কারাবন্দি সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে কাটানো সময় ।। আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

মতামত সময় টিভি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

জীবনের একটি পর্যায়ে পৌছে অনেকের কাছে ‘রহস্য পুরুষ’ হয়ে উঠা ‘দাদাভাই’ এর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৭৯ সালের গ্রীস্মের কোনো এক মাসে। দীর্ঘ সময় ধরে কথাও হয়েছিল তার সঙ্গে। তিনি তখন ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দি ছিলেন। কারাগারে দেখা হয়েছিল বললে ভুল হবে। বন্দি হিসেবে তাকে চিকিৎসার জন্যে আনা হয়েছিল ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তার কেবিনের সামনে বারান্দায় প্রহরায় ছিলেন একজন পুলিশ সদস্য। আমার প্রবেশে বাধা দেননি তিনি, জিজ্ঞাসাবাদও করেননি। কারণ, আমার সঙ্গে ছিলেন অ্যাপ্রন পরা, গলায় স্টেথিসকোপ ঝোলানো মেডিকেলের ফাইনাল ইয়ায়ের ছাত্র এম, এ রশিদ। তিনিই একজন শীর্ষ রাজনৈতিক নিরাপত্তা বন্দির কেবিনে অবাধ প্রবেশের ছাড়পত্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রজীবন শেষ না হলেও আমি দৈনিক সংগ্রামের ফুলটাইম রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছিলাম। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে আমার বেশ ক’জন ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। আমি প্রায়ই ময়মনসিংহ চলে যেতাম তাদের সঙ্গে একদিন বা দু’দিন কাটাতে। ১৯৭৯ সালের মে অথবা জুন মাস হবে, আমি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে বন্ধু এম এ রশিদের রুমে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার পর তিনি আমাকে বললেন, ‘আজ আপনাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে দেখা করাবো।’ কে সেই নেতা আমি জানতে চাইলেও তিনি বলেননি।

সন্ধ্যায় আমরা হোস্টেল থেকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে গেলাম। হাসপাতালের একটি ভবনের দোতলায় একটি কেবিনে আমাকেসহ প্রবেশ করলেন এম এ রশিদ। বড়োসড়ো কেবিন। কেন্দ্রস্থলে বেড। বেডের শিথানে বসা চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সের দীর্ঘ কালো চুল ও মুখভরা কাঁচা দাড়ি শোভিত সুদর্শন এক ব্যক্তি। চিনতে অসুবিধা হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। অতি পরিচিত মুখ। সিরাজুল আলম খান। তিনি যে, ময়মনসিংহে কারাগারে আছে, তা আমার জানা ছিল।

সালাম জানিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম। বাম হাতে ধরা হুকার নল বেড ঘিরে থাকা ভক্তদের একজনের হাতে দিয়ে তার ডান হাতের তর্জনি ও মধ্যমার মাঝখানে রাখা সিগারেট বাম হাতে নিয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে যে গুটিকয়েক লোকের নাম জানি, তাদের অন্যতম এবং সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তির সঙ্গে করমর্দনের সময় শিহরিত বোধ করলাম। আমার হাত তার হাতে রাখলেন, যেন অনেক চেনা মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর দেখা হয়েছে।

আমি পরিচয় দিলাম, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স শেষ করেছি, পাশাপাশি দৈনিক সংগ্রামে জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছি। আপনি এখানে আছেন জেনে সাক্ষাতের সুযোগ গ্রহণ করলাম।” তিনি উচ্ছসিত হয়ে জানতে চাইলেন, “মোহাম্মদ হোসেন ভাই কেমন আছেন? কবির ভাই কি এখনো সংগ্রামে আসেন?” আমি অবাক হলাম, ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে সংগ্রাম পুন:প্রকাশিত হয়েছে। সিরাজুল আলম খান কারাগারে আছেন ১৯৭৬ সালের শেষ দিক, সম্ভবত নভেম্বর মাস থেকে। সব খবর রাখেন তিনি। অবশ্য তখন সংবাদপত্র ছিল হাতে গণা, সাংবাদিক সংখ্যাও খুব বেশি নয়। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা সব সাংবাদিক, বিশেষ করে রিপোর্টার ও ফটো সাংবাদিকদের জানতেন।

এরপর তিনি তার স্মৃতির ভান্ডার খুলে দিলেন, “মোহাম্মদ হোসেন ভাই গণকণ্ঠের বার্তা সম্পাদক ছিলেন। প্রতিদিন রাতে গণকণ্ঠে গিয়ে সম্পাদক আল মাহমুদ, নির্বাহী সম্পাদক আফতাব আহমদ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের রুমে নিহত হন), বার্তা সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন ভাইয়ের সাথে মধ্যরাত পর্যন্ত এবং অনেক সময় কাগজ বের হয়ে সেটা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরতাম। কবির সাহেব সরকারি চাকুরি করতেন, অফিস শেষে গণকণ্ঠে এসে কাজে ডুবে যেতেন। শুনেছি, তারা দু’জনই সংগ্রামে যোগ দিয়েছেন।

কি অদ্ভুত ও ঐতিহাসিক যোগসূত্র। ১৯৭০ সালের ১৭ জানুয়ারি দৈনিক সংগ্রাম ওয়ারি এলাকার ৩১ র‌্যাঙ্কিন স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকা ছাপানোর আধুনিক প্রেসও ছিল সেখানেই। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগেই সংগ্রাম বন্ধ হয়ে যায়। প্রেস ও বাড়িটি দখল করে নেওয়া হয় এবং ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ওই অফিস ও প্রেস থেকে দৈনিক গণকণ্ঠ প্রকাশিত হতে থাকে। সরকার বিরোধী সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে গণকণ্ঠ সম্পাদক আল মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হলে চারটি দৈনিক ছাড়া সকল সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে গণকণ্ঠ বিলুপ্ত হয়।

জিয়াউর রহমান রাষ্টপতি হওয়ার পর যখন বিলুপ্ত সংবাদপত্রগুওলাকে পুনরায় প্রকাশের অনুমতি দেওয় হয়, তখন ওই ভবন থেকে প্রকাশিত হতো দৈনিক বাংলার মুখ। এর বহু পর এরশাদের সরকারের আমলে ওই বাড়িটি নিলামে বিক্রয়ের জন্য দরপত্র দেওয়ার আগে সংগ্রাম কর্তৃপক্ষকে ভবন ও প্রেসটি সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মালিকানা গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই প্রস্তাবের সঙ্গে অবৈধ লেনদেনের ইঙ্গিত থাকায় আলোচনা অগ্রসর হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত বাড়িটি নিলামে বিক্রয় করা হয়।

আমি তাকে মোহাম্মদ হোসেন ভাই ও কবির ভাই সম্পর্কে জানাই। তিনি আরো অনেক রিপোর্টারের কথা বলেন, যারা সবাই আমার সিনিয়র। আমাকে বলেন সবাইকে তার সালাম পৌছে দিতে।

তার কেবিনে জনা বিশেষ যুবক, চেহারা ও পোশাকে সবাইকে ছাত্র বলে মনে হলো। তাদের উদ্দেশে তিনি কিছু বলছিলেন। আমরা প্রবেশ করায় তাকে কথা থামাতে হয়েছে। তিনি তাদের দিকে ফিরে বললেন, “আফগানিস্তানে হাফিজুদ্দিনের পর এখন ক্ষমতায় এসেছে বারবাক কারমাল। তার মন্ত্রীসভায় ১৮ বছর বয়সের একজন তরুণকে মন্ত্রী বানানো হয়েছে। তোমরা তার বয়সী অথবা তার চেয়ে বেশি বয়সী। তোমরা অযোগ্য কীভাবে? ভালো উদাহরণ থেকে ভালো শিক্ষা নাও। বাংলাদেশে পরিবর্তন আসবেই এবং নেতৃত্বে থাকবে তোমরা।”

তিনি দু’একজনকে থাকতে বলে অন্যদের বিদায় দিলেন। যারা ছিল, তাদের বললেন আমাকে ও রশিদ ভাইকে চা দিতে। টেবিলে বেশ কয়েকটি ফ্লাস্ক। হয়তো ভক্তরাই নিয়মিত তার খাবার পরিবেশন করেন। আমার আপত্তি সত্ত্বেও একজন ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে আমাদের পরিবেশন করল। ফাঁকে ফাঁকে তিনি কথা বলছিলেন। তার কথা জাদু মেশানো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনি।

তিনি আমার কাছে দেশের অবস্থা জানতে চান। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলি, “দাদাভাই, আপনি কারাগারে বসে যত খবর রাখেন, আমি মুক্ত বাতাসে বিচরণ করে এর ছিটেফোটাও জানি না। আপনি বলুন, আমি শুনি। এখন তো আপনার কথা লেখা যাবে না। আমি কারাগার থেকে মুক্ত হলে এবং দেশে স্বাধীনভাবে লেখার পরিবেশ সৃষ্টি হলে আমি লিখবো।” তিনি হাসলেন। কি সুন্দর করে তিনি হাসতে পারেন। কারাগারে আছেন বলে তার ক্ষোভ নেই, অভিযোগ নেই। তিনি বললেন, “আমি মুক্তি পেলে অবশ্যই দেখা করবেন। আবার হাত মিলিয়ে বিদায় নিলাম বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্য পুরুষের কাছ থেকে।

এরপর আরো দু’বার দেখা হয়েছে তার সঙ্গে। ১৯৯৮ সালে আমি দৈনিক মানবজমিনে কাজ করার সময় ওই সময়ের অফিস ওয়ালশো টাওয়ারের সামনের ফুটপাত দিয়ে তাকে যেতে দেখে অফিসের সিঁড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামলাম, অনেকটা দৌড়ে তার কাছে পৌছে বললাম, “দাদাভাই, আসসালামু আলাইকুম।” তিনি দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে বললেন, “ওয়ালেকুম!” জানতে চাইলাম, “আমাকে চিনতে পেরেছেন?” মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “দৈনিক সংগ্রাম!” তাকে বললাম, “এখন আমি মানবজমিনে।” তাকে অফিসে আমন্ত্রণ জানালে তিনি বললেন যে, শেরাটনে কারো সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে তার। অন্য কোনো সময় অবশ্যই আসবেন।

আরো বছর পাঁচেক পর তার সঙ্গে আবার দেখা হলো হোটেল সোনারগাঁও এর লবিতে। কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। কাছে গিয়ে সালাম দেওয়ার ইচ্ছা দমন করতে না পেরে এগিয়ে গেলাম। তিনি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আঙূল দিয়ে পাশের সোফায় বসতে ইশারা করলেন। আমি বসিনি। তাদের কথা বলার সুযোগ দিয়ে চলে আসি।

গতকাল ৯ জুন শুক্রবার তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ তার ভালো কাজগুলো গ্রহণ করুন।

* আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু উপদেষ্টা সম্পাদক- উইকলি বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক। সাবেক সম্পাদক- মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *