অরণ্যে-মাজারে-মন্দিরে (এক) । সাঈদ চৌধুরী

ভ্রমণ-স্মৃতিকথা
শেয়ার করুন

একজন ভিক্ষুক আরেকজনকে তাড়াচ্ছে দেখে মনে একটু খটকা বাধল। ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বন্দ্ব ছাড়া একে অপরকে তাড়াতে যাবে কেন? দরগার পাশ দিয়ে প্রতিদিন যেতে হয় বলে এখানকার ফকিরদের চেনা চেনা মনে হয়। এরকম একজনকে হাত ইশারায় ডাক দিলাম। নাম জানতে চাইলে বলল, সুমন।
আসল কথা জিজ্ঞাসার আগে তার কাছে একটু পরামর্শ চাইলাম। আমাদের দেশে পরামর্শদাতা ও চিকিৎসকের অভাব নেই। যে কোন বিষয়ে জানতে চাইলে লোকজন খুশি হয়। রিক্সাওয়ালা থেকে শুরু করে সাধারণ পথচারি সবকিছুতে অনর্গল সমাধান বলতে পারে। কোন অসুখ-বিসুখের কথা উঠলে চারপাশে সকলেই নানা মহৌষধ বলে দেয়। যদিও এরা অনেকেই রোগাক্রান্ত এবং নিজেদের সমস্যা সমাধানে কোন সুরাহা খুজে পায়না।
দোতলা ঘরের মতো সদর দরজা দিয়ে দরগার মূল চত্তরে প্রবেশ করেছি। বামপাশে চারতলা বিশিষ্ট দরগা মসজিদ। মসজিদের দক্ষিণ দিকে একটি সুউচ্চ মিনার। সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় ডান পাশে মহিলাদের এবাদত খানা। মাজার চত্বরের উত্তর দিকে পাথরে বাধাঁনো পুকুরে রয়েছে বিশাল আকৃতির গজার মাছ। এসব মাছকে পবিত্র জ্ঞান করে দর্শনার্থীরা ছোট ছোট মাছ খেতে দেয়। পুকুরের দক্ষিণ দিকে মুসাফির খানা। এর পূর্ব দিকে বড় তিনটি ডেক। ভক্তরা ডেকগুলোয় প্রচুর টাকা-পয়সা ফেলে।
মুসাফির খানার পশ্চিমে একটি ছোট্ট চত্বরে অসংখ্য কবুতর বসে। ধান-চাল ছিটিয়ে দিলে তারা আনন্দ করে খায়। জালালি কৈতর বলে পরিচিত এই পায়রাগুলো দিল্লির নিজাম আউলিয়া কর্তৃক শাহ জালালকে দেয়া কবুতরের বংশধর।
মকসুদ হাসিলের জন্য দরগায় কী করতে হবে জানতে চাইলে সুমন অনেকগুলো পরামর্শ দিল। গজার মাছগুলোকে খাবার দিতে হবে। কিছু শিরনি ও নগট টাকা-পয়সা এখানকার গরীবদের দিবেন। তাইলে আপনার মকসুদ পুরণ হবে। এরপর একটু গানের শুরে বলল, কেউ ফিরেনা খালি হাতে, বাবা শাহের দরবারে।
দরগার পুকুরের গজার মাছ সম্পর্কেও সুমন অনেক কিছু বলল। শাহ জালাল রহ. নাকি ৭০০ বৎসর আগে শাহী ঈদগাহ থেকে এনেছেন। সিলেট আসার পর তিনি কিছুদিন সেখানে ছিলেন। একদিন অজু করার সময় লাল রঙ্গের পোনা মাছ দেখে মুগ্ধ হন। দরগায় আসার সময় এই মাছ শাহী ঈদগাহ থেকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন। ঐ মাছেরই উত্তরসুরি এই মাছগুলো।
বহু বছর ধরে দরগা প্রাঙ্গনে এবং মাদ্রাসা ও মসজিদে আসা-যাওয়া হলেও সুমনকে সেটা বুঝতে দেইনি। মাছের খাবার কোথায় পাব জানতে চাইলে সে বলল, পুকুরের পশ্চিম-দক্ষিণ কোনায় কয়েকজন মাছ বিক্রেতা বসে। তাদের কাছ থেকে ৭/৮ টাকার মাছ কিনে নিয়ে গজার মাছকে খাওয়াতে হবে। ছোট মাছ ছাড়ার সাথে সাথে কোন গজার মাছে খেয়ে ফেললে উদ্দেশ্য সফল।
আমি তাকে ১০টাকা দিয়ে বললাম, ৭টাকার ছোট মাছ আর ৩টাকা তোমার। বেশ খুশি হল সে। দৌড়ে গিয়ে সামান্য মাছ নিয়ে আসল। এগুলো কিভাবে গজারকে দিতে হবে তাও দেখিয়ে দিল। এভাবেই তার সাথে আমার একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে। এইবার আমি ঐ ভিক্ষুককে অন্যরা তাড়িয়ে দিল কেন জানতে চাইলাম।
সুমন বলল, সে মেম্বার নয়, নতুন এসেছে। নতুন ফকির গেইটের বাইরে থাকতে হয়। দরগার ভেতরে ভিক্ষা করতে পারবেনা। এখানে অনেক নিয়ম আছে। মেম্বার হওন লাগবে। দিন শেষে লিডারের কাছে হিসাব দিতে হবে। সারা দিনের আয় দেখাইয়া তিন ভাগের দুই ভাগ নিবে। মিছা কইলে খবর আছে।
ভিক্ষুকের আয়েও কেউ ভাগ বসায়? শিহরিত হলাম! আরেকটু গভীরে যেতে চাইলাম। কিন্তু সুমন আমাকে আর বেশী তথ্য দিতে ভয় পাচ্ছে বলেই মনে হল। আমিও তাকে বেশি ঘাটাতে গেলাম না। আরেক ফকিরের সহায়তা নিলাম। তার নাম মজনু।
মজনুকে ৫টাকা দিয়ে বললাম, আমাকে একটা পান খাবাও আর বাকি টাকা তোমার। সে খুশি হয়ে আমার জন্য ২টাকায় হরেক রকম মসলা দেয়া একটি মিষ্টি পান নিয়ে এল। আর ৩টাকা তার পকেটে রাখল। আজ সারাদিনে কত রুজি হয়েছে? জানতে চাইলে পকেটের সব টাকা গুনে দেখে ১১৯ হয়েছে। আমি আরো ১টাকা দিলোম। তাতে তার ১২০ হল। আর কোন খরচ আছে কিনা জানতে চাইলে তিন ভাগ করে বলল, চল্লিশ টাকা চান্দা দিতে হবে।
মাজারে শিরনি, আগরবাতি ও গোলাপ জলের আদান-প্রদান জানার জন্য মজনুর গল্প শুনতে চাই। তাই চাঁদা নিয়ে আর কথা বাড়াইনি। এবার মজনুর সাথে আরেকজন যোগ হল। দেখতে হ্যান্ডসাম ও কিছুটা পরিচ্ছন্ন। সৌরভ নামে পরিচয় দিল। আলাপ শুরু করে বেশ মজা পেলাম। তার কথাবার্তা শুনে খানিকটা তাজ্জুব বনে গেলাম। মজনুকে বিদায় দিয়ে সৌরভ আমার সাথে কথা বলতে আগ্রহ দেখাল।
গোলাপ জল দিয়েই শুরু হয়েছিল কথা। সৌরভ বলল, এগুলো মোটেও গোলাপ জল নয়। গোলাপের পাপড়ি থেকে যে পানীয় তৈরী হয় তার নাম গোলাপ জল। রং-রূপ এবং গন্ধ-স্বাদ মিলিয়ে দেখুন, এটা তা নয়। মাজারের সামনের দোকান গুলোতে পানিতে লাল-নীল রঙ মিশিয়ে বিক্রি করা হয়।
আমি তার কথায় আগ্রহ দেখাচ্ছি ভেবে সৌরভ আরো বলল, আগেকার দিনে শবে বরাত ও শবে ক্বদরে মিলাদের সময় হুজুরে ‘ইয়া নবি সালামু আলাইকা’ বলার সাথে সাথে সবাই একসাথে ‘ইয়া রাসুল সালামু আলাইকা’ বলত। এই কোরাসের মাঝে গোলাপজল ছিটানো সওয়াব মনে করা হতো। তখন মসজিদে ও মাজারে গোলাপজল, আগরবাতি, মোমবাতির স্তূপ জমে যেতো।
এখন দর্শনার্থীরা দোকান থেকে কিনে নিয়ে মাজারে দেয়, আর মাজার থেকে রাত্রে দোকান্দাররা অর্ধেক দামে আবার নিয়ে আসে। আগে প্লাস্টিকের খালি বোতলগুলো গরীব মানুষ নিত, এখন মহাজনেরা নিয়ে যায়। রঙিন পানি ভরে আবারো বিক্রি করে।
গোলাপ নিয়ে বহুরূপী কারবার রেখে মজনুর কথাবার্তায় আমি তার বিষযে আগ্রহী হয়ে পড়লাম। মজনু মোবাইল থেকে গোলাপের নানা উৎকর্ষ ও রূপচর্চায় গোলাপের ব্যবহার সম্পর্কে আমাকে তথ্য দিতে শুরু করল। অতীতে রাজকন্যারা কিভাবে গোলাপের পানিতে গোসল করতেন এমন বিলাসী খবরের পাশাপাশি আধুনিক নারীদের রূপচর্চায় গোলাপের বহুমাত্রিক ব্যবহার ও গোলাপ মিশ্রিত পণ্য সামগ্রীও সে দেখাল।
বিস্ময়কর এই ফকিরকে আমি চায়ের অফার দিলাম, তাতেও রাজি হল সে। চায়ের আড্ডায় আমি তার সাথে বেশ বন্ধুবৎসল আচরণ করলাম। আর সে যথেষ্ট পাণ্ডিত্যের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে গেল।
মজনুর আসল পরিচয় জানার জন্য আমি পুলক অনুভব করলাম। দরগায় ফকির বেশে থাকা সম্পর্কে কিছূই জানতে চাইনি। মনের গহীনে চেপে রাখা কথাগুলো তখনো তাকে বলা হয়নি। হাঠাৎ একটা ফোন পেয়ে সে চলে যেতে চাইল। আমি তার নাম্বারটা রেখে বিদায় দিলাম। (চলবে স্মৃতির ডাইরি থেকে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *