নতুন বছর নতুন স্বপ্নের কথা ।। জাকির আবু জাফর

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

“সময় তার জন্য অপেক্ষা করে যে সময়কে কাজে লাগায়”- কথাটি বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির। চোখ কপালে ওঠার মতো বাণী! তাই নয় কি! কেননা ‘সময় এবং স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না’ চিরকাল এ কথাই তো সবাই আওড়ায়। এবং এটিই সত্যি! এটিই আমরা জানি। আমাদের আগের লোকেরা তাই জানতো। পরের লোকও তা-ই জানবে। অথচ লিও ভিঞ্চি কেমন করে উগ্রালেন- সময় অপেক্ষা করে! এটি বিস্ময়ের নয় কি! নিশ্চয় বিস্ময়কর! বলা যায়- অতি বিস্ময়কর!

জগতে কারও জন্যে সময় অপেক্ষা করে কি! না করে না। কারও জন্য অপেক্ষা করেছে কি! না, করেনি। কারও জন্যেই করেনি! করবেও না কখনও, কোনোদিন! কিন্তু লিওনার্দো কথাটি কেনো বললেন! কেনো জগতের সবার ধারণার বাইরে গিয়ে উচ্চারণ করলেন এমন বাণী! তার কথা কি বিশ্বাস করা যায়! গলা উঁচু করে বলতেই পারি- না, বিশ্বাস করা যায় না। বিশ্বাস করি না!
হ্যা বিশ্বাস না করারই কথা! তবুও ধাক্কা সামলিয়ে খানিক ভাবা যাক। ভাবলেই হয়তো বিষয়টি খোলাসা হবে!

লিওর কথাটির অর্থ এই নয়- সময় কারও জন্য বসে থাকে বা থাকবে। সময়কে সে যেতে বললে চলে যাবে। থাকতে বললে থেকে যাবে! না না একদম এটি নয়। এর অর্থ- সময়কে পরিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করার একটি উচ্চ উচ্চারণ! যিনি বা যারা সময়কে যথার্থ ব্যবহার করেন, কাজে লাগান, সময় তাদের মূল্য দেয়। তাদের মাথা উঁচু করে তোলে। তাদেরকে মর্যাদাবান করে। পরিবারে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাত্রায় থাকেন। সমাজের চোখে তারা সম্মানিত। রাষ্ট্রের কাছে তারা বরেণ্য। এমনকি পৃথিবীর কাছে তারা শ্রেষ্ঠ মানুষ।
যিনি সময় নষ্ট করেন না সময় তাকে চূড়ায় পৌঁছে দেয়। যিনি অপচয় করেন না, সময় তার পক্ষে দাড়িয়ে যায়। যিনি অবহেলা করেন না, তাকে প্রয়োজনীয় করে তোলেন।

সময়ের যথার্থ ব্যবহারের মধ্যেই রয়েছে সময়ের মর্ম। সময়ের কাজ সময়ে করলেই সময় তার হয়ে ওঠে। সময়কে কাজে লাগালেই সময় তাকে কাজের করে নেয়। তিনি পরিকল্পনা সাজিয়ে রাখেন সময়ের অপেক্ষায়। সময় আসে, অমনি বাস্তবতায় রূপ দেন পরিকল্পনাটি। অর্থাৎ সময়কে কাজের সাথে জড়িয়ে রাখার অদ্ভুত আয়োজন করেন। ফলে সময় তাকে ফাঁকি দিয়ে উধাও হওয়ার আগেই তিনি সময়কে ব্যবহার করেন। সময় হয়ে ওঠে কাজের মানুষের। এ অর্থেই লিওনার্দো ভিঞ্চি কথাটি বলেছেন।

ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রা.। তিনি বিশ্ব জ্ঞানীদের অন্যতম একজন। তাঁর একটি অসাধারণ বাণী আছে সময় ঘিরে। তিনি বলেছেন – “যারা সময়ের সদ্ব্যবহার করে তারাই জীবনে সাফল্য লাভ করে।” কী অসাধারণ বাণী। এর সাদা অর্থ- সাফল্য পেতে হলে সময়ের যথার্থ ব্যবহার করেই হতে হবে। সময়ের যথার্থ ব্যবহার ছাড়া কোনো কাজে সাফল্যের আর কোনো দরোজা কিংবা জানালা নেই। আর কোনো পথও নেই খোলা।

সময় মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় পুঁজি। একে যথাযথ বিনিয়োগ করতে জানতে হয়। করতে হয় যথার্থ বিনিয়োগ। সময় বিনিয়োগে ভুল হলে, জীবনই ভুল হয়ে যায়। জীবনে সাফল্য আসবে না। আসতে পারে না। সময় বিনিয়োগ করার কৌশলে পারদর্শী ব্যক্তিই জীবনকে তুলে নেন চূড়ার দিকে।

চার্ল ডিকেন্স একজন সমাজ বিজ্ঞানী। সময় নিয়ে তার কথাটি স্মরণ করা যায়। তিনি বলেছেন- ” বড় হতে হলে সর্বপ্রথম সময়ের মূল্য দিতে হবে।” হ্যা দিতেই হবে। এর সাথে দ্বিমত কিছু নেই। বিকল্পও নেই কিছু। এর সাথে দ্বিমত কিংবা অন্য মত নেই! থাকার কথা নয়। নেইও।

সময় পৃথিবীর সবচেয়ে দামী বিষয়। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বিষয়। হিরে মণি মুক্তা সোনা রুপা যা-ই উল্লেখ করি না কেনো, কোনোটিই সময়ের মতো মূল্যবান নয়!

বিস্ময়ের দিক হলো- কত সহজেই না এমন দামী জিনিস খরচ করে ফেলে মানুষ। অকাজে অবহেলায় খরচ হয়ে যায়। এমন দামী বিষয়ের দিকে চোখা নজর দিতে হবে। দিতেই হবে। নইলে জীবন কোনোভাবেই জীবনের জায়গায় থাকে না। থাকবে না।

সময় তার নিয়মেই বয়ে যায়। বয়ে যায় নদীর মতো। নদীর স্রোতের মতো। ঝরা ফুলের মতো। ঘাসের ডগার শিশিরের মতো। বৃষ্টির ফোঁটার ঝরে যায় সময়ের সোনালি ফোঁটাগুলো। আমরা কিংবা লোকেরা সময়ের অবমূল্যে অভ্যস্ত। সময় প্রয়োজনে খরচ হয়। হবেই। অপ্রয়োজনেও খরচ হয়। খরচ হয়ে যায় দেদারসে। হিসাবহীন এ খরচের হিসাব কে রাখে। কিইবা রাখে। সময়ের দিকে তাকানোর অবসরই কই মানুষের। অথচ দ্বিধাহীন বলা যায়- সময়ই জীবন। জীবন সময় নয়। কেননা সময় শেষ তো জীবনও শেষ। সময় যেটুকু সময় দেয়, ততটুকুই জীবন! আহা জীবন! আহা সময়! কেমন করে চলে যায়। কেমন করে ছুঁয়ে যায় বিন্দু বিন্দু করে! কেমন করে হারায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে!

একটি একটি করে ঝরে যায় সময়ের পালক। সময়ের যে মুহূর্ত জীবনকে একবার স্পর্শ করে সে আর ফিরে না। কখনও না। একবারই আসে সময় স্রোত। একবারই ছুঁয়ে যায়। যায় চিরদিনের জন্য। এইযে সময়ের চলে যাওয়া, একে ঠেকানোর কোনো মন্ত্র জানা নেই মানুষের। কোনো কৌশলও জানে না মানুষ। তাই প্রতিটি জীবনের উচিৎ সময়কে সময় মতো কাজে লাগানো।

আজ যে সময়ের প্রতি অবহেলা করে, কাল সময় তাকে অবহেলা করবে। আগের সময়কে গুরুত্ব না দিলে পরের সময় তাকে গুরুত্বহীন করে তুলবে। তাই নিজেকে উন্নতির দিকে নিতে হলে সময়কে কাজে লাগাতেই হবে। সময়ের কাজ সময়ে করতেই হবে। নিজেকে করে নিতে হবে সময়োপযোগী।

সময়ের সঙ্গে না চললে অগ্রগতি থেমে যায়। পিছিয়ে পড়ে জীবন। ধীরগতি হয়ে যায়। সহজে আসে না সাফল্যের মুখ। সময়োপযোগী হওয়া মানে আধুনিক হওয়া। আধুনিক মানুষ সময়কে সময় মতে ব্যবহার করে।

একথা বলতেই হবে – সময়ের মূল্য বোঝেন জ্ঞানী মানুষ। মূল্য বোঝেন, যারা নিজেকে নির্মাণ করতে চান। তারাই বোঝেন, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চান যারা।

মানুষ জীবনে কত কি অপচয় করে। অর্থ অপচয়। সম্পদ অপচয়। কথার অপচয়। আরও আরও কত কি অপচয় । কিন্তু জীবনে সবচেয়ে বড় অপচয় হলো সময়ের অপচয়। সময়ের মতো অপচয় আর নেই। প্রতিটি মানুষকে তাই সময়ের অপচয় থেকে বিরত শুধু নয়, সাবধান থাকা উচিৎ।

বিশ্বখ্যাত কবি এলিয়ট বলেছেন- “জীবন ছোট এবং সময় দ্রুতগতি সম্পন্ন। ফুল ঝরে পড়ে এবং ছায়া শীঘ্রই সরে যায়।” সত্যিই জীবন ছোট। অতি ছোট। ছোট জীবন খরচ হয়ে যায়। খরচ হয় ইচ্ছায় অনিচ্ছায়। তবে এই খরচ যেনো অর্থপূর্ণ হয়। যেনো অপ-খরচ না হয়।
নতুন বছর নতুন করে এলো। পুরনো ঝরে গেলো বৃক্ষের পাতার মতো। বছর নতুন, কথা ঠিক। কিন্তু সময়তো চির নতুন। সময় কখনও পুরনো হয় না। সময় সবসময় নতুন। সকাল নতুন। দুপুর নতুন। বিকেল নতুন। সন্ধ্যা এবং রাতও নতুন। প্রতিটি ভোর এবং প্রভাত নতুন। মানুষের হিসেবে মাস বছর পুরনো হয়। কিন্তু সময় কখনও পুরনো হয়ে ফিরে না। তবুও নতুন বছর বলে কথা। নতুন বছরে নতুন স্বপ্ন নিয়ে এগুতে হবে। এগুতে হবে নতুন পরিকল্পনায়। সময় মতো মূল্য দিতে হবে সময়ের। তবেই সময় মূল্য দেবে আপনাকে।

* জাকির আবু জাফর কবি, গীতিকার ও আবৃত্তিকার। সাহিত্য সম্পাদক দৈনিক নয়াদিগন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *