নৌ দুর্ঘটনায় ২১ বছরে ২০ হাজার মানুষের প্রাণহানি

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

নাছির উদ্দিন শোয়েব : নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যায় পণ্যবাহী জাহাজের ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত আট জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ ঘটনায় কার্গো জাহাজটির মাস্টারসহ (চালক) ৯ জনকে আটক করা হয়েছে। কার্গো জাহাজ এবং ধাক্কায় ডুবে যাওয়া লঞ্চের দুই চালকই বেপরোয়া গতিতে চালাচ্ছিলেন বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শামীম বেপারী। এ ঘটনার তিনমাস আগে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৪ জনের মৃত্যু হয়।

ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনার গঠিত তদন্ত কমিটি ২০টি সুপারিশ করে। অভিযোগ রয়েছে- একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও তদন্ত কমিটির কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় না। শীতলক্ষায় কার্গো জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চডুবির ঘটনায়ও অভিযুক্ত জাহাজ এবং লঞ্চের চালককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এমনকি প্রাথমিক তদন্তেও এরকম তথ্য উঠে এসেছে। এদিকে নৌ-পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার কারণে নারায়ণগঞ্জে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সেভ দ্য রোড’। এ অবস্থায় নৌ-পুলিশকে আরও দায়িত্বশীল হতে আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এমন মন্তব্য করে সংগঠনটি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্ঘটনায় শত শত প্রাণহানি হলেও লঞ্চডুবি রোধে নেয়া হয়না কার্যকর কোনো ব্যবস্থা। ফিটনেস না থাকা, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই, ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করাসহ কোনো ঘটনাতেই বিচার না হওয়ায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে। লঞ্চডুবির পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তবে এসব কমিটির সুপারিশ কখনো বাস্তবায়িত হয় না। বেসরকারি সংস্থা কোস্ট বিডির গবেষণা অনুযায়ী, গত ২০ বছরে বাংলাদেশের নৌপথে বড় ১২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, এতে দেড় হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। এ ছাড়াও আরও বহু নৌ দর্ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, গত ২১ বছরে ছোট-বড় প্রায় ৭শ লঞ্চডুবিতে মারা গেছেন ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ।
অথচ নৌ দুর্ঘটনা রোধে আইন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা রয়েছেন। রয়েছে কঠোর নজরদারির নির্দেশনা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, চালক, শ্রমিক এবং সরকারি দফতরসমূহের মধ্যে রয়েছে মারাত্মক সমন্বয়হীনতা। ক্ষেত্র বিশেষে কোথাও নৌযান মালিক ও শ্রমিকদের হাতে সরকারি দফতর অসহায়। আবার কোথাও কোথাও সরকারি দফতরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার উদাসীনতায় বেগ পেতে হচ্ছে। এই অবস্থায় সবার সমন্বিত উদ্যোগ না থাকলে নৌপথে প্রাণহানি রোধ করা সম্ভব নয়।

জানা গেছে, সরকারি হিসেব মতে, বিগত ৪২ বছরের মধ্যে প্রথম ১২ বছর অর্থাৎ ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নৌদুর্ঘটনা তুলনামূলক কম ছিল। এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েছে। পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান যাত্রী কল্যাণ সমিতির দেয়া তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত নৌপথে ৬০১টি দুর্ঘটনায় ৭৭৩ জন নিহত হন। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ১৫৯টি নৌদুর্ঘটনায় ১২৬ জন, ২০১৯ সালে ২০৩টি নৌদুর্ঘটনায় ২১৯ জন নিহত, ২০২০ সালে ১৮৩টি নৌ দুর্ঘটনায় ৩১৩ জন নিহত হন। নৌপরিবহন দফতরে সংরক্ষিত তথ্য মতে, হিসেব শুরুর বছর ১৯৭৬ সালে দেশে কোনো নৌদুর্ঘটনা ঘটেনি। আর একজন মানুষও মারা যায়নি। তবে ১৯৭৭ সালে পাঁচটি দুর্ঘটনায় ২৯ জন, ১৯৭৮ সালে ৭ দুর্ঘটনায় ২০ জন, ১৯৭৯ সালে ৮ দুর্ঘটনায় ৭৩ জন, ১৯৮০ সালে একটি দুর্ঘটনায় ৪ জন, ১৯৮১ সালে ৩ দুর্ঘটনায় ২০ জন মারা যায়।

২০২০ সালের ২৯ জুন সকাল সাড়ে ৯টায় বুড়িগঙ্গার শ্যামবাজার উল্টিগঞ্জ পয়েন্টে ঢাকা-চাঁদপুর রুটের ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ রুটের এমবি মর্নিং বার্ড লঞ্চ ডুবে যায়। এ ঘটনায় ৮ জন নারী, ৩ জন শিশুসহ ৩৪ জন যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। মর্নিং বার্ড লঞ্চ ডুবির ঘটনায় গত বছরের ৭ জুলাই সচিবালয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে তদন্ত কমিটির সুপারিশের বিস্তারিত তুলে ধরে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। তাতে সদরঘাট টার্মিনালের আশেপাশে খেয়াঘাট না রাখাসহ ২০ দফা সুপারিশ করা হয়। নৌ আইনে শাস্তির মেয়াদ ও জরিমানার পরিমাণ যুযোপযোগী করে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিতে বলা হয়। কিন্তু দায়িদের বিষয়ে কিছুই প্রকাশ করা হয়নি। এতে বলা হয় সদরঘাটের ভাটিতে ৭/৮ কিলোমিটার ও উজানে ৩/৪ কিলোমিটার বার্দি উঠিয়ে দিতে হবে। এ অংশে পল্টুন ছাড়া নৌযান নোঙ্গর করা যাবে না। পর্যায়ক্রমে সেখান থেকে শিপইয়ার্ড ও ডকইয়ার্ড উঠিয়ে দিতে হবে। যান ঘাট ছাড়ার পূর্বে ভয়েজ ডিক্লেরেশন দিতে হবে। এছাড়া সদরঘাটে পল্টুনের সংখ্যা বৃদ্ধি, ফিটনেসবিহীন লঞ্চ বন্ধ, নৌযানের গতি নির্ধারণ করে কন্ট্রোল টাওয়ার স্থাপন করার সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।

এদিকে ২০১৪ সালের ৪ অগাস্ট আড়াইশোর বেশি যাত্রী নিয়ে পদ্মা নদীতে ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ। নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, ওই লঞ্চটি তোলা সম্ভব হয়নি, এবং এর ধ্বংসাবশেষও কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছিল, আর ৫০ জন যাত্রীর খোঁজ পাওয়া যায়নি। বাকীরা সাঁতরে এবং জেলেদের সহায়তায় তীরে উঠতে পেরেছিলেন।

২০০৩ সালের ৮ই জুলাই ঢাকা থেকে ভোলার লালমোহনগামী এমভি নাসরিন-১ নামের লঞ্চটি চাঁদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় ডুবে যায়। বিআইডব্লিউটিএ বলছে, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালবোঝাইয়ের কারণে লঞ্চটির তলা ফেটে গিয়েছিল। ডুবে যাওয়ার সময় লঞ্চটিতে কত যাত্রী ছিলেন সে বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। তবে ওই দুর্ঘটনায় সরকারি হিসাবে প্রায় সাড়ে ছয়শো লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।

২০০২ সালের ৩ মে চাঁদপুরের ষাটনল সংলগ্ন মেঘনা নদীতে ডুবে যায় সালাহউদ্দিন-২ নামের যাত্রীবাহী লঞ্চ। এতে ভোলা এবং পটুয়াখালীর প্রায় চারশো যাত্রী মারা গিয়েছিলেন। ওই দুর্ঘটনার পর নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের করা একটি তদন্ত কমিটি নকশামতো লঞ্চ নির্মাণ না করায় মালিককে এবং অতিরিক্ত যাত্রী বহনের জন্য মাস্টারকে অভিযুক্ত করে। এতে ওই লঞ্চের মালিককে জরিমানা এবং মাস্টারকে চাকরিচ্যুত করা হলেও অন্যদের শাস্তি হয়নি।

২০০০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঈদুল আজহার রাতে চাঁদপুরের মতলব উপজেলার ষাটনল এলাকায় মেঘনা নদীতে এমভি জলকপোত এবং এমভি রাজহংসী নামের দুটি যাত্রীবাহী লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে রাজহংসী লঞ্চটি পানিতে তলিয়ে যায়, সে সময় ওই লঞ্চের ১৬২ জন যাত্রী নিহত হয়েছিলেন। এদিকে ১৯৮৬ সালে অ্যাটলাস স্টার নামে একটি লঞ্চ ডুবে ২০০ জন যাত্রী মারা গিয়েছিলেন। লঞ্চটি ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন এবং খারাপ আবহাওয়ার কারণে ডুবে গিয়েছিল বলে জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। এছাড়া ২০০৫ সালে একটি ফেরী ডুবে গিয়ে ১১৮জন যাত্রী নিহত হন, এবং ২০০৫ সালে এমএল মিতালি ও এমএল মজলিশ নামে দুইটি ছোট লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষের পর ডুবে গিয়ে প্রায় ৩০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, নদীর নাব্যতা ফেরাতে যেমন ড্রেজিং দরকার তেমনি সব নৌযানের ক্যাপাসিটি ঠিক রাখতে হবে। এজন্য নৌযানগুলোর ফিটনেস সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। দেশের ৯০ শতাংশ নৌযানের ফিটনেস নেই। সেখানে দুর্ঘটনা তো ঘটবেই।

নৌ-পুলিশের অবহেলায় নারায়ণগঞ্জে দুর্ঘটনা: নৌ-পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার কারণে নারায়ণগঞ্জে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সেভ দ্য রোড’। এ অবস্থায় নৌ-পুলিশকে আরও দায়িত্বশীল হতে আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি। গতকাল সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এমন মন্তব্য করে সংগঠনটি। বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনের মহাসচিব শান্তা ফারজানা বলেন, নৌ-পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার কারণে নারায়ণগঞ্জে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার পর তারা এসে গণমাধ্যমের সামনে বিভিন্ন কথা বলেন। কিন্তু তাদের দায়িত্ব কি এ পর্যন্তই? তিনি বলেন, নৌযানের রুট পারমিট পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চলাচলের শৃঙ্খলা বজায় রাখা, নৌপথে যাত্রীদের অধিকার রক্ষাসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে নৌ-পুলিশের চরম অনীহার কারণে নৌপথে ক্রমশ দুর্ঘটনা বেড়ে চলছে। এমনকি দুর্ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, নৌ-পুলিশের একটি টিমও কাছাকাছি কোথাও অবস্থান করছিল না। দুর্ঘটনার এক ঘণ্টা পরও তারা এসে পৌঁছাতে পারেনি বলেও স্থানীয়রা আমাদের জানিয়েছেন। শান্তা ফারজানা আরও জানান, নৌ-পুলিশ যদি দুর্ঘটনা কমাতে কোনো ভূমিকা না রাখে, কেবল ঘাট ইজারা, তদারকি, মাছ খাওয়া আর জনতার রক্ত পানি করা অর্থে বেতন নেয়ার জন্য কি তাদের খুব বেশি প্রয়োজন? তা যদি না হয়, তাহলে অবশ্যই নৌ-পুলিশকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তর-উপদপ্তরে কেবল লিজ, বালু মহাল, টেন্ডারবাজি চললেও নৌপথকে দুর্ঘটনামুক্ত রাখতে তাদের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এর আগে সোমবার সকালে সংগঠনটির প্রতিনিধিরা নারায়ণগঞ্জের সৈয়দপুর কয়লা ঘাট এলাকা পরিদর্শন করেন। পরে দুর্ঘটনায় ডুবে যাওয়া লঞ্চে থাকা নিখোঁজদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেন তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *