আত্মগত দার্শনিক (২য় পর্ব) । মুসা আল হাফিজ

সময় সাহিত্য
শেয়ার করুন

হ্যাঁ, সাগরে জাহাজ ডুবতে পারে। আবার ঘরেও তো মানুষ সিঁড়ি থেকে পড়ে যায়। অনেকের গায়ে আগুন লাগে। কেউ কেউ তো পুড়ে যায়। কেন হয় এমন? আসলে যে জন্মেছে, সে মৃত্যুবরণ করবে বলেই জন্মেছে। কিন্তু মৃত্যুর আগের দিনগুলো তাকে যাপন করতে হবে সাহসের ডানায় চড়ে। সাবধানতা দরকার। তবে সাবধানতা যদি ভীতির চাদর পরিয়ে দেয়, সেটা মানবীয় সত্তার অপমান। বিপদের ভয় যদি কাউকে ঘিরে ধরে, সে তো কাজই করতে পারবে না। আমরা জমিদার নই। কাজ করে খেতে হবে। কাজের জায়গা আমার দরিয়া। হৃদয় যদি হয় ডুবাপুকুর, তাহলে দরিয়া আমাকে জায়গা দেবে না। দরিয়ায় কাজ করতে হলে দিলকেও দরিয়া বানাতে হয়।

সায়ী: বাবা ঠিক বলেছেন।

সুরুর: বাবা উচিত বলেছেন।

ঃ আচ্ছা, তোমরা দেখছি এক হয়ে গেছো। সিদ্ধান্তও আগ থেকেই নিয়ে রাখা। আল্লাহ মঙ্গল করুন, এখন এই মোনাজাতই বাকি।

ঃ এই যাত্রায় তোমরা হবে আমার সঙ্গি। এতো লম্বা সফরে একা থাকতে ভালো লাগে না। সমুদ্রযাত্রা তোমাদের দৃষ্টি খুলে দেবে। ভয়কে জয় করতে এবং নতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কার করতে শিখবে। দেখা হবে অনেক দ্বীপ-জনপদ।
সুরুর লাফিয়ে উঠলো খুশিতে। সে ছড়া কাটতে জানে। কথা বলে পাকা, মনেই হয় না তার বয়স কম। ওজুদের সন্তানদের এই এক বিশেষ গুণ।

রাহী ছড়া কাটতে লাগলো

কী যে মজার যাত্রা হবে
সাগরে
চুপ থেকো না, আনন্দ হে
জাগ রে!

দেশ ছাড়িয়ে দ্বীপ ছাড়িয়ে
যাবোই দূরে
মন যে আমার উঠলো হেসে
নতুন সুরে।

সুরুরের ছড়া শুনে ওজুদ বিজয় দীপ্ত চোখে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। স্ত্রীর মুখে শুকনো হাসি। একটি চিন্তার ছায়া যেনো সরছে না চেহারা হতে। দেহাতি মেঘের ছায়া তার মুখে।

ওজুদ: কী তোমার এতো চিন্তা?

ঃ চিন্তা তো দুধের শিশুটিকে নিয়ে। তার লালন-পালন মাল বুঝাই জাহাজে কীভাবে হবে। পুরুষ মানুষ, বাচ্চা লালন-পালনের জটিলতা না বুঝারই কথা।

ঃ বাচ্চাটিকে দরিয়ায় ভাসাবার জন্যে আমরা যাত্রা করছি না। আমার খোদা যিনি, বাচ্চার খোদাও তিনি। আমার জন্য তিনি যতটা স্নেহ ও আশির্বাদ রেখেছেন, নিষ্পাপ বাচ্চাটির জন্য অবশ্যই আরো বেশি। সেই অনুগ্রহ ওজুদ, ওজুদের স্ত্রী ও বড় দুই সন্তানকে যেভাবে ঘিরে রাখবে, তাকেও তেমনি। জাহাজও একটি ঘর। সন্তান লালন-পালনের দরকারী সবকিছু সেখানেও রাখা যাবে। আমরা সবকিছু সঙ্গে নেবো। আমরা এই ঘরে যেভাবে থাকি, সেভাবেই সমুদ্রে চলমান ঘরে বসবাস করবো।

ঃ যাক। আল্লাহর যা ইচ্ছা। সব একসাথে থাকলে অনন্দও সঙ্গে থাকবে।

সুরুর : হ্যাঁ, আনন্দও সঙ্গে থাকবে।

সায়ী : খুশির উপরে খুশি। দারুন মজা হবে।

প্রস্তুতি শুরু হলো। প্রয়োজনীয় সবকিছু সংগ্রহ করা হলো। মাস খানেকের খাদ্য সামগ্রী, সুপেয় পানি, বাসার বেড়াল, পোষা টিয়ে, হায়াতের দোলনা, কাপড়-চোপড় জাহাজে উঠানো হবে। সায়ী-সুরুরের ছড়ার বই, পড়ার বই, খাতাপত্র, কলম-পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স, খেলনা সামগ্রি সব মিলিয়ে জাহাজ হয়ে উঠলো নিজেদের চিরচেনা ঘর। একদিন ওজুদ পরিবার আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ডান পায়ে জাহাজে উঠলেন।

জাহাজ যাত্রা করলো বন্দর থেকে। ধীরে ধীরে এগুচ্ছে আর চলে যাচ্ছে ভারত মহাসাগরের ভেতরে। দূরে সরে যাচ্ছে তীরবর্তী দুর্বাঘাসের সবুজভূমি, বালির বিয়াবান, বন কুসুমে ভর্তি ঝোঁপ, বাঁশ বাগানের মাথা, চাষা হালবলদের দৃশ্য, মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ী।

সাগরের তীরে বাজপোড়া নারকেল গাছের মাথায় বসে আছে ক্ষুধার্ত শকুন, মাথার উপর দিয়ে সাই করে উড়ে যাচ্ছে সমুদ্র ঈগল। আর কুয়াশার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে সেই সব বাস্তুভিটে, জনপদ যেখানে পুরনো পড়োবাড়ীর আকন্দঝোঁপে সহসা নেচে উঠে ফুরফুরে চড়ুই। যেখানে হাজার হাজার মা ও ছেলে, ভাই ও বোনের সুখ- দুঃখের দিনরাত্রি, সূর্যের আলো আর চাঁদের জ্যোৎস্নায় পেখম মেলে আছে। শান্ত সাগরের শীতল বাতাসে তারই রেশ যেনো এসে পরিবেশকে উষ্ণ করে তুলছে। জাহাজের ভেতর একখন্ড পরিবারে এসে জমেছে সেই উষ্ণতার আরাম।

সাগরের মন
অনুকূল আবহাওয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে ওজুদের জাহাজ। পালের টানে শোঁ শোঁ ধ্বনি ওঠছে, যেন বাজছে হাওয়ার সংগীত। টগবগে ঘোড়ার মতো জাহাজের গতি। আনন্দিত রাজহাসের চালে জাহাজের তাল-লয়। সে আনন্দ মাতিয়ে তুলছে ওজুদের ছেলে মেয়েকে, ব্যস্ত স্ত্রীকেও। তাদের সবার খুশি বাষ্প হয়ে উড়ন্ত সাগরের পানির মতো জাহাজময় উড়ছে।

(ধারাবাহিক চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *