতির করেই হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে। বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে আলিশান জীবনযাপন করছে। এসবের প্রতিবাদ করেও কোন লাভ হচ্ছে না। বরং তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হচ্ছে। ‘ব্রেইন ড্রেইন’ বা ‘মেধা পাচারের’ এটি অন্যতম প্রধান কারণ।

এই রাষ্ট্রের মানুষ এখন কারো কথা বিশ্বাস করেনা। সামনাসামনি বিশ্বাস করার ভান করলেও পেছনে পেছনে ঠিকই আস্থাহীন মনোভাব পোষণ করে। কেন বিশ্বাস করেনা? এই যে ‘বিশ্বাসহীনতার সংস্কৃতি’ চালু হয়েছে তা কিন্তু একদিনে হয়নি। মিথ্যা মামলায় শুধুমাত্র আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে কতো নির্দোষ মানুষ জেল খাটছে, শাস্তি ভোগ করছে। আবার এই আইনের মারপ্যাঁচেই কতো অপরাধী সাজা ভোগ না করে দিব্বি জীবনযাপন করছে। মুক্ত আকাশের ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষ ন্যায় বিচারের জন্য আজ হাহাকার করছে। মৃত্যুদণ্ডের মতো অপরাধ করেও দোষী ব্যক্তিদের সাজা কার্যকর হচ্ছে না। মূলত ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির’ কারনেই জন্ম হয়েছে ‘বিশ্বাসহীনতার সংস্কৃতি’। আর যখন কয়েকটি প্রজন্ম অত্যাচার, অনাচার, দুর্নীতি, জুলুম দেখে বড় হবে তারা কিভাবে আমাদের বিশ্বাস করবে? কিভাবে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বিশ্বাস করবে? বিশ্বাস, আস্থার জায়গাতো আমরা বহু আগেই ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছি।

প্রবাদ আছে- ‘বিন্দু বিন্দু বারি মিলে হয় মহাসিন্ধু’। এই বিন্দু বিন্দু বারির মতোই এই রাষ্ট্রের জনগনের ক্ষোভ বহু বছরের নিপীড়ন, নির্যাতন, জুলুম, অত্যাচার, বিচারহীনতা ও বিশ্বাসহীনতার সংস্কৃতির জন্য তিলে তিলে পুঞ্জীভূত হয়ে আজ ‘গণ বিস্ফোরণে’ রূপান্তরিত হয়েছে। গণবিপ্লব ঘটেছে।

সুতরাং, ‘ব্রেইন ড্রেইন’ বা ‘মেধা পাচার’ রোধ করার জন্য মেধাবীদের মূল্যায়ন করার পাশাপাশি সৎ, চরিত্রবান, মেধাবী, দক্ষ ও সুদূরপ্রসারী চিন্তার অধিকারী মানুষদের মূল্যায়ন ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিলে দেশের মানুষ আস্থা রাখতে পারবে। সকল কিছুর ইতিবাচক নিশ্চয়তা ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তবেই বিশ্বাসের জায়গা ফিরে আসবে।

আমাদেরকে হিংসা ও হানাহানির রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। সকল সেক্টর থেকে অযোগ্য, চাটুকার, দুর্নীতিবাজদের সরিয়ে আইনের আওতায় এতে বিচার কার্যকর করলে বাকিরা ভবিষ্যতের জন্য সচেতন হয়ে যাবে। দোষীদের বিচারের আওতায় এনে অপরাধ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে হবে। সকল সেক্টরেই যোগ্য, মেধাবী ও দক্ষ লোক বসাতে হবে। তাহলেই তরুণরা রাষ্ট্র পরিচালনায় আগ্রহী হয়ে উঠবে।

এমন একটি পলিসি ডেভেলপমেন্ট করতে হবে যেখানে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা, বাকস্বাধীনতা, ভোটাধিকার সহ সাংবিধানিক অধিকারগুলে নিশ্চিত থাকবে। আমাদেরকে রাষ্ট্র, জনতার স্বার্থে গবেষণা খাতে সুযোগসুবিধা বাড়িয়ে কমপক্ষে আগামী ১০০ বছরের পলিসি ডেভেলপমেন্ট করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, খাদ্য, বাসস্থান এক কথায় মানুষের মৌলিক চাহিদা ও সাংবিধানিক অধিকারগুলো শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। এমন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীকে ভোট দিয়ে জনগনের ম্যান্ডেট দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসাতে হবে যারা ‘শাসক’ বা ‘শোষক’ না হয়ে বরং মনেপ্রাণে জনগনের ‘সেবক’ হিসেবে কাজ করবে। তবেই স্বার্থক হবে আমাদের স্বাধীনতা। সুন্দর ও নিরাপদ হবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলাদেশ।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ভোটাধিকার (oecd-development-matters.org), ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্র (havefunwithhistory.com), ব্রেইন ড্রেইন বা মেধা পাচার (econlib.org)

লেখকঃ
সংগীতশিল্পী, মিডিয়া প্রফেশনাল, মাল্টিমিডিয়া স্পেশালিস্ট, গবেষক, পলিসি মেকার ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
fahimfaisalofficial.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *