২০২৪ সালের ৪ থেকে ৫ আগস্টের সকাল পর্যন্ত ঢাকার গণভবনে ঘটে এক নাটকীয় ও ইতিহাস নির্ধারণী ঘটনা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম উন্মোচন করেছেন—সরকার ও সামরিক শীর্ষ পর্যায়ের মধ্যে সেই উত্তেজনাপূর্ণ রাত ও সকালের ঘটনাগুলো।
৫ আগস্ট সকালে, শীর্ষ সামরিক নেতৃবৃন্দ যখন শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে পদত্যাগের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন—‘আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো এবং গণভবনে কবর দিয়ে দাও।’ এই সংক্ষিপ্ত উক্তি শুধু সংকটকালের আবেগপ্রসূত প্রতিক্রিয়া নয়; এটি এক শাসকের রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক অবয়বের নগ্ন স্বীকারোক্তি। এখানে রাষ্ট্রক্ষমতা শুধুমাত্র শাসনের হাতিয়ার নয়—এটি অস্তিত্বের একমাত্র স্বীকৃত রূপে পরিণত হয়েছে। মৃত্যু কাম্য, কিন্তু ক্ষমতা কখনও পরিত্যাজ্য নয়।
শেখ হাসিনার এই উক্তি আমাদের সামনে এনে দেয় এক গভীর রাজনৈতিক চেতনার ছবি, যেখানে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির সীমানা বিলীন, গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট এবং ফ্যাসিবাদী মনস্তত্ত্বের ছায়া কাজ করে। দার্শনিক মার্টিন হাইডেগারের Being-towards-death তত্ত্বে বলেছেন, মৃত্যু সম্পর্কে সচেতনতা মানুষকে তার অস্তিত্বের প্রকৃত উপলব্ধি দেয়। কিন্তু শেখ হাসিনার উক্তিতে মৃত্যু ও ক্ষমতা একত্রিত হয়। ক্ষমতা হারানো মানে মৃত্যু এবং মৃত্যুর স্থানও হতে হবে ক্ষমতার প্রতীক—গণভবন।
‘গণভবনে কবর’—এই বাক্যাংশের অন্তর্নিহিত অর্থ হলো, ক্ষমতার প্রতীক ও ভূখণ্ডে নিজের চিরস্থায়ী উপস্থিতি রেখে যাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। এটি কোনো ব্যক্তিগত বাসনা নয়, বরং এক রাজনৈতিক দর্শনের প্রকাশ, যেখানে রাষ্ট্রের প্রতীক আর ব্যক্তির মরদেহ একাকার। এই উক্তি আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এক নির্মম রাজনৈতিক স্বীকারোক্তি। তিনি মৃত্যুকে গ্রহণ করতে পারেন, কিন্তু ক্ষমতা ছাড়তে পারেন না। ক্ষমতার প্রতি এই অন্ধ আসক্তি—আত্মবিনাশী হলেও স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার অক্ষমতা—এক বিকৃত রাজনৈতিক মানসিকতার নিদর্শন। এই কারণেই এটি শুধু সংকটকালীন প্রতিক্রিয়া নয়, বরং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের মনস্তাত্ত্বিক রূপরেখা বোঝার এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।
শেখ হাসিনার বক্তব্য স্পষ্ট—নাগরিকের জীবন নয়, ক্ষমতাই তার অগ্রাধিকার। জুলাই জুড়ে ২১ দিনে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু, ২৬ হাজার আহত, রক্তাক্ত রাজপথ, মায়ের আহাজারি—এসব কিছুই তার বিবেচনায় ছিল না। ছিলো কেবল ক্ষমতা রক্ষা। এটি ভয়ঙ্কর এক ফ্যাসিবাদী মনোভাব, যেখানে ক্ষমতা রক্ষাই মুখ্য, জনগণ নয়। গণতন্ত্রে ক্ষমতা আসে ও যায়, কিন্তু এখানে তা স্থায়ী দখলদারিত্বে রূপ নিয়েছে।
যদি তিনি সত্যিকারের গণমানুষের প্রতিনিধি হতেন, মানবিক, গণতান্ত্রিক ও নৈতিক হতেন, তাহলে বলতেন—‘আমি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবো, যেন জনগণের রক্ত আর না ঝরে।’ কিন্তু তিনি তা বলেননি। অর্থাৎ তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে হত্যা থামানোর ন্যূনতম নৈতিক দায় স্বীকার করেননি। এর মধ্যে রয়েছে দায়িত্বহীনতা ও নিষ্ঠুরতা, যা গণতান্ত্রিক নৈতিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এই অবস্থান নৈতিকভাবে অপরাধপ্রবণ এবং অমানবিক।
মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে প্রমাণ হয়—শেখ হাসিনা আত্মপরিচয়ের সঙ্গে ক্ষমতার একাত্মতা পোষণ করতেন। ক্ষমতা ছাড়া বাঁচার চিন্তাই তার ছিলো না। ক্ষমতা হারানো তার কাছে আত্মহননের সমতুল্য। এটি Thanatos of Power—এক ধরনের মৃত্যুবিনাশী ক্ষমতাবোধ, যেখানে জীবনের চেয়ে ক্ষমতাই বড়। তার সিদ্ধান্তগুলো আধিপত্যের ভিত্তিতে নেয়া, অধিকারের নয়।
মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড Thanatos বা মৃত্যুবৃত্তির কথা বলেছেন, মানুষের মধ্যে আত্মবিনাশী তাড়না কাজ করে, রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে শাসক ক্ষমতা হারানোর চেয়ে মৃত্যুকে বেছে নেন।
হিটলার ১৯৪৫ সালে বার্লিন বাঙ্কারে আত্মহত্যা করেছিলেন, পরাজয় স্বীকারের বদলে। তার আত্মহত্যা ছিলো এক চূড়ান্ত শাসকসুলভ কর্ম, যেখানে নিজের মৃত্যু দিয়ে ইতিহাসে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টাই ছিলো মূল লক্ষ্য। জীবন নয়, ক্ষমতাই ছিলো তার আত্মপরিচয়ের কেন্দ্র। এমনকি মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো, যাতে দেহ পাওয়া না যায়। এতে শারীরিক অনুপস্থিতি অদৃশ্য হলেও চিরন্তন প্রতীকী উপস্থিতি রক্ষা পায়। এই মৃত্যু প্রতিরোধ নয়, বরং ক্ষমতার চূড়ান্ত প্রদর্শন। শেখ হাসিনার ‘গণভবনে কবর’ কথাটি হিটলারীয় অনুষঙ্গের সঙ্গে তুলনীয়। দু’জনেই চেয়েছেন মৃত্যুর মধ্যেও রাষ্ট্র ও ভবনের সঙ্গে একীভূত থাকতে।
‘আমাকে হত্যা মানেই রাষ্ট্রকে হত্যা’—এই ভাবনাটি নিছক আত্মরক্ষার ভাষা নয়, এটি রাষ্ট্র, ভবন ও নিজস্বতার এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক সংমিশ্রণ। শেখ হাসিনার এই মনোভাব যেন—রাষ্ট্র নয়, আমিই রাষ্ট্র; জনগণ নয়, আমার ইচ্ছাই সার্বভৌম। তিনি ক্ষমতাকে ব্যক্তিসত্তার অংশে পরিণত করেছেন, যেখানে ‘আমি’ আর ‘ক্ষমতা’ এক। গণভবন সেই একাত্মতার প্রতীক।
ইতালীয় দার্শনিক ও ভাষাতত্ত্বজ্ঞ উমবের্তো একো Ur-Fascism প্রবন্ধে বলেছেন, ফ্যাসিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য হলো নেতা ও জাতির অবিচ্ছেদ্য একত্ব। ‘গণভবনে কবর’—ধারণাটির মধ্যেও সেই একত্ববাদ প্রবল। ফ্যাসিবাদী শাসক মনে করে—আমি জাতি, আমিই রাষ্ট্র। আমার মৃত্যু মানেই রাষ্ট্রের মৃত্যু। শেখ হাসিনা এই মনস্তত্ত্বেই লালিত, তাই সে বলতে পেরেছে—আমাকে কবর দাও গণভবনে, আমি সেখানেই চিরস্থায়ী হবো। এটি আত্মঘাতী ও প্রতীকী ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত নিদর্শন। মিশরের ফারাও রাজাদের থেকে শুরু করে উত্তর কোরিয়ার কিম পরিবার পর্যন্ত—ভয়ঙ্কর এই ফ্যাসিবাদী মানসিকতায় আক্রান্ত। এরা মৃত্যুকে প্রতীকী মহিমায় রূপ দিয়ে থাকেন।
শেখ হাসিনার বক্তব্যেও সেই ফ্যাসিসিজমের ছায়া—‘আমার দেহ গণভবনে থাকুক, কারণ আমিই ভবন, আমিই রাষ্ট্র।’ এটি এক ধরনের Symbolic immortality—যেখানে মৃত্যু-পরবর্তী অস্তিত্বও প্রতীকী ক্ষমতার মাধ্যমে টিকে থাকে। এই মনোভাব জনসাধারণের জন্য এক ভয়ঙ্কর বার্তা বহন করে—তিনি গুলি খেতে রাজি, কিন্তু জনগণকে রক্ষা করতে চান না। তিনি মরতে পারেন, কিন্তু ক্ষমতা ছাড়তে পারেন না। এমন শাসক গণতন্ত্রের প্রতিনিধি হতে পারে না। বরং তিনি যেনো হয়ে উঠেছেন রাষ্ট্রযন্ত্রের এক চিরস্থায়ী প্রতীক, যিনি নিজের অস্তিত্ব রাষ্ট্রের সঙ্গে এমনভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন—যা ধ্বংসাত্মক, ফ্যাসিবাদী ও আত্মবিনাশী।
গণহত্যার রক্তাক্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা পদত্যাগের চিন্তাও করেননি। ক্ষমতার তৃষ্ণা এত গভীর ছিলো যে, গণহত্যার দায়ভার নিয়ে কোনো বিচার বা পরিণতির মুখোমুখি হতে চাননি। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ থেকে পালিয়ে গেছেন—এক কাপুরুষোচিত নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে। শেখ হাসিনার এই আত্মরক্ষামূলক পলায়ন—ইতিহাসে এক স্বৈরাচারী শাসকের নৈতিক ও রাজনৈতিক পতনের চূড়ান্ত অধ্যায় হিসেবে থেকে যাবে।
‘আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো, গণভবনে কবর দিয়ে দাও’—এই বাক্যটি কেবল সংকটের মুহূর্তে উচ্চারিত আবেগপ্রসূত প্রতিক্রিয়া নয়; এটি ক্ষমতার প্রতি ব্যক্তির অবচেতনে নির্মিত এক গভীর দর্শন, যেখানে রাষ্ট্র, নিজস্বতা ও মৃত্যু পরস্পরের সঙ্গে মিশে যায়। মৃত্যুর পরেও প্রতীকী ক্ষমতার আসনে থাকার বাসনা এক বিপজ্জনক মনস্তত্ত্বের নিদর্শন। এটি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে নৈতিক সীমা ভেঙে ফেলার এক আত্মঘাতী প্রচেষ্টা—যেখানে নেতৃত্ব নয়, কর্তৃত্ব; দায় নয়, নিয়ন্ত্রণ; জনগণ নয়, নিজের অস্তিত্বই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দু।
ক্ষমতা ছিলো তার আয়না—সেখানে নিজের প্রতিচ্ছবি ছাড়া কিছুই কল্পনাযোগ্য ছিলো না। নিজেকে ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবা ছিলো, তার কাছে আত্মবিলুপ্তির প্রতীক। ফলে মৃত্যুর পর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় পিতার সমাধির পাশে কবরস্থ হওয়ার ইচ্ছে না করে, গণভবনকেই বেছে নিয়েছেন। এটি যেন শেষ মুহূর্তেও রাষ্ট্রকে দখলে রাখার অবচেতন আকাঙ্ক্ষা।
শেখ হাসিনার ‘গণভবনে কবর’ চিন্তা রাষ্ট্রকে মৃত্যুর প্রতীকে পরিণত করে। অথচ রাষ্ট্র মানুষের জন্য, জীবনের জন্য—একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল, যেখানে স্বাধীনতা ও মর্যাদা বিকশিত হয়। তাই জীবনের পক্ষে দাঁড়ানো আজ শুধু আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার নয়, এটি নৈতিক শপথ ও সাংস্কৃতিক দায়িত্ব, যা থেকে সরে দাঁড়ানো মানে ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে সমর্পণ করা।
শহীদুল্লাহ ফরায়জী গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক faraizees@gmail.com