‘জিন্নাহ নয়, পাকিস্তানের স্রষ্টা নেহরু ও প্যাটেল’ ।। আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

জসওয়ান্ত সিং এর গ্রন্থ ব্যবচ্ছেদ – প্রথম পর্ব

১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগকে মহাত্মা গান্ধীর মতো অনেকে বলেছেন ‘জীবন্ত প্রাণীকে কেটে খণ্ড খণ্ড’ করার মতো। এ ঘটনা নিঃসন্দেহে উপমহাদেশে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড়ো আঘাত ছিল। এই বিভাজন উপমহাদেশের চারটি প্রজন্মের জনগোষ্ঠীর মন-মানসিকতাকে প্রভাবিত করেছে।

এই বিভাজন কেন ঘটেছিল? এজন্য কে দায়ী ছিল- জিন্নাহ? নাকি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস? অথবা ব্রিটিশ রাজশক্তি? ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির সাবেক পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জসওয়ান্ত সিং ২০০৯ সালে প্রকাশিত তাঁর “জিন্নাহ: ইন্ডিয়া-পার্টিশন ইন্ডিপেন্ডেন্স” গ্রন্থে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর অনুসন্ধানের চেষ্টা করেচেন।

জসওয়ান্ত সিং তার গ্রন্থে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, জিন্নাহর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত’ হিসেবে। যে উপাধি তাঁকে দিয়েছিলেন গোপাল কৃষ্ণ গোখলে। তার এ অভিযাত্রা শেষ হয়েছিল ভারতীয় মুসলমানদের ‘একমাত্র মুখপাত্র’ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার মধ্য দিয়ে। কীভাবে ও কেন তাঁর রূপান্তর ঘটেছিল পাকিস্তানের স্রষ্টা, কায়েদ-ই-আজম হিসেবে?

কোনো ভারতীয় বা পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ ও পার্লামেন্ট সদস্য কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র একটি বিশ্লেষণধর্মী রাজনৈতিক জীবনী তুলে ধরেননি। তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর যেসব গ্রন্থ রয়েছে, সেগুলো অধিকাংশই একদেশদর্শী ও প্রচারধর্মী অথবা ভারত বিভাগের জন্য দায়ী করে তাঁকে খলনায়ক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

সেদিক থেকে জসওয়ান্ত সিং-এর গ্রন্থটিতে বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন: “ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম কোথায় এবং কখন একটি পৃথক জাতি হিসেবে মুসলমানদের উদ্ভব ঘটেছিল? এবং এটি পাকিস্তানকে কোথায় টেনে নিয়ে গেল? মুসলিম জাতিসত্তাই যদি মুখ্য হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলো কেন? এছাড়া এখন পাকিস্তানের অবস্থাই বা কি? কোন দিকে যাচ্ছে পাকিস্তান?

এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার ক্ষেত্রে জসওয়ান্ত সিং এর গ্রন্থটি অনন্য। কারণ লেখক স্বয়ং নীতি-বিশেষজ্ঞ, যিনি সুনির্দিষ্ট উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য নীতির উদ্ভাবক। ১৯৪৭ সালের পর থেকে দেশবিভাগের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে উপমহাদেশ এবং মাঝেমধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ-সংঘাত সেই পুরোনো ক্ষতকে নিরাময়ের অযোগ্য করে তুলছে। তিনি তাঁর গ্রন্থের শেষদিকে নিজেই বড়ো একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে যে, “শেষ পর্যন্ত দেশ বিভাগে কি অর্জিত হয়েছে?

জসওয়ান্ত সিং বিশ্বাস করতেন “দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রথমেই আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, আমরা পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার যে উপাদানগুলো পরিত্যাগ করেছি, সেগুলো ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো, আমরা কখনও শান্তি ফিরিয়ে আনতে কাউকে সম্মত করাতে পারবো না।”

জসওয়ান্ত সিং তাঁর গ্রন্থের শুরুতেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি জিন্নাহর রাজনৈতিক জীবনী লিখছেন, ভারতের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক জীবনী, যা তিনি আগে কখনও করেননি। তিনি বিনয়ের সঙ্গে একথাও স্বীকার করেছেন যে, তিনি কোনো পেশাদার ইতিহাসবিদ নন। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর বইটি সবসময় আগ্রহের বিষয় হিসেবে থাকবে।

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপি নেতা জসওয়ান্ত সিং তাঁর কূটনীতি ও রাজনীতির চেয়ে ইতিহাস রচনার জন্য অধিক পরিচিত। যদিও তিনি নিজেকে ইতিহাসবিদ বলে দাবি করেন নি। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জীবনীকে কেন্দ্র করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি পর্যায়ের ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন এবং একজন পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।

উপমহাদেশের বিভক্তি ও স্বাধীনতার ওপর তাঁর তথ্যবহুল গ্রন্থ “জিন্নাহ, ইন্ডিয়া-পার্টিশন ইন্ডিপেন্ডেন্স” এ বিশদ বিবরণ, ব্যাখ্যা ও বিস্তৃতিকরণ, ভাষার শৈলী এবং ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ এমনকি দক্ষ ইতিহাসবিদের জন্যও অনুকরণযোগ্য। কারণ যে প্রশ্নগুলোর উত্তর সহজে পাওয়া যায় না, সেগুলো তিনি তুলে এনেছেন অভিজ্ঞ ডুবুরির মতো।

দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে তাঁর গবেষণা তাঁকে উপসংহারে উপনীত হতে সহায়তা করেছে যে, প্রচলিত ইতিহাস ভারত বিভাগের জন্য মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে দায়ী করে তাঁকে খলনায়কের ভূমিকায় দাঁড় সঠিক হয়নি। প্রকৃত সত্য হচ্ছে ভারত বিভাগের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং সরদার বল্লভভাই প্যাটেল।

ভারতীয় উপমহাদেশকে দুটি দেশ মুসলিম পাকিস্তান ও হিন্দু ভারতে বিভক্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা যদি নিষ্ঠাবান হতেন, তাহলে এ বিভাজন এড়ানো সম্ভব হতে পারতো। কিন্তু তারা তা এড়াতে পারেননি। ফলে উপমহাদেশ চিরস্থায়ীভাবে বহু বিষয়কে অমীমাংসিত অবস্থায় রেখেছে, যা এখনও এই বিশাল অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে তাড়িত করে।

ভারত ভাগের সঙ্গে জড়িত পরিসংখ্যান ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার নয়। কারণ এই রাজনৈতিক বিপর্যয়ে প্রাণ হারিয়েছিল আনুমানিক ১৩ লাখ মানুষ; উদ্বাস্তু হয়েছিল দেড় কোটি লোক; শরণার্থী হয়ে ভারতে এসেছিল ১৫ লাখ হিন্দু ও শিখ এবং এবং পাকিস্তানে গিয়েছিল ৯০ লাখ মুসলিম। দেশ বিভাগ বাস্তবায়িত হওয়ার পর থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আনুমানিক ৪ হাজার মুসলিম ট্রেনযোগে প্রতিদিন উত্তরপ্রদেশ থেকে পাকিস্তানে গেছে। এছাড়া এ বিপর্যয় চলাকালে ১০ লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছিল।

জসওয়ান্ত সিং-এর গ্রন্থে প্রধান গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, জিন্নাহকে অকারণে ভারত বিভাগের জন্য দায়ী করে তাঁকে দানব রূপ দেওয়া হয়েছে। অথচ তিনি এক মহান ব্যক্তি ছিলেন এবং ভারত বিভাগের জন্য সম্পূর্ণ দায়ী ছিলেন না। পন্ডিত নেহরু প্রধানত দেশভাগের জন্য দায়ী ছিলেন; কারণ তিনি একটি কেন্দ্রীভূত ভারতে বিশ্বাস করতেন, যা হিন্দু আধিপত্য থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য মুসলমানদের জন্য কোনো সুযোগ রাখেনি। মহাত্মা গান্ধী এবং অন্যান্য কংগ্রেস নেতা, যারা দেশভাগের বিরোধিতা করতেন, তারা দেশভাগের পক্ষে নেহরু’র মুখ্য ভুমিকার বিরুদ্ধে জোরালো কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেননি।

জসওয়ান্ত সিং তার গ্রন্থে কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যা পাকিস্তান সৃষ্টির প্রক্রিয়ার সূচনা ও পরবর্তী সমাপ্তি চিহ্নিত করে। সেগুলো হলো- ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, ১৯৩৩ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী কর্তৃক ‘পাকিস্তান’ নাম তৈরি এবং ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ অধিবেশনে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘লাহোর প্রস্তাব’ পাস।

তিনি আরও বলেছেন, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলেও তারা তখনই পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়নি। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রতিক্রিয়া হিসেবে উগ্র হিন্দুরা ১৯১০ সালে হিন্দু মহাসভা গঠন করে। হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাকারীদের অনেকে ছিলেন কংগ্রেস নেতা।

লন্ডনে প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে পর কংগ্রেসের প্রতি জিন্নাহর মোহভঙ্গ ঘটে। ইতোমধ্যে হিন্দু মহাসভা সামগ্রিকভাবে এবং কংগ্রেস নেতাদের একটি অংশ ভারতে হিন্দু-মুসলিম সমস্যার বাস্তব সমাধান হিসেবে লালা লাজপত রায়, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ও সরদার বল্লভভাই প্যাটেলের ভারত বিভাগ প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল।

সবই ছিল মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্যে। মহাত্মা গান্ধী ভারত বিভাগ এড়াতে জিন্নাহকে অখন্ড ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসানোর প্রস্তাব করলেও উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তিনি তা গ্রহণের তাঁর অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। (চলবে)

* আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু উপদেষ্টা সম্পাদক- উইকলি বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক। সাবেক সম্পাদক- মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *