পারমাণবিক জ্বালানি আসলেও রূপপুর কেন্দ্র চালু হতে দেরি হবে কেন?

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

আবুল কালাম আজাদ

রাশিয়ার কাছ থেকে পারমাণবিক জ্বালানির প্রথম চালান বুঝে পেলেও পূর্ব নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রথম ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে পারছে না বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রাথমিক পরিকল্পনায় এ বছরে মধ্যে প্রথম ইউনিট থেকে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার কথা থাকলেও সেই পরকিল্পনা ‘নতুন করে সাজাতে’ হয়েছে।

বাংলাদেশ ও রাশিয়া দুই দেশের সরকার প্রধানের ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় বৃহস্পতিবার। রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরেনিয়াম বুঝে পাওয়ার মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পারমাণবিক স্থাপনায় পরিণত হয়েছে।

রাশিয়ার কারিগরি প্রযুক্তি এবং অর্থ সহায়তায় নির্মাণাধীন এই প্রকল্পের কোনো অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানিয়েছেন, বাংলাদেশের রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতায় চালু হবে ২০২৬ সালে। এই বিলম্বের বড় কারণ হচ্ছে – রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নির্মাণাধীন গ্রিডলাইন শেষ না হওয়া।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে সেই গ্রিডলাইন বা সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ কাজ সময়মতো হয়নি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে সঞ্চালনের জন্য বিশেষ একটি গ্রিডলাইন নির্মাণ করতে হচ্ছে। টাওয়ার বানিয়ে পদ্মা ও যমুনা নদীর ওপর দিয়ে সঞ্চালন লাইন পার করতে সময় লাগার কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর নতুন পরিকল্পনা হয়েছে।

বিলম্বিত সঞ্চালন লাইন

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর অন্যতম পূর্বশর্ত হলো, অবিরাম এই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা। সঞ্চালন ব্যবস্থা যথাযথভাবে সম্পন্ন না হলে সবকিছু প্রস্তুত থাকলেও বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা সম্ভব নয়। রূপপুরের ২ হাজার ৪শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেয়া হয় ২০১৮ সালে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ বা পিজিসিবির তথ্য অনুযায়ী রূপপুরের বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য ছয়টি হাইভোল্টেজ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।

জানা যাচ্ছে, সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজে সবচেয়ে জটিল প্রকল্প হলো বিদ্যুত গ্রিড নদী পার করতে ১৬টি টাওয়ার নির্মাণ করা। এর মধ্যে পদ্মা নদীতে দুটি ও যমুনা নদীর ওপর ১৪টি টাওয়ার নির্মাণ করতে হবে। সঞ্চালন লাইনের কাজের অগ্রগতি নিয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মাদ হোসাইন বিবিসি বাংলাকে বলেন, প্রথম ইউনিটের ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে যে সঞ্চালন লাইন দরকার সেটি ২০২৪ সালের অগাস্ট মাসের মধ্যে শেষ হবে। “মূল যে লাইনটা হচ্ছে, সেটা যেহেতু একটু বিলম্ব হবে এবং ইউনিট ওয়ান ২০২৪ সালে আসবে,” বলেন মি. হোসাইন।

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সচরাচর অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো নয়। কারণ, এই কেন্দ্র একবার চালু হলে চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করা সম্ভব না। তাই গ্রিড সিস্টেম যথাযথ এবং নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোদমে উৎপাদন শুরু করতে পারবেনা। মি. হোসাইন বলেন, “আামদের যে রিভার ক্রসিংগুলো আছে এবং আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের যে চাহিদা আছে, সে চাহিদা পূরণ করার জন্য প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ কাজে লাগবে। ফলে আমাদের এক নম্বর ইউনিট নিয়ে খুব একটা চিন্তা নেই।” “তবে দ্বিতীয় ইউনিট যখন আসবে তখন আমাদের যে নির্মাণাধীন গ্রিডটা আছে যেটা রিভার ক্রসিং করা লাগবে, সেটা শেষ করতে হবে। সেটা আমরা মনে করছি যে ২০২৪ সালে আসার সম্ভাবনা নেই। সেটার কাজের অগ্রগতি আছে, যদি কোনো আবার দৈব দুর্বিপাকে না পড়তে হয় তাহলে ২০২৫ সালের মধ্যে এটা শেষ হবে,” বলেন মি. হোসাইন।

চালুর আগে পরীক্ষা নীরিক্ষা

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তার স্বার্থে সার্বিক প্রস্তুতি শেষ করে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চালু করতে হয়। গ্যাস, কয়লা বা তেল যেভাবে পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রক্রিয়া তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। নিউক্লিয়ার ফুয়েল পোড়ানো হয় পারমাণবিক চুল্লিতে ফিশান বিক্রিয়ার মাধ্যমে যেখানে ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস বিভাজন ঘটে। এর ফলে প্রচুর তাপ শক্তি উৎপন্ন হয়। এই তাপশক্তিকে কাজে লাগিয়ে পানিকে বাষ্পে পরিণত করে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করে। পারমাণবিক চুল্লিতে এটি একধরনের নিয়ন্ত্রিত চেইন রিয়্যাকশন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি হাতে পেলেই রিয়্যাক্টরে লোড করে চালু করা সম্ভব নয়। তেল বা কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রর মতো পারমাণবিক কেন্দ্র সহজে চালু আবার বন্ধ করা সম্ভব নয়। প্রথম ইউনিট চালু করার জন্য আরো প্রায় এক বছর টার্গেট করা হলেও সেটিও নির্ভর করবে অনেক পদক্ষেপ সফল বাস্তবায়নের পর। ডামি জ্বালনি দিয়ে চুল্লির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।ত্রুটি ধরা পড়লে শোধরাতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এবং ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলছেন, আন্তর্জাতিক গাইডলাইন মেনে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।
“কোল্ড টেস্ট, হট টেস্ট যখন শেষ হবে তখন কিন্তু প্রকৃত ফুয়েল দিয়ে শূণ্য পাওয়ার দিয়ে আস্তে আস্তে ফুল পাওয়ারে যেতে হয়। এই যে দীর্ঘ যাত্রা এটাতে আমি মনে করি ছয় মাসের মতো লাগে, যদি সবকিছু ঠিক থাকে”। মি. ইসলাম বলছেন, “ রেগুলেটরি বডির ওপরেও নির্ভর করে অনেক কিছু। কারণ রেগুলেটরি বডি অনুমতি না দিলে কিন্তু এটা চালাতে পারবে না। কারণ রেগুলেটরি বডি আগে দেখবে যে এখানে সমস্ত কিছু ঠিক আছে কী না। তারপর নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কী না। টেস্টগুলো সফল হয়েছে কী না। এগুলো তাদের পরীক্ষা করতে অনেক সময় লাগে”।

বিদ্যুৎ কবে পাওয়া যাবে

রূপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটে উৎপাদন ক্ষমতা হবে ২৪০০ মেগাওয়াট। এর প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে যে জ্বালানি লাগবে সেটি বাংলাদেশে আসা শুরু হয়েছে। রাশিয়ায় বিশেষভাবে প্রস্তুত এ জ্বালানি আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝে নিয়েছে বাংলাদেশ। জ্বালানি আসার বিষয়টিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ।

বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন কী প্রক্রিয়ায় চালু হবে? এমন প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর বলেন, নির্মাণ থেকে শুরু করে অপারেশনে যাওয়ার জন্য যেসব শর্ত পূরণ করতে হয় সেগুলো তারা অর্জন করেছেন। “আমরা প্রস্তুত হচ্ছি রিয়েল ফুয়েল লোড করার জন্য। টাইমলাইন হচ্ছে আগামী সেপ্টেম্বরে আমাদের প্রথম ইউনিট গ্রিডের সাথে যুক্ত হবে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করবো”।

মি. আকবর বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র একটা স্তর থেকে আরেকটি স্তরে যাওয়ার আগে কাজ শতভাগ সম্পন্ন কী না সেটা নিশ্চিত করতে হবে। “আমাদের ফুয়েল লোডিং ফিজিকাল স্টার্টআপ, গ্রিড কানেকশন সিংক্রোনাইজেশন এইগুলো নির্ভর করতেছে আমাদের অন্যান্যা অবকাঠামোর পর,” বলেন মি. আকবর।

গ্রিড লাইনের বিলম্বের বিষয়টি নিয়ে শৌকত আকবর বলেন, প্রথম ইউনিটকে চালু করার জন্য কোন লাইনগুলো আসতে হবে সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এবং কীভাবে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আনা যাবে সেটার জন্য একটা অ্যাকশন প্ল্যান করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, এটা আসলে বাংলাদেশের সিনারিও বদলে দেবে। তার ভাষায় অনেক দেশ ‘বাংলাদেশের কাজের অগ্রগতি দেখে হতবাক’। “অন্যান্য দেশে এটা দশ বছর বারো বছরের বেশি লেগেছে। সেখানে আমরা সাত বছরে যেখানে এসেছি সেটা আশা করি প্রশংসা করবেন আপনারা সবাই”। “এর সাথে কেবল আমরা একা না, এরপর ট্রান্সমিশন লাইন আছে, টেস্ট হবে নানা রকম। সেই সময়টা তো দিতেই হবে। আমার ধারণা, সেটার জন্য সর্বোচ্চ দেড় বছর সময় লাগতে পারে। তার মধ্যে এটা সাধারণ মানুষের কাছে যাবে বলে আমরা আশা করি”। – বিবিসি নিউজ বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *