তারেক রহমানের বক্তব্য নিয়ে বিতন্ডা : এজলাস ছাড়লেন দুই বিচারপতি

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে অপসারণের নির্দেশকে কেন্দ্র করে তুমুল হট্টগোল হয়েছে হাইকোর্টে। হৈ চৈয়ের একপর্যায়ে এজলাস ছেড়ে চলে যান দুই বিচারপতি।

গতকাল সোমবার বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান এবং বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের ডিভিশন বেঞ্চে এ ঘটনা ঘটে। আইনের দৃষ্টিতে ‘পলাতক’ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিবৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে অপসারণ করতে বিটিআরসিকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে রিট মঞ্জুর হয়। এর পরপরই হট্টগোলের ঘটনা ঘটে।

গতকাল সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে বিচারপতি মো: খসরুজ্জামান এবং বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের ডিভিশন বেঞ্চ আবেদন মঞ্জুর করেন। এরপর আদালতে উপস্থিত হয়ে এ নিয়ে আপত্তি জানান তারেক রহমানের আইনজীবী। সকাল ১০টা ৪০ মিনিটের দিকে তারেক রহমানের আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী আদালতের উদ্দেশে বলেন, আমরা আপনার বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির কাছে অনাস্থা জানিয়ে এসেছি। আপনি বায়াসড। পক্ষপাতদুষ্ট বিচারক।

আপনার কাছ থেকে আমরা ন্যায় বিচার পাবো না। এ কারণে আপনার কোর্টে তারেক রহমানের কোনো মামলা চলতে পারে না। এ সময় বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান বলেন, আপনাদের ব্যারিস্টার রূহুল কুদ্দুস কাজলকে শুনেছি। ব্যারিস্টার কাজল সঙ্গে সঙ্গে বিচারপতির বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, আপনি আমাকে শুনানি করতে দেননি। আপনি ৩০ সেকেন্ড সময় নিয়ে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আদেশ দিয়ে দিলেন। আমরা আদালত পরিবর্তনের আবেদন জানিয়েছি। এ অবস্থায় আপনি এ আদেশ দিতে পারেন না। আপনি (বিচারপতি খসরুজ্জামান) কোর্টের পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছেন।

এ সময় তারেক রহমানের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, আমাদের বক্তব্য আপনার শুনতে হবে। আমাদের বক্তব্য না নিয়ে কোনো অর্ডার পাস করতে পারেন না। আপনি কি তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নীলনকশার রায় দেয়ার জন্য বিচারকের আসনে বসেছেন?

এ কথার প্রেক্ষিতে বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান বলেন, আমাদের আদেশের বিরুদ্ধে আপনারা আপিল বিভাগে যেতে পারেন। এ সময় বিএনপির আইনজীবীরা তাকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট বিচারক’ বলে হট্টগোল শুরু করেন। এক পর্যায়ে কোর্টে উপস্থিত থাকা আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা তারেক রহমানের আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, আপনারা আদালতকে এভাবে চাপ সৃষ্টি করবেন না।

হৈ চৈয়ের মধ্যে বিচারপতি খসরুজ্জামানকে তারেক রহমানের এক আইনজীবী বলতে থাকেন, আপনাকে বলতে হবে যে, আপনি দরখাস্ত সম্পর্কে জানেন কি-না? আপনি বলে দেন আমরা যাই বলি না কেন, আপনি রায় দেবেন? তাহলে আমরা এখানে দাঁড়াব না। মিডিয়াতে যাবো। একপর্যায়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তারা (তারেক রহমানের আইনজীবী) মিডিয়া ট্রায়াল চাইছেন।

এ সময় আইনজীবী গাজী কামরুল ইসলাম সজল ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের একটি ছবি সংবলিত প্রতিবেদন আদালতে প্রদর্শন করেন। ওই ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, একজন বিচারপতি আদালতের দরজায় লাথি মারছেন, যিনি লাথি মারছেন তিনি এই আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি। এরই মধ্যে হাইকোর্ট তারেক রহমানের সাম্প্রতিক দেয়া সব বক্তব্য অনলাইন থেকে সরানোর জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)কে নির্দেশ দেন। এসময় বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা ‘শেইম’ ‘শেইম’ বলে চিৎকার করেন। বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে তারা বলেন, আপনি অবিচার করতে পারেন না।

এ সময় কয়েকজন সরকারপক্ষীয় আইনকর্মকর্তা বলেন, এটি কোর্ট। এখানে শাউটিং করা যাবে না। তখন তারেক রহমানের একজন আইনজীবী প্রশ্ন করেন, হু ইজ হি? এরপর পর আবারও শুরু হয় হইচই ও হট্টগোল। এতে কোর্টে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে বিচারপতিদ্বয় এজলাস ছেড়ে খাস কামরায় চলে যান। এতে বিচারকাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে তারেক রহমানের আইনজীবী এজলাসের ভেতর অবস্থান গ্রহণ করেন।

আদালতে রিটের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম। তারেক রহমানের পক্ষে ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা, মো. রূহুল কুদ্দুস, গাজী কামরুল ইসলাম সজল কথা বলেন। অন্যদিকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার ও কামরুল হক খান, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এস আর সিদ্দিকী সাইফ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে সকাল থেকেই আদালত এবং এজলাসের বাইরে মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ।

প্রসঙ্গত ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেত্রী অ্যাডভোকেট নাসরিন সিদ্দিকী লিনা বাদী হয়ে এ রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে পরদিন হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। রিটে আইনের দৃষ্টিতে ‘পলাতক’ অবস্থায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কোনো ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি সব ধরনের গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়।

সম্প্রতি তারেক রহমানের নির্দেশনায় বেশ কিছু সফল কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এসব সমাবেশে রেকর্ড সংখ্যক মানুষের সম্পৃক্ততা ও উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এ সময় বিভিন্ন সমাবেশে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচার করা হয়। এর পরপরই ৮ বছর আগে করা রিটের রুল শুনানির উদ্যোগ নেন আইনজীবীরা। রিটকারীর আবেদনের প্রেক্ষিতে রুল শুনানির জন্য হাইকোর্টের কার্যতালিকায় ওঠে রিটটি।

এর ধারাবাহিকতায় চলতি মাসের শুরুতে বিষয়টি আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে। বিদেশে থাকায় তারেক রহমানের প্রতি নোটিশ জারি না হয়ে ২ আগস্ট তা ফেরত আসে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।

রিটে বিবাদী হিসেবে তারেক রহমানের উল্লেখিত ঠিকানা (বাড়ি নম্বর-৬, রুম নম্বর-৮৬) সঠিক নয়-মর্মে উল্লেখ করা হয়। পরে আবেদনকারী পক্ষকে রিটে উল্লেখিত ঠিকানা সংশোধনের জন্য আবেদন দিতে বলেন। ওইদিনই হলফনামা আকারে বিবাদী হিসেবে তারেক রহমানের উল্লেখিত ঠিকানা সংশোধন এবং তার প্রতি নোটিশ জারির (রুল) জন্য আবেদন জমা দেন রিট আবেদনকারী।

গত ১৩ আগস্ট হাইকোর্ট ওই রিট সূত্রে উল্লেখিত সংশোধিত ঠিকানায় (বাড়ি নং-৬, সড়ক-৮৬, গুলশান-২) বিবাদী তারেক রহমানের প্রতি বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে নোটিশ জারি করতে নির্দেশ দেন। এরপর তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিবৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইউটিউব থেকে সরাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বিটিআরসির প্রতি নির্দেশ চেয়ে সম্পূরক আবেদন করে রিট আবেদনকারী। এটি মঞ্জুর করে গতকাল উপরোক্ত আদেশ দেন হাইকোর্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *