রিফাত পারভীন এ্যানিডিডাব্লিউ
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার ঘটনা এক উদ্বেগজনক বাস্তবতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা৷
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসেব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিএসএফ-এর হাতে মোট ৩০ জন বাংলাদেশি সীমান্তে নিহত হন৷ নিহতদের মধ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ২৫ জনকে৷ একই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ৩১ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ৷ এর মধ্যে ২৮ জনই গুলিতে নিহত হয়েছেন৷
আসক-এর সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বিএসএফ-এর গুলিতে ও নির্যাতনে অন্তত ৬০৭ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে৷ আর অধিকার নামের মানবাধিকার সংস্থাটির মতে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বিএসএফ সদস্যদের হাতে অন্তত ৫৮২ বাংলাদেশি নিহত ও ৭৬১ জন আহত হয়েছেন৷
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে বিজিবি সদস্য মোঃ রইশুদ্দিন নিহত হন৷ যদিও বিএসএফ দাবি করেছে এটি ‘টার্গেট কিলিং’ ছিল না, বরং ভুল বোঝাবুঝির কারণে এমনটি ঘটেছে৷
বিএসএফ-এর মতে, তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়, কারণ চোরাচালানকারীদের আক্রমণের শিকার হয় তারা৷ তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিহতদের শরীরের স্পর্শকাতর অংশে গুলি লাগার খবর পাওয়া যায়, যা মূলত এই আত্মরক্ষার যুক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে৷
চোরাচালান অবশ্যই সীমান্তে একটি বড় সমস্যা, তবে তা মোকাবিলা করতে হত্যার পথ নেওয়া কি ন্যায়সঙ্গত?
সীমান্ত হত্যার বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে বারবার উত্থাপন করা হয়েছে এবং সীমান্ত সম্মেলনে ‘নন-লেথাল উইপন’ ব্যবহারের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে৷ এমনকি ২০২৪ সালের সীমান্ত সম্মেলনে বিজিবি ও বিএসএফ সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার বিষয়ে ঐকমত্যেও পৌঁছেছিল৷ তবে বাস্তবতা বলছে, প্রতিশ্রুতির পরও সীমান্তে গুলির ঘটনা কমেনি, থামেনি মৃত্যুও৷
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে নিহত হন ৩২ বছর বয়সি বাংলাদেশি নাগরিক আল-আমিন৷ তবে যথারীতি এই হত্যার পরেও বিএসএফ তাকে চোরাচালানকারী সন্দেহে গুলি চালায় বলে দাবি করে৷ গুরুতর আহত অবস্থায় বিএসএফ সদস্যরা তাকে ভারতের বিশালগড় মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতেই তিনি মারা যান বলে খবর পাওয়া যায়৷
এই হত্যাকাণ্ডের পর বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী কঠোরভাবেই বলেছেন হত্যা কোনো চূড়ান্ত সমাধান নয় এবং সীমান্তে আর একটিও হত্যার ঘটনা ঘটলে বিজিবি আরো কঠোর হবে৷
গত ৭ অক্টোবর কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলায় বিএসএফ-এর গুলিতে নিহত হন কামাল হোসেন৷ এর আগে ৯ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার কান্তিভিটা সীমান্তে নিহত হন জয়ন্ত কুমার সিং নামের এক কিশোর৷ ২ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে নিহত হন ১৬ বছরের এক শিক্ষার্থী স্বর্ণা দাস৷ হত্যার এই তালিকা মূলত অনেক লম্বা৷
সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে সমসাময়িক এ সকল হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদ জানিয়ে ভারত সরকারকে এই ধরনের কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ৷ একই সময়ে ঘটে যাওয়া একের পর হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় হাইকমিশনে প্রতিবাদলিপি পাঠায় বাংলাদেশ৷ পাশাপাশি সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে বলা হয়৷
গত কয়েক মাসে সীমান্ত হত্যার ঘটনায় কঠোর প্রতিক্রিয়া জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক জোরদারে সীমান্ত হত্যা একটি বড় বাধা বলেও মন্তব্য করেছিলেন৷
অন্যদিকে বাংলাদেশের এমন প্রতিক্রিয়া ভারতের উপর তেমন প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয়নি৷ সীমান্ত হত্যার বিষয়টি এড়িয়ে যেতে দেখা গেছে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে৷ এ বিষয়ে ‘ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা কথা বলেছেন’ এটুকু প্রতিক্রিয়াই জানিয়েছিলেন তিনি৷ আর বিএসএফ-এর তরফ থেকে বারবার ভঙ্গ করা হয়েছে প্রতিশ্রুতি৷
শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয়, বিএসএফ-এর হাতে নিহত হচ্ছেন তাদের দেশের নাগরিকরাও, অর্থাৎ ভারতীয়রাও৷ ভারতীয় মানবাধিকার সংস্থা বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) এমনটাই জানিয়েছে৷ এই সংস্থার মতে, ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ-এর হাতে নিহত হওয়া ১০৫টি হত্যার তদন্ত করেছে তারা৷ এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে শঙ্কা করেছিল সংস্থাটি৷ সেই সময়ে মাসুমের তরফ থেকে আরো দাবি করা হয়েছিল বিএসএফ সন্দেহ হলে বেআইনিভাবে আটক ও নির্যাতন করছে৷ এছাড়া সীমান্ত এলাকায় বসবাস করা ভারতীয়দের হয়রানি ও হুমকি দিয়েছে৷