ইউসুফ আরেফিন মাসুদের টাইমলাইন থেকে একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস সামান্য এডিট করে সবার সঙ্গে শেয়ার করলাম। ইউসুফ আরেফিন আমার পরিচিত। সাহিত্য-সংষ্কৃতিমনা। ব্যবসায়ী। মাঝেমধ্যে নিজের লেখা কবিতাসহ কালচারাল প্রোগ্রামে হাজির হন। সড়কদুর্ঘটনা নিয়ে তাঁর সাম্প্রতিক ফেসবুক স্ট্যাটাসটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো।
সড়কদুর্ঘটনা সম্প্রতি মারাত্মক আকার ধারণ করছে। প্রতিদিন সড়ক-মহাসড়কে ঝরছে তরতাজা প্রাণ। খালি হচ্ছে অনেক বাবা-মায়ের বুক।
আদালত যখন সড়কদুর্ঘটনায় এক পা-হারানো হতভাগ্যকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা প্রদানের সময়সীমা ১০ এপ্রিল নির্ধারণ করে দেয়, তখন ওই বাস কোম্পানি গ্রিনলাইন পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার আবদুস সাত্তার আলালতের রায়কে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ বলে ধৃষ্টতা দেখাবার দুঃসাহস করেন। ইউসুফ আরেফিন মাসুদ লেখেছেন:
“সিটি কলেজের সামনে থেকে বাসে উঠলাম। জানালার পাশের সিটে একটা মেয়ে বসা। মেয়েটার পাশেই বসলাম। কাঁটাবন এসে কথায় কথায় পরিচয় হলো। তিতুমীরের ছাত্রী। ফার্স্ট ইয়ার। পাবনা বাড়ি। চাটমোহর। অল্প পরিচয়েও আপন মনে হলো। নিজের এলাকা। নিজের ক্যাম্পাস। তাই হয়তো।
নিউ মার্কেট থেকে বাসায় ফিরছিল মেয়েটা। সন্ধ্যার পর ঢাকার মানুষগুলো প্রচণ্ড টায়ার্ড হয়ে যায়। সুযোগ পেলেই ঘুমিয়ে পড়ে। মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কয়েকবার। বাংলামোটর পার হতেই দেখি বাসটা প্রচণ্ড বেগে ছুটছে। মেয়েটা তখন দিব্যি ঘুমোচ্ছে। জানালার সঙ্গে মাথা হেলান দিয়ে। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটছে আমাদের বাসটা। যদিও সেটা কারওয়ানবাজার পর্যন্ত। পাশ দিয়ে অন্য একটা বাস চলে গেল। আমরা যেটাতে আছি একদম সেটার গাঘেঁষে। মেয়েটা তখনও ঘুমোচ্ছে। কারওয়ানবাজার সিগন্যাল পার হয়ে পাশের বাসটা আমাদের বাসটাকে ওভারটেক করলো। শুরু হলো দুই বাসের মাঝে কম্পিটিশন। ভাব খারাপ দেখে মেয়েটার হাতে থাকা সাইডব্যাগটায় নাড়া দিলাম। মেয়েটার ঘুম ভেঙ্গে গেল। বললাম, পাশ দিয়ে বাস যাচ্ছে। হাতে লাগতে পারে। বাসায় গিয়ে ঘুমোনো যাবে। ঠিক সেই মুহুর্তে মেয়েটার পাশ দিয়ে পাশের বাসের ধাক্কা। একদম গাঘেঁষে। ইয়া আল্লাহ! এই বাস থেকে মেয়েটা যদি এক ইঞ্চিও জানালার বাইরে থাকতো তবে থেঁতলে যেতো। হয়তো অল্পের জন্য রক্ষা পেলো। তারপর ফার্মগেট। যথানিয়মে জ্যাম। জ্যামশেষে বাসায় ফিরলাম।
ঘটনার ঠিক একদিন পর সোমবার। হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনে। দুই বাসের রেষারেষিতে পেছনের গেইটে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছেলের হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এক টগবগে, সুস্থ-সবল যুবক। দুই বাসের চিপায় আটকে থাকে যুবকের বিচ্ছিন্ন হাতটি। সেই ছবি আলোচিত হয়। হচ্ছে এখনও।
হ্যাঁ, হাত-হারানো ছেলেটার নাম রাজিব হোসেন। তিতুমীরের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বাবা-মা নেই। বহুকষ্টে জীবন চলছিল। একহাত নিয়ে রাজিবের চিকিৎসা এবং বাকি জীবন কেমন চলবে সেটা সহজেই অনুমান করা যায়!
মাত্র কয়েকমাস আগের ঘটনা। বাসের হেল্পারের সঙ্গে বিতর্কের এক পর্যায়ে হেল্পার একজনকে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বাসের চাকার নিচে পড়ে পৃষ্ঠ হয়ে মর্মান্তিকভাবে নিহত হয় শাকিল। শাকিলের রক্তাক্ত ছবি দেখে সবাই শিউরে উঠেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই শাকিল ছেলেটাও তিতুমীরের ছাত্র। হিসাববিজ্ঞানে প্রথম বর্ষে পড়তো।
ঘটনা যেটাই হোক। তিতুমীরের হোক আর তিতুমীরের বাইরের কেউ হোক। ঢাকার হোক আর ঢাকার বাইরের হোক। এইসব ঘটে যাওয়া নিত্যনৈমিত্তিক দুর্ঘটনা খুবই দুঃখের। বেদনার। কষ্টের।
সেদিনের মেয়েটার বাসের ধাক্কা থেকে রক্ষা। রাজিবের হাত হারানো। শাকিলের নির্মমভাবে নিহত হওয়া। সবগুলোর মূলে যানবাহনের বেপরোয়া আচরণ এবং আমাদের অসাবধানতা। সামান্য একটু সতর্ক হলে অনেক স্বপ্নে গড়া, যত্নে গড়া জীবনগুলো ভালো থাকবে। বাস থেকে নামবার সময় বাসগুলো থামাতে চায় না। চলন্ত অবস্থায় যাত্রী নামায়। ‘বাম পা আগে দিয়ে নামেন’ বলেই নামবার আগেই বাস চলা শুরু করে। নামতে গিয়ে বাস থামালে সময় নষ্ট হয়। সেজন্যই চলন্ত বাস থেকে তারা যাত্রী নামায়। বাসভর্তি যাত্রী নিয়েও অতিরিক্ত যাত্রী তোলার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টার দাঁড়িয়ে থাকলে তাদের সময় নষ্ট হয় না। বলে রাখা ভালো, পাল্লা দিয়ে রাস্তায় চলাটা তাদের পৈশাচিক আনন্দ। অথচ এসব প্রতিটি ঘটনার সঙ্গেই মানুষের মূল্যবান জীবন জড়িত। এবং এসবের ফলেই ঘটছে দুর্ঘটনা। ঘটছেই প্রতিদিন। সেজন্য সবার আগে আমাদের সচেতন হতে হবে। বেপরোয়া যান চলাচল কিংবা যাত্রাপথে কোনও অসঙ্গতি দেখলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতে হবে। নিজে সতর্ক থাকবার পাশাপাশি পাশের মানুষটিকেও সতর্ক করতে হবে। আমাদের পাশের মানুষটি আমাদের চেনা অথবা অচেনা যে কেউ হতে পারেন। কিন্তু সেই পাশের মানুষটিই কিন্তু কারুর প্রিয়জন। কারুর আপনজন। কারুর সন্তান। কারুর বাবা-মা কিংবা আমাদের ভাইবোনের মতো তারাও কারুর ভাইবোন। কাজেই পৃথিবীর কেউ আমাদের পর নন। সবাই আপন। সবাই প্রিয়জন। অন্তত সমাজের মানুষতো বটেই।
এই প্রিয় মানুষ। প্রিয় পৃথিবীর প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া আমাদের পবিত্র দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতাও।
আসুন সবাই মিলে সজাগ হই, যত্নশীল হই সবার প্রতি। দুর্ঘটনা দূরে ঠেলে দিয়ে একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলি। চেষ্টা করি পরিবর্তনের।”
বলতে দ্বিধা নেই, সড়ক-মহাসড়কে এখন নৈরাজ্য চলছে। বাসজার্নির অপর নাম আতঙ্ক। জান হাতে নিয়ে পথচলা। চাইলেই জানটা পট করে আজরাইলের হাতে তুলে দেয়া আরকি!
পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে সুপ্রভাত বাস কোম্পানির ১৬৫টি গাড়ি চলাচল করে। তার মধ্যে ১৪৫টিরই নাকি রুটপার্মিট নেই। নেই ফিটনেসও। মানে মাত্র ২০ টির বৈধ কাগজপত্র অর্থাৎ সড়কে চলাচলের অনুমতি আছে। বাকিগুলো চলছে জঙ্গলি আইনে। এসব গাড়ি যারা চালায় তাদেরও নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স। অর্থাৎ গাড়ি এবং চালক সবাই ফিটনেসবিহীন। অন্যদিকে জাবালে নূর পরিবহন কোম্পানিরও অবস্থা তথৈবচ। তাহলে আবরারদের নির্মম এবং অকাল মৃত্যু ঠেকাবে কে? রাজিবদেরইবা হাতপা গাড়ির চাপায় বিচ্ছিন্ন হলে কে কী করবেন?
ডেইলি নিউনেশনের রিপোর্টে প্রকাশ, সুপ্রভাত পরিবহনের বাসগুলো নাম ও রং পাল্টে এখন হয়েছে ‘আকাশ এন্টারপ্রাইজ’। পত্রিকাটি হেডিং করেছে, “ওল্ড ওয়াইন ইন নিউ বোটল সুপ্রভাত নাউ ‘আকাশ’।” জাবালে নূরও হয়তো এমনই করবে খুব শিগগিরই। ইতোমধ্যে করেও ফেলতে পারে। এভাবেই চলছে দেশের পরিবহন ব্যবস্থা। কেউ কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। কারণ পরিবহনের মালিক ও শ্রমিকরা অনেক শক্তিশালী। মালিকদের কেউ কেউ রাজনৈতিক নেতা এবং ক্ষমতাসীনদলের সঙ্গে শক্তভাবে সংশ্লিষ্ট। তাই আইন-কানুন তাঁরা থোড়াই কেয়ার করেন। এমনকি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও তাঁদের বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নিতে অক্ষম। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলও।
সড়কে যানবাহন চলাচল করলে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। আহত হতে পারে যানবাহনের যাত্রী। আকস্মিক কেউ মারাও যেতে পারে দুর্ঘটনায়। পথচারী কিংবা যানবাহনে থাকা যাত্রী যেকারুর জীবনাবসান ঘটতে পারে। আবার মারাত্মকভাবে আহত হয়ে সারাজীবনের জন্য পঙ্গুও হয়ে যেতে পারে কেউ। এটাই দুর্ঘটনা। আকস্মিকভাবে যা ঘটে বসে। কিন্তু প্রতিনিয়ত অনিবার্যরূপে যদি কোনও ঘটনা ঘটে এবং অগণিত মানুষ মারা যায়, পঙ্গু হয় তাও কী দুর্ঘটনা? অদক্ষ ড্রাইভার, ফিটনেসহীন গাড়ি কিংবা মাদকাসক্ত হয়ে গাড়ি চালাতে অথবা সড়কে প্রতিযোগিতা করে যান চালাতে গিয়ে যদি কেউ দুর্ঘটনা ঘটায় এবং মানুষ মারা যায় কিংবা পঙ্গু হয় তাও কি দুর্ঘটনাই? নিশ্চয়ই না।
বলা হচ্ছে, কোনও ড্রাইভার সড়কে একটি পিঁপড়াও ইচ্ছে করে মারে না বা চাপা দেয় না। অথচ সুপ্রভাত এন্টারপ্রাইজ পরিবহন কোম্পানির ১৬৫টি বাসের ১৪৫টিই পারমিট ছাড়া চলছিল। জাবালে নূরসহ আরও অনেক ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির একই দশা। কোনওটার ফিটনেস নেই, রুট পার্মিট নেই, কোনওটার ড্রাইভিং সিটে হেল্পার বসে গাড়ি চালায়। এভাবেই চলছে মহানগরীসহ সারাদেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে বাস, মিনিবাস, ট্রাক, লরি ইত্যাদি। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো আছে ঠিকই। কিন্তু কেউ তাদের আটকায় না। আইনের হাতে সোপর্দ করে না। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে প্রতিদিন। ঘটছে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা। ঝরছে মানুষের তাজা রক্ত হররোজ। নিঃস্ব হচ্ছে অনেক পরিবার। কেউ হারাচ্ছেন স্বামী-সন্তান, কেউ হারাচ্ছেন সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে। কেউ হারাচ্ছেন সদ্যবিবাহিত স্বামী। কারুর নিহত হচ্ছেন নবপরিণীতা জীবনসঙ্গিনী। এমনই হৃদয়বিদীর্ণ করা ঘটনা ঘটছে আমাদের চারপাশে। প্রতিদিন। অসংখ্য। অগণিত। কোনওভাবেই রুখা যাচ্ছে না সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল! কিন্তু এর শেষ কোথায়? জানেন কেউ?
আসলে সড়কদুর্ঘনা কমাতে কঠোরভাবে ট্রাফিক আইন মেনে চলাসহ চালক, হেল্পারদের উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতেই হবে। খুব সতর্কতার সঙ্গে চলাচল করতে হবে পথচারীদেরও। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য এবিষয়ে পাঠ্যাংশও অন্তর্ভুক্ত যেতে পারে।
ইনসেট
—–
সড়ক-মহাসড়কে প্রতিদিন ঘটছে দুর্ঘটনা। ঝরছে প্রাণ। তাজা রক্ত। নিঃস্ব হচ্ছে অনেক পরিবার। কেউ হারাচ্ছেন একমাত্র সন্তান। উপার্জনক্ষম মানুষটি। প্রিয় স্বামী অথবা সহধর্মিণী। কিছুতেই থামছে না মৃত্যুর মিছিল। বরং হচ্ছে দীর্ঘতর!