আইয়ামুত-তাশরীক ও তাকবীরে তাশরীক

ধর্ম ও দর্শন সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

অধ্যক্ষ অ্যাডভোকেট মাওলানা রফিক আহমদ চৌধুরী

কুরবানি পরবর্তী তিন দিনকে আইয়ামুত-তাশরীক বলা হয়। অর্থাৎ যিলহজ মাসের এগারো, বারো ও তেরো তারিখ আইয়ামুত-তাশরীক।

তাকবীরে তাশরীক (تكبير التشريق): ‘তাকবীর’ (تكبير) শব্দের অর্থ বড়ত্ব ঘোষণা করা। আর ‘তাশরীক’ (التشريق) শব্দের অর্থ সূর্যের আলোতে রেখে গোশত শুকানো। আরবগণ তাদের কুরবানির গোশত ঈদের তিন দিন পর পর্যন্ত রোদে শুকাতো; এজন্য এ দিনগুলোর নাম ‘আইয়ামুত-তাশরীক’ বা ‘মাংস শুকানোর দিন’ নামে নামকরণ করা হয়।

তাকবীরে তাশরীক কখন ও কত ওয়াক্ত:

৯ জিলহজ্ব ফজর থেকে ১৩ জিলহজ্ব আসর পর্যন্ত ৫ দিনে মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাযের পর প্রত্যেক বালিগ পুরুষ-মহিলা, মুকীম-মুসাফির, গ্রামবাসী-শহরবাসী, জামাতে নামায আদায়কারী-একাকী নামায আদায়কারী সকলের উপর একবার করে তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা ওয়াজিব৷ (ফতোয়ায়ে শামী, ফতোয়ায়ে আলমগীরী, আল ফিকহুল মুয়াসসার, আল হিদায়া, আল কুদুরী)

হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু নয় তারিখ আরাফার দিন ফজর থেকে তেরো তারিখ আসর পর্যন্ত তাকবীর তাশরিক পড়তেন। (ইবনে আবী শাইবা, বায়হাকি) أنه كان يكبر بعد صلاة الفجر يوم عرفة اللي صلالعصر من آخر ايام التشريق و يكبر بعد العصر

আইয়ামে তাশরীক কেনো গুরুত্বপূর্ন?

হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামের স্মৃতিবিজড়িত ‘তাকবীরে তাশরীক’ পাঠের মাধ্যমে মুসলমানদের মাঝে ঈমানী চেতনা কাজ করে, যা শরীয়তে বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
ইবনে ওমর ও আবূহুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ দশ দিন তাকবীর বলতে বলতে বাজারের জন্য বের হতেন, অন্য মানুষও তাদের দেখে দেখে তাকবীর বলতেন।

ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু মিনায় তার তাবুতে তাকবীর বলতেন, মসজিদের লোকেরা শুনত, অতঃপর তারা তাকবীর বলত এবং বাজারের লোকেরাও তাদের সাথে তাকবীর বলত। এক পর্যায়ে পুরো মিনা তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠত।

তাকবীরে আইয়ামে তাশরীকের বাক্য:

তাকবীরে তাশরীকের জন্য বিভিন্ন শব্দ হাদীসে উল্লেখ হয়েছে। তন্মধ্যে সর্বজনবিদিত বাক্য হল- اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ وَاَللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ وَلِلَّهِ الْحَمْد (আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’) অর্থঃ আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান৷ আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং আল্লাহ মহান৷ আল্লহ মহান এবং সকল প্রশংসা আল্লাহরই জন্য৷ (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, তাবারানী)

তাকবীরে তাশরীক হলো কয়েকটি বিশেষ বাক্যের সমন্বিত রূপ। ০৪ বার তাকবীর, ০১ বার তাহলীল এবং ০১ বার তাহমীদ।

কারা পড়বেন?

প্রত্যেক বালেগ পুরুষ, নারী, মুকিম, মুসাফির, গ্রামবাসী, শহরবাসী, জামায়াতের সঙ্গে নামায পড়ুক বা একাকি পড়ুক— প্রত্যেককেই একবার করে পাঠ করতে হবে।

আইয়ামুত তাশরীক এর ফজিলত :

আইয়ামে তাশরীকের দিনগুলোতে জিকির করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। জিলহজের প্রথম দশকের গুরুত্বপূর্ণ এবং আবশ্যকীয় একটি আমল তাকবিরে তাশরিক। এ দিনগুলো ইবাদত-বন্দেগি, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জিকির ও তার শুকরিয়া আদায়ের দিন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন— وَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡدُودَٰتٖۚ [البقرة: ٢٠٣] ‘তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করবে।’[সূরা বাকারাহ, আয়াত: ২০৩]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম أيام التشريق أيام أكل وشرب وذكر الله. [رواه مسلم] ‘আইয়ামুত-তাশরীক হল খাওয়া-দাওয়া ও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যিকিরের দিন।’[মুসলিম]

ইমাম ইবনে রজব রহ. এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন: আইয়ামুত-তাশরীক এমন কতগুলো দিন যাতে ঈমানদারদের দেহের নেয়ামতের স্বাচ্ছন্দ্য এবং মনের নেয়ামতের স্বাচ্ছন্দ্য একত্র করা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া হল দেহের খোরাক আর আল্লাহর জিকির ও শুকরিয়া হল হৃদয়ের খোরাক। আর এভাবেই নেয়ামতের পূর্ণতা লাভ করল এ দিনসমূহে।

ইমাম বুখারি রহ. বলেন— الأيام المعدودات أيام التشريق. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন—‘নির্দিষ্ট দিনগুলো’ বলতে ‘আইয়ামুত-তাশরীক’কে বুঝানো হয়েছে।’ ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন: ইবনে আব্বাসের এ ব্যাখ্যা গ্রহণে কারো কোনো দ্বি-মত নেই। আর মূলত এ দিনগুলো হজের মওসুমে মিনাতে অবস্থানের দিন। কেননা হাদিসে এসেছে— أيام منى ثلاثة فمن تعجل في يومين فلا إثم عليه ومن تأخر فلا إثم عليه.

মিনায় অবস্থানের দিন হল তিন দিন। যদি কেউ তাড়াতাড়ি করে দু দিনে চলে আসে তবে তার কোনো পাপ নেই। আর যদি কেউ বিলম্ব করে তবে তারও কোনো পাপ নেই। [আবু দাউদ। ইমাম আলবানী সহিহ বলেছেন।] ‘উকবাহ ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- يوم عرفة، ويوم النحر، وأيام منى عيدنا أهل الإسلام، وهي أيام أكل وشرب আরাফাহ দিবস, কুরবানির দিন ও মিনার দিনসমূহ [কুরবানি পরবর্তী তিন দিন] আমাদের ইসলাম অনুসারীদের ঈদের দিন।’[আবু দাউদ। ইমাম আলবানী সহিহ বলেছেন।]

তাকবীরে তাশরীকের বিধান:

* তাকবীরে তাশরীক নির্ধারিত দিনসমূহে প্রতি ফরজ নামাজের পর পর একবার পড়া ওয়াজিব। আর আল্লাহর জিকির করার নিয়তে পুরুষদের জন্য মসজিদ, বাজার, বাড়ি সর্বত্র উচ্চ স্বরে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত। *

* পুরুষদের জন্য উচ্চস্বরে এবং মহিলাদের জন্য নিম্নস্বরে পাঠ করা : তাকবীরে তাশরীক পুরুষদের জন্য উচ্চস্বরে এবং মহিলাদের জন্য নিম্নস্বরে পাঠ করা ওয়াজিব৷ সুতরাং পুরুষগণ নিম্নস্বরে এবং মহিলাগণ উচ্চস্বরে পাঠ করলে ওয়াজিব আদায় হবেনা৷ (ফতোয়ায়ে আলমগীরী, ফতোয়ায়ে শামী)

মাসবুকের জন্যও তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা ওয়াজিব। মাসবুকের জন্যও তার ছুটে যাওয়া নামায আদায় করে সালাম ফিরানোর সঙ্গে সঙ্গেই তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা ওয়াজিব। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, ফতোয়ায়ে আলমগীরী,ফতোয়ায়ে শামী)

উল্লেখ্য, মাসবুক (مَسْبُوق)হলো জামায়াতে অংশগ্রহণকারী এমন মুসল্লি যিনি এক বা একাধিক রাকাতের পরে ইমামের সাথে সালাত আদায় করতে যোগ দিয়েছেন।

তিনবার বলা সুন্নত বা মুস্তাহাব নয়। ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক তিনবার পড়ার কোনো বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায় না। ফিকহবিদরাও তিনবার বলার প্রতি গুরুত্ব দেননি। সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহুম থেকেও ফরজ নামাজের পর একাধিকবার তাকবিরের কথা উল্লেখ নেই।

ঈদের নামাজের পর কি তাকবীরে তাশরীক পড়তে হবে?

ঈদের নামাযের পরও তাকবীরে তাশরীক পড়া প্রমাণিত। এটা ওয়াজিব না মুস্তাহাব এ বিষয়ে মতভেদ আছে। তবে ওয়াজিব হওয়াটাই অধিক গ্রহণযোগ্য। তাকবীরে তাশরীকের কাযা নেই। যথা সময়ে তাকবীরে তাশরীক পাঠ করতে না পারলে অন্য সময়ে পাঠ করা ওয়াজিব হবেনা৷ অনিচ্ছাকৃত তাকবীরে তাশরীক পাঠ তরক হলে গুনাহ হবেনা৷ কিন্তু ইচ্ছাকৃত তাকবীর পাঠ তরক করলে ওয়াজিব তরকের গুনাহ হবে৷ (ফতোয়ায়ে শামী)

কাযা নামায পরবর্তীতে আদায় করলে- তাকবীরে তাশরীকের দিনগুলোর কাযা হওয়া নামায পরবর্তীতে আদায় করলে, অথবা অন্য কোনো দিনের কাযা নামায তাকবীরে তাশরীকের দিনগুলাতে আদায় করলে তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা ওয়াজিব হবেনা৷ কেননা তাকবীরে তাশরীক নির্ধারিত সময়ের আমল। (ফতোয়ায়ে শামী)

শুধু ফরজ নামাযের পর পাঠ করা ওয়াজিব- তাকবীরে তাশরীক শুধু ফরজ নামাযের পর পাঠ করা ওয়াজিব৷ তাছাড়া অন্য কোন নামাযের পর পাঠ করা ওয়াজিব নয়৷ বিতর, জানাযা, তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশত, আউয়াবীন ইত্যাদি নামাযের পর তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা বিদআত৷ (ফতোয়ায়ে শামী, ফতোয়ায়ে আলমগীরী)

ঈদের নামাযে যাওয়া আসার সময়- উভয় ঈদের নামাযে যাওয়া আসার সময় তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা সুন্নত৷ তবে ঈদুল ফিতরে নিম্নস্বরে এবং ঈদুল আযহায় উচ্চস্বরে পাঠ করা সুন্নত৷ (মুস্তাদরাকে হাকীম, ফতোয়ায়ে আলমগীরী, শরহে বেকায়া)

প্রথম খুতবার শুরুতে ৯ বার এবং দ্বিতীয় খুতবার শুরুতে ৭ বার- উভয় ঈদের নামাযের প্রথম খুতবার শুরুতে ৯ বার এবং দ্বিতীয় খুতবার শুরুতে ৭ বার তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা সুন্নত৷ (ফতোয়ায়ে শামী, ফতোয়ায়ে আলমগীরী, আল কুদুরী)

ঈদের খুতবার সময় তাকবীরে তাশরিকের বিধান- ঈদের খুতবা চলাকালীন উপস্থিত লোকদের জন্য সম্পূর্ণ চুপ থেকে খুতবা শোনা ওয়াজিব। তাই খুতবার সময় মুসল্লীগণ তাকবীর বলবে না; বরং চুপ থেকে খুতবা শুনবে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- وَجَبَ الْإِنْصَاتُ فِي أَرْبَعَةِ مَوَاطِنَ: الْجُمُعَةِ،وَالْفِطْرِ،وَالْأَضْحَى، وَالِاسْتِسْقَاءِ চারটি স্থানে চুপ থাকা ওয়াজিব- জুমা, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা এবং ইসতিসকার খুতবার সময়। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক)।
কোন কোন মতে ইমামের সাথে সাথে মুসল্লিদের শুধু তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা মুস্তাহাব৷ (ফতোয়ায়ে শামী, ফতোয়ায়ে আলমগীরী, আল কুদুরী)

* অধ্যক্ষ অ্যাডভোকেট মাওলানা রফিক আহমদ চৌধুরী প্রেসিডেন্ট- খাপ্পাই মসজিদ এন্ড ইসলামিক সেন্টার, দক্ষিণ কোরিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *