নির্বাচন অবাধ না হলে কারো রক্ষা নেই

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সুরঞ্জন ঘোষ

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও ভোটের অধিকারের জন্য বিএনপিসহ সব বিরোধী দল আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন সভা সমাবেশ করে এখন হরতাল ও অবরোধের ডাক দিয়েছে জাতির প্রয়োজনে। তাদের একটাই দাবি ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা। এই দাবির সাথে দেশ ও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থনও আছে।

দেশকে সঙ্ঘাতের হাত থেকে রক্ষা এবং জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন দেয়াই সঙ্কটের একমাত্র সমাধান। তা না হলে কারো রক্ষা নেই। দেশে মহা বিপর্যয় নেমে আসবে।

বাংলাদেশে স্বৈরাচারের পতন হয়েছিল। গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য একটি নিরপেক্ষ অরাজনীতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়েছিল; আজ বাংলাদেশ সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। বাংলাদেশের এ চাওয়া এখন অনেকের মুখেই উচ্চারিত হচ্ছে। গণতন্ত্রে উত্তরণের, গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করার এটাই এখন একমাত্র উপায়।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কোনো সুস্থ ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি, গড়ে ওঠেনি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ; কারণ দশকের পর দশক ধরে এ অঞ্চলে চলেছে গণতন্ত্রবিরোধী স্বৈরাচারের ধারা। এ দেশের মানুষ আইয়ুব থেকে এরশাদকে ঘেন্না করেছে, অনেক রক্তের মূল্যে তাদের তাড়িয়েছে; কিন্তু কোনো সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দীক্ষিত হতে পারেনি। বাংলাদেশ কোনো দলের ওপরই সম্পূর্ণ আস্থা পোষণ করার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আসেনি। বাঙালি নিয়মিত ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায়নি, তাই ভেবেচিন্তে ভোট দেয়া এখনো আসেনি বাঙালির স্বভাবের মধ্যে। অধিকাংশ সময় তাদের ভোট চুরি হয়ে গেছে; তারা ভোট না দিলেও ক্ষমতাসীন প্রার্থীদের বাক্স উপচে ভোট পড়েছে; তবে তিনবার তারা ভোট দিয়েছে প্রবল জাতীয় আবেগে অনুপ্রাণিত হয়ে। সে ক’বারই তারা ঘটিয়েছে মহাঘটনা।

এখন একটি সুস্থির কলহহীন গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত বাংলাদেশ দরকার; আর এ জন্য দরকার একটি ‘নির্বাচিত তত্ত্বাবধায় সরকার’, যার কাজ হবে বাংলাদেশের শরীর থেকে স্বৈরাচারের ছাপ পুরোপুরি মুছে ফেলা, তার মন থেকে স্বৈরাচারের সমস্ত কলুষ পরিচ্ছন্ন করা, দেশকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত করা। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দলগুলো নিজেরাও হয়ে উঠবে গণতান্ত্রিক, মানুষের জন্য ত্যাগ করতে শিখবে স্বার্থ, পেশির বদলে গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবতে শিখবে কল্যাণমুখী কর্মসূচি। এ প্রক্রিয়ায় দলগুলো মুক্তি পাবে পেশল মাস্তান ও লোলুপ রাজনীতিকদের কবল থেকে, রাজনীতিকরা শিখবেন দায়িত্ববোধ বা রাজনীতি। আগাছা দলগুলোর পুলকিত বিকাশের রোগ থেকেও মুক্তি পাবে বাংলাদেশ।

যদি দলগুলো আলোচনার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে পারে, তবে প্রকৃতপক্ষে তারা গঠন করবে নিজেদের এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। একটি সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যই এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার, বাংলাদেশ সেটিই চায়।

কিভাবে গঠিত হবে এই নির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার? দলগুলো কোথাও বসে মিলেমিশে এটা গঠন করবে। শুধু নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের নিয়মটা একটু বদলে দিতে হবে। প্রচলিত গণতন্ত্রে পাস মানে পাস, আর ফেল মানে ফেল; মাঝামাঝি কিছু নেই। পাস-ফেলের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নয়, মোট ভোটের পরিমাণ অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা কঠিন ব্যাপার নয়, যদিও কঠিন হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন সম্পর্কে মতৈক্যে পৌঁছানো। শতকরা পনেরো থেকে আরো বেশি ভোট পাওয়া দল থেকে আনুপাতিক হারে সদস্য নিয়ে গঠিত হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ভোটের হার অনুসারে হবে সংসদে ও মন্ত্রিসভায় দলগুলোর সদস্য সংখ্যা- এমন একটি নীতিতে সম্মত হওয়া কঠিন নয়, যদি আমরা ক্ষমতার জন্য উন্মত্ত না হয়ে থাকি। মনে রাখা খুবই উপকারী হবে যে, ক্ষমতা কারো চিরকাল মুঠোতে থাকে না।

নিজেদের চর্বিশোভিত মুখ দেখানোর জন্য এ সরকার হবে না, এর কাজ হবে সমস্ত দুর্নীতির বিচার করা, এর কাজ হবে জাতিকে গণতান্ত্রিক করে তোলা, এর দায়িত্ব হবে দেশের ভাঙা অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড জোড়া লাগানো; এর কাজ হবে দেশে সমস্ত মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা।
আমাদের সরকারগুলো নিজেদের দায়িত্ব বলতে যা বোঝে, তার এ জন্য গণ-অভ্যুত্থানের অগ্রপথিক যারা, সেই ছাত্রসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা ও সেøাগান নিয়ে; তাহলেই তা ঢুকবে রাজনীতিকদের দৃষ্টিতে ও শ্রুতিতে। এগিয়ে আসতে হবে জনসাধারণকে, যাদের কণ্ঠস্বর বা মুখচ্ছবি কোনো সম্প্রচার মাধ্যমে সম্প্রচারিত হয়নি, যারা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করতে যাবে না।

সাধারণ মানুষ ভোট দিতে সাধারণত ভুল করে না। ভুল লোককে ভোট দেয় না। শুদ্ধ নির্বাচন হলে তা স্পষ্ট ধরা পড়ে। ১৯৯১-২০০৮ এ তারা ভোট দিতে পেরেছে এবং সব কিছু বদলে দিয়েছে। আরেকবারও জনগণ নির্ভুলই ভোট দিয়েছিল; কিন্তু বিশ্বাসঘাতক প্রার্থীরা কথা রাখেনি। ফাতেমা জিন্নাহ আইয়ুব খান প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় জনগণ ঠিকই ভোট দিয়েছিল। সেটা মৌলিক গণতন্ত্রের যুগ। জনগণ নির্বাচন করত মৌলিক গণতন্ত্রী আর মৌলিকেরা নির্বাচিত করত অমৌলিক প্রেসিডেন্ট। তখন দেশে এমন জোয়ার এসেছিল যে আইয়ুবের নাম নেয়ার সাহস ছিল না কোনো গণতন্ত্রীর। প্রতিটি মৌলিক গণতন্ত্রীই প্রচারপত্রে, পোস্টারে ঘোষণা করেছিল সে ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে। ফাতেমা জিন্নাহর নামে তারা বিজয়ী হলো। তার পর শুরু হলো মৌলিক গণতন্ত্রের খেলাধুলা। আইয়ুব খান গোপনে কিনে নিলো মৌলিক গণতন্ত্রীদের এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দেখা গেলো ফাতেমা জিন্নাহর নামে বিজয়ী বিশ্বাসঘাতকেরা ভোট দিয়েছে আইয়ুব খানকে। ভোটারদের সাথে সেটা ছিল এক মর্মস্পর্শী বিশ্বাসঘাতকতা। যদি সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার থাকত, তাহলে ১৯৬৬ তেই ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতো আইয়ুব খান। কিন্তু নির্বাচনের প্রহসন তাকে ঠেলে দেয় ট্র্যাজেডির দিকে। তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়।

বাঙালি জাতির ও আমাদের একটি স্বপ্ন আছে; একটি শুদ্ধ নির্বাচনের স্বপ্ন। দেখতে পাই সুন্দরভাবে তৈরি হয়েছে ভোটার তালিকা, তাতে ভোটার ও পিতার নামটি লেখা হয়েছে শুদ্ধভাবে। নির্বাচনে এটা আমার প্রথম আনন্দ। এরপর দেখতে পাই ভোটাররা যাচ্ছে ভোটকেন্দ্রে, গোপনে ভোট দিচ্ছে প্রিয় প্রার্থীকে। তার পর ভোট গোনা ও ঘোষণার পর্ব। দেখতে পাই নিরপেক্ষভাবে গোনা হচ্ছে প্রতিটি ভোট ও ভোটকেন্দ্রেই কেন্দ্রের কর্তা ঘোষণা করছেন ফলাফল। এটা অবশ্যই এক অলৌকিক স্বপ্ন। কখনো কি তা বাস্তব রূপ পাবে?

তৃতীয় বিশ্বে নির্বাচন এক করুণ হিংস্র্র প্রহসন; কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে অভিনীত হয়ে থাকে এ রাষ্ট্রীয় রঙ্গনাট্য। বাংলাদেশেও একটি নির্বাচন আসন্ন। গত আড়াই দশকে আমাদের দেশে নির্বাচনী ব্যাকরণের সূত্র দারুণভাবে বদলে ও বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। এতে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি হচ্ছে নির্বাচনে এখন ভোটারের কোনো স্থান নেই, ভূমিকা নেই। ভোটাররা এখন তালিকাবদ্ধ কিছু অশুদ্ধ নামের সমষ্টি। তারা ব্যক্তি নয়। ছেলেবেলায় আমি ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচন দেখেছি। তা যে পুরোপুরি বিশুদ্ধ ছিল তা নয়; তবে তাতে ভোটারের একটা ভূমিকা ছিল। ধনাঢ্য প্রতাপশালী প্রার্থীরা গরিব ভোটারদের বাড়িও যেত, তোষামোদ করত। ভোটারের তখন অন্তত স্বল্পস্থায়ী সামাজিক মূল্য ছিল; এবং ভোটের ছিল কিছুটা অর্থমূল্য।

এক দশকের মধ্যে ভোটারের সে সম্মান লুপ্ত হয়ে যায় এবং ভোটের অর্থমূল্য বিনষ্ট হয়। তখন প্রার্থীরা ভোটারদের তোষামোদ করার বদলে, ভোট কেনার বদলে নিয়োগ করে ভোটষণ্ডা। ভোটষণ্ডারা খুব আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত থাকত না, ব্যক্তিগত পেশিই ছিল তাদের প্রধান অস্ত্র। তাদেরও কিছুটা মূল্যবোধ ছিল। বাক্সে ভোট পড়তে হবে এবং তা গুনতে হবে, এমন একটা ধ্রুপদী ধারণায় তারা বিশ্বাসী ছিল। তাই তারা নিজেদের প্রার্থীর বাক্সে ব্যালট ঢোকাত। যারা বেশি ঢোকাতে পারত, তাদের প্রার্থীই জিতত।

এরপর আসে নির্বাচনের আগ্নেয়াস্ত্রিক ও টেলিভিশনিক পর্ব। এ পর্বে ভোটার সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনী হয়ে পড়ে; মুখ্য হয়ে ওঠে আগ্নেয়াস্ত্র ও প্রচারযন্ত্র। ভোটারের সম্মান তো আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এ পর্বে তার জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়ে। ভোট হয়ে ওঠে মূল্যহীন। ২০১৪ এবং ২০১৮ এর দলীয় মাস্তান ও অস্ত্রধারীদের খেলা হয়েছে। নির্বাচনে যারা বিজয়ী হয়ে এসেছে, তাদের মুখের দিকে তাকালে কি মনে হয় যে তারা নির্বাচনে বিশ্বাস করে? তারা বিশ^াস করে অন্য কিছুতে। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, ভোটেও না। তাদের এই একতরফা হিটলারি কাজ কারবার দেশকে, দেশের মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে এক প্রলয়ের দিকে, যে প্রলয়ের ধ্বংসলীলা থেকে তারা, আমরা, কেউই রেহাই পাব না।

  • সুরঞ্জন ঘোষ নব্বইয়ের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ঐকের সাবেক ছাত্রনেতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *