সাঈদ চৌধুরী
কিভাবে ইসরায়েলি গুপ্তচর-প্রধান যুদ্ধাপরাধ তদন্ত নিয়ে আইসিসির প্রসিকিউটরকে ‘হুমকি’ দিয়েছেন এবং কিভাবে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা যুদ্ধাপরাধের বিচারকে লাইনচ্যুত করার চেষ্টা করেছিল এমন বিস্ফোরক খবর প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান। বুধবার (২৮ মে ২০২৪) এক বিশেষ প্রতিবেদনে গুপ্তচরবৃত্তি, হ্যাকিং, ভয় দেখানো ইত্যাদি বিষয়ে আইসিসির উপর ইসরায়েলের নয় বছরের অনেক তৎপরতার খবর প্রকাশিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলিকে একাধিক গোপন বৈঠকে হুমকি দিয়েছিলেন ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক প্রধান ইয়োসি কোহেন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত থেকে সরে আসার জন্য চাপ প্রয়োগের চেষ্টা হিসেবে এই হুমকি দেওয়া হয় বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর যখন ঘোষণা করেন যে তিনি ইসরায়েল এবং হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চাচ্ছেন, তখন তিনি একটি গোপন সতর্কতা জারি করেছেন: “আমি জোর দিয়েছি যে এই আদালতের কর্মকর্তাদের প্রতিবন্ধকতা, ভয় দেখানো বা অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করার সমস্ত প্রচেষ্টা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।” তবে কারা বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছিল বা তারা ঠিক কীভাবে তা করেছিল প্রসিকিউটর সেটি বলেননি।
দখলকৃত ফিলিস্তিনের বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েল কর্তৃক যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বলে যে অভিযোগ রয়েছে, সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিক তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আইসিসির সাবেক কৌঁসুলি ফাতাউ বেনসুদা। তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগে সচেষ্ট হন মোসাদের সাবেক প্রধান ইয়োসি কোহেন। এ বিষয়ে ২০২১ সালে শুরু হওয়া অনুসন্ধান গত সপ্তাহে শেষ হয়।
গার্ডিয়ান এবং ইসরায়েল ভিত্তিক ম্যাগাজিন +৯৭২ এবং স্থানীয় মিডিয়া লোকাল কলের অনুসন্ধানে বিষয়টি উন্মোচিত হয়েছে। আদালতের তদন্তকে লাইনচ্যুত করার প্রয়াসে দেশটি তার গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে নজরদারি, হ্যাক এবং আইসিসির সিনিয়র কর্মীদের হুমকি দেওয়ার জন্য মোতায়েন করেছিল বলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তুলে আনা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ইসরায়েলের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এক দশকের মত সময় ধরে আইসিসির বিরুদ্ধে গোপনে ‘যুদ্ধ’ করে চলেছে।
এই তথ্য বেরিয়ে আসছে, যখন ফাতাউ বেনসুদার উত্তরসূরি করিম খান গাজায় ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধে যেসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তার জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আরজি জানিয়েছেন। পাশাপাশি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ও হামাসের তিন নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির জন্য আবেদন করেছেন।
ফাতাউ বেনসুদার সঙ্গে মোসাদের লক্ষ্য ছিল একটা সমঝোতা করা, যাতে তিনি ইসরায়েলের প্রত্যাশা পূরণে সহায়তা করেন। আর এ কারণে হয়তো ইয়োসি কোহেন তখন নেতানিয়াহুর ‘অনানুষ্ঠানিক বার্তাবাহক’ হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজনদের একজন হিসেবে কোহেন রাজনৈতিক ক্ষমতাধর বলে পরিচিতি পেয়েছেন।
মোসাদের তৎপরতা সম্পর্কে আইসিসির কাছে বেনসুদার আনুষ্ঠানিক অভিযোগের বিষয়টিও গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আইসিসির কর্মকর্তাদের কাছে দেওয়া ভাষ্য অনুযায়ী, কোহেন তাঁকে বলেছেন, ‘আমাদেরে আপনার সাহায্য করা উচিত এবং আপনাকেও আমাদের সেবা করতে দিন। আপনি এমনটা করবেন না, যাতে আপনার বা আপনার পরিবারের নিরাপত্তা জনিত সংকট হতে পারে।’
মোসাদ বেনসুদার পরিবারের সদস্যদের প্রতিও নজর রেখেছিল এবং তাঁর স্বামীর গোপন কথাবার্তার রেকর্ড সংগ্রহ করেছিল বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তবেে এতে কোহেন বা বেনসুদার পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য সংযুক্ত করা হয়নি।
প্রতিবেদনে বিভিন্ন সুত্রের তথ্যের বরাত দিয়ে বলা হয়, নেতানিয়াহু আইসিসির বিরুদ্ধে গোয়েন্দা অভিযানে গভীর আগ্রহ নিয়েছিলেন। ফলে তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের তত্ত্বাবধানে একাজে সম্পৃক্ত ছিল দেশীয় গুপ্তচর সংস্থা, সামরিক গোয়েন্দা অধিদপ্তর, সাইবার-ইন্টেলিজেন্স ডিভিশন, পররাষ্ট্র ও কৌশলগত বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
আইসিসির সাবেক কর্মকর্তা ও আইনি বিশেষজ্ঞদের মতে, বেনসুদাকে হুমকি বা চাপ দেওয়ার জন্য মোসাদের প্রচেষ্টা রোম আইনের ৭০ অনুচ্ছেদের অধীন বিচার প্রশাসনের বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।