ড. আশরাফ সিদ্দিকীর মৃত্যুবার্ষিকী ফিরে এল। হৃদয় দিয়ে তাঁর শুন্যতা অনুভব করছি। ২০২০ সালের ১৯ মার্চ তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুবার্ষিকীতে সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্টের উদ্যোগে লন্ডনে তাঁর আত্মার মাগফিরাতের জন্য বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন।
ড. আশরাফ সিদ্দিকী ছিলেন বিশিষ্ট লোকবিজ্ঞানী। বাংলাদেশে লোক ঐতিহ্য গবেষনায় তার তুলনা রহিত। বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যকে যারা সমৃদ্ধ করেছেন ড. আশরাফ সিদ্দিকী তাদের একজন। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, শিশু সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ড. আশরাফ সিদ্দিকী ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন।
আমি বিলেতে বাংলা চর্চা নিয়ে গবেষণা কালে ড. আশরাফ সিদ্দিকী বহুবার আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁকে জানিয়ে ছিলাম, বিলেতে বাংলা ভাষার চর্চা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের পর লন্ডনে সবচেয়ে বেশি বাংলা চর্চা হয়। ব্রিকলেন ‘বাংলা টাউন’ এখন ‘তৃতীয় বাংলা’ হিসেবে খ্যাত। গ্রেট বৃটেনে প্রায় ৫লাখ বাংলাদেশির বসবাস। শুধু টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে বাস করেন ৫০ হাজারের অধিক।
ড. আশরাফ সিদ্দিকী বিলেতে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা সম্পর্কে লেখা চেয়েছিলেন। ’বিলেতে বাংলা চর্চা ও বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন’ শীরোনামে একটি লেখা পাঠিয়েছিলাম। ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। সেখানে আমি উল্লেখ করেছি, বিলেতে বাংলা ভাষার চর্চা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের পর লন্ডনে সবচেয়ে বেশি বাংলা চর্চা হয়। ব্রিকলেন ‘বাংলা টাউন’ এখন ‘তৃতীয় বাংলা’ হিসেবে খ্যাত। গ্রেট বৃটেনে প্রায় ৫লাখ বাংলাদেশির বসবাস। শুধু টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে বাস করেন ৫০ হাজারের অধিক।
ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে সিলেট অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভাবে চায়ের চাষ শুরু হলে চা রফতানির কাজে সিলেটের মানুষ বিলেত যাত্রা শুরু করেন। এরপর জাহাজ শ্রমিক হিসেবে ব্যাপক হারে মানুষ বিলেত পাড়ি জমিয়েছেন। উচ্চতর পড়ালেখার জন্যও এসেছেন অনেকে। ভ্রমণ, কর্মসংস্থান এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ নিয়েও হাজার হাজার মানুষ প্রবাসী হয়েছেন। উচ্চ শিক্ষিতরা বিভিন্ন পেশায় জড়িত হলেও অসীম সাহসী সাধারণ মানুষ বিলেতে গড়ে তুলেছেন একের পর এক রেষ্টুরেন্ট। গত শতকে বাংলাদেশিদের প্রতিষ্ঠিত প্রায় দশ হাজার রেস্টুরেন্ট এখন বৃটেনের কারি ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমার সম্পাদিত বাংলাদেশি ব্যবসা-বাণিজ্যের নাম ঠিকানা ও ফোন নাম্বার সম্বলিত ‘ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরি’তে আরো অনেক তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে।
নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশিরা গড়ে তুলেছেন মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। যেখানে ধর্ম ও ভাষা চর্চা চলছে সমান্তরাল ভাবে। বহুজাতিক সমাজের আবাসস্থল মাল্টিকালচারাল লন্ডন সিটিতে ১৩১টি স্পোকেন ল্যাঙ্গুয়েজ আছে। ভাষার দিক থেকে বাংলার অবস্থান এখন চতুর্থ। এভাবে বিলেতে বাংলাদেশিরা বাংলা ভাষার বিশ্বায়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।
বাঙ্গালির বিলেত জয় সম্পর্কে তথ্য চেয়েছিলেন ড. আশরাফ সিদ্দিকী। মূলত: বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জে বসবাসের শতক অনেক আগেই পেরিয়েছে অভিবাসী বাংলাদেশি জনগোষ্ঠি। বৃটেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৪জন এমপি রয়েছেন। বৃটিশ পার্লামেন্টে রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রুপা হক ও আফসানা বেগম শক্তিশালী অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছেন। হাউজ অব লর্ডসে আছেন পলা মঞ্জিলা উদ্দিন। বিভিন্ন কাউন্সিলে মেয়র ও কাউন্সিলর হয়েছেন বহু বাংলাদেশি। বৃটিশ বাংলাদেশী কূটনীতিবিদ আনোয়ার চৌধুরী বৃটিশ হাই কমিশনার হিসেবে বেশ খ্যাতি কুড়িয়েছেন।
ব্রিকলেন বাংলা টাউন বিলেতের মানচিত্রে একটা আইকনের মর্যাদা পেয়েছে। কিছু কিছু স্কুল-কলেজে জিসিএসই ও এ-লেভেলে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ একটা বিষয় হিসেবে পড়ানো হচ্ছে। বিলেতের মাধ্যমিক স্কুলে ছেলে-মেয়েদের বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে দ্বিতীয় কোন ভাষা পড়তে হয়। টাওয়ার হ্যামলেটসের স্মিদি স্ট্রিট স্কুলে পাইলট প্রজেক্টের অধীনে মডার্ন ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে বাংলা পড়ানো শুরু হয় ২০০৭ সালে।
বাংলাদেশ প্রেমিক ড. উইলিয়াম রাদিচে বাংলা ভাষা নিয়ে অনেক কাজ করছেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের সোয়াস (স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ)-এর শিক্ষক। সেখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গুরুত্বের সঙ্গে চর্চা হয়। অভিবাসিদের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দেওয়ায় বৃটেনে বাংলা ভাষাও গুরুত্ব পাচ্ছে।
বাংলা টাউন থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বাংলায় হয়েছে। মসজিদ, দোকানপাট, হাসপাতাল, পার্ক সবখানে বাংলার ব্যবহার বেড়েছে। নিউহাম, ওয়েস্টহাম, ক্যামডেন, বার্মিংহাম, ম্যানচেষ্টার, কার্ডিফ ও নিউক্যাসলের মতো এলাকাগুলোতে অনেক প্রতিষ্ঠান ও রাস্তার নাম বাংলায় লেখা আছে ।
বাংলাদেশি কমিউনিটিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় আলোচনা ও জাতীয় দিবসগুলো বাংলা চর্চার প্রধান অবলম্বন। বাংলা সংবাদপত্র ও রেডিও-টেলিভিশন এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বাংলা ভাষা ও ধর্মীয় সংস্কৃতি চর্চার লক্ষ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক প্রবাসী স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বিলেতে চলে এসেছেন।
লন্ডনে বঙ্গবন্ধু স্কুল, ওসমানী স্কুল, কবি নজরুল প্রাইমারি স্কুল, আলতাব আলী পার্ক, বাংলাদেশ সেন্টার, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বাঙ্গালি জাতি ও বাংলা ভাষার পরিচয় ধারণ করে আছে। ড্রাইভিং টেস্টের থিওরি পরীক্ষায় এবং এনএইচএস হাসপাতালগুলো ভয়েস ডিরেকশনে অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি বাংলা ও সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় নির্দেশনা চালু হয়েছে। স্থানীয় স্কুলগুলোতে স্বকীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ও সিলেটি ভাষা তালিকাভুক্ত হয়েছে। অসংখ্য লাইব্রেরিতে এখন বাংলা বই গুরুত্বের সাথে রাখা হয়।
বিলেতে বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতার শতবছর পুর্ণ হয়েছে। ১৯১৬ সালের ১ নভেম্বর পাক্ষিক ‘সত্য বাণী’ প্রকাশিত হয়। এরপর মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিকসহ বহু পত্রিকা ও ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে। রেডিও-টেলিভিশন এবং বেশ কয়েকটি অনলাইন পত্রিকাও সুনামের সাথে পরিচালিত হয়ে আসছে। আমার সম্পাদিত ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) ৫৭টি দেশের তত্ব ও তথ্য সমৃদ্ধ ডাইরেক্টরি মুসলিম ইন্ডেক্স ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছে। সেখানেও বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা স্থান পেয়েছে খুবই গুরুত্বের সাথে।
বৃটেনের সকল এশিয়ান রেষ্টুরেন্ট নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ইউকে এশিয়ান রেষ্টুরেন্ট ডাইরেক্টরি। এতে প্রমাণিত হয়েছে এশিয়ান ১৮ হাজার রেষ্টুরেন্টের মধ্যে অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশি। এভাবেই বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা আলোচনায় আসছে বার বার।
ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় দিন একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ বিশেষ ভাবে বিদেশিদের বাংলা চর্চায় উৎসাহ যুগিয়েছে। বাংলাদেশি হিসেবে নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের জন্য বাংলার প্রতি আন্তর্জাতিক বিশ্বের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর লন্ডনের আলেক্সজান্ডার প্যালেসে ডক্টর ইউনুসকে দেয়া সম্বর্ধনা সভায় বৃটিশ ও ইউরোপীয় এমপিসহ প্রায় ২ হাজার মানুষের উপস্থিতি ও ইউরোপীয় মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার এরই প্রমাণ বহন করে।
বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা, ডয়েচে ভেলে, রেডিও জাপান, চীন আন্তর্জাতিক বেতার, মস্কো রেডিও, রেডিও ভেরিটাস, কানাডার বাংলা রেডিও চ্যানেল সহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বাংলা ভাষার প্রচার-প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
বিলেতে অধ্যয়ন শেষে অনেক বাংলাদেশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। দেশ থেকেও অনেকে গিয়েছেন এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকার দেশে দেশে।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ করছেন বাংলাদেশের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর বহু সদস্য। ফলে সেসব স্থানেও বাংলা ভাষা চর্চা হচ্ছে নানাভাবে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, টেকনোলজিক্যাল গ্লোবালাইজেশন মানবজাতির ভাষাকেও বিশ্বায়িত করে তুলছে দ্রুতগতিতে। সম্প্রতি সিয়েরা লিয়ন বাংলা ভাষাকে তাদের দেশে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। এভাবেই বাংলা ভাষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে পৃথিবীব্যাপী।
দীর্ঘদিন বিদেশে বসবাসের ফলে অনেক বাংলাদেশি বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছেন। রাজনীতিতে আপন কর্মদক্ষতা গুণে অনেকে লাভ করেছেন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদ-পদবি। এতে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশি জাতির মর্যাদা বেড়েছে।
আমার লেখাটি পড়ে ড. আশরাফ সিদ্দিকী লন্ডন নিয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেছিলেন। আমরা চেয়েছিলাম তৃতীয় বাংলা খ্যাত লন্ডনে তাঁকে নিয়ে আসা উচিত। কথাও হয়েছিল আসবেন। তাঁর জনপ্রিয় ভ্রমণ কাহিনী ‘প্যারিস সুন্দরী’র মত লন্ডন নিয়ে আরেকটা বই লিখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯-এর কারণে সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। এরই মাঝে তিনিও চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
১৯৯৯ সালে আমার বিয়ের ম্যাগাজিন ‘হৃদয়ের জানালা’য় চমৎকার লেখা দিয়েছিলেন ড. আশরাফ সিদ্দিকী। তারও আগে সিলেটে তাঁকে নিয়ে প্রাণবন্ত অনুষ্ঠান করেছি। ১৯৮৯ সালে দূর্বার সাহিত্য সংকলনে লেখা নেয়ার জন্য প্রথম সাক্ষাৎ করি। এরপর বার বার তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি। আজ এসব স্মৃতি আমাকে কাতর করে।
৪০ এর দশকের শুরুতে প্রতিশ্রুতিময় কবি হিসেবে ড. আশরাফ সিদ্দিকীর আত্মপ্রকাশ। সাহিত্যিক জীবনে তিনি রচনা করেছেন পাঁচশ এর অধিক কবিতা। বাংলার লোক ঐতিহ্য নিয়ে করেছেন গভীর গবেষণা। তিনি রচনা করেছেন ৭৫টি গ্রন্থ এবং অসংখ্য প্রবন্ধ।
১৯৪৮ সালে দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে ‘তালেব মাষ্টার’ কবিতা রচনা করে তিনি অল্প সময়ের মধ্যে গণ মানুষের কবি হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ‘গলির ধারের ছেলেটি’ ছোট গল্প লেখক হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ছোট গল্প অবলম্বনে সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘ডুমুরের ফুল’ চলচ্চিত্রটি জাতীয় পুরস্কার পায়।
বাংলার মৌখিক লোক সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে লিপিবদ্ধ করার জন্য ড. আশরাফ সিদ্দিকী বিশেষভাবে সমাদৃত। তার লেখা বইগুলো ‘লোকসাহিত্য’, ‘বেঙ্গলী ফোকলোর’, ‘আওয়ার ফোকলোর আওয়ার হেরিটেজ’, ‘ফোকলোরিক বাংলাদেশ’ এবং ‘কিংবদন্তীর বাংলা’ দক্ষিণ এশিয়ার লোক সাহিত্যে গবেষণায় মৌলিক বই হিসেব বিবেচিত হয়।
‘ভোম্বল দাশ: দ্যা আঙ্কল অব লায়ন’ এবং ‘টুনটুনি এন্ড আদার ষ্টোরিজ’ ইত্যাদি গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে তিনি বাংলার লোকজ গল্পকে বিশ্ব সাহিত্যের ভান্ডরে পৌছে দেন। ১৯৫৮ সালে প্রখ্যাত ম্যাকমিলান পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত তার ‘ভোম্বল দাশ’ বইটি ছিল সে বছরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক বিক্রিত শিশুদের বইয়ের তালিকায়। পরে এ বইটি ১১টি ভাষায় অনূদিত হয়। তার ৭০দশকে লেখা ‘রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন’ ও ‘প্যারিস সুন্দরী’ আজও তরুণ পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়।
ড. আশরাফ সিদ্দিকী পড়াশোনা করেছেন শান্তিনিকেতন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে তিনি আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় এমএ এবং পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি রাজশাহী কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, ময়মনসিংহের এএম কলেজ, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।
ড. আশরাফ সিদ্দিকী কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক, ডিস্ট্রিকট গ্যাজেটিয়ারের প্রধান সম্পাদক ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার চেয়ারম্যান, প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট, নজরুল একাডেমির আজীবন সভাপতি এবং নজরুল ইনস্টিটিউটের সভাপতির দায়িত্বপালন করেন। ত্রিশালে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন তিনি।
ড. আশরাফ সিদ্দিকী বহুবর্ণিল কর্মযজ্ঞের ভেতর দিয়ে তার দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করেছেন। ১৯২৭ সালের ১ মার্চ নানাবাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নাগবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা আব্দুস সাত্তার সিদ্দিকী ছিলেন সৌখিন হোমিও চিকিৎসক এবং ইউনিয়ন পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান। মা সমীরণ নেসা ছিলেন স্বভাব কবি।
আশরাফ সিদ্দিকী তার নানাবাড়ির পাঠশালায় শিক্ষাজীবন শুরু করেন। দ্বিতীয় থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন নিজেরই বাবার প্রতিষ্ঠিত রতনগঞ্জ মাইনর স্কুলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন প্রথম কবিতা লেখেন। সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে। মামা আবদুল হামিদ চৌধুরীর বাসায় থেকে পড়াশোনা করতেন। সপ্তম শ্রেণিতে থাকাকালীনই তার কবিতা ‘স্বগত’ ও ‘পূর্বাশা’ সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ সময় তিনি কিছু আঞ্চলিক বাংলা ধাঁধা সংগ্রহ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাঠান। রবীন্দ্রনাথ তার প্রশংসা করেন। এর কিছুদিন পর তিনি শান্তিনিকেতনে পড়ার জন্য ভারতে চলে যান।
আশরাফ সিদ্দিকী ১৯৪৭ সালে শান্তিনিকেতনে বাংলায় অনার্স পড়াকালীন দেশবিভাগ হলে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধীনস্থ টাঙ্গাইলের করটিয়া সরকারি সা’দত কলেজ থেকে অনার্স সম্পন্ন করেন। অনার্স কোর্সে বাংলা সাহিত্যে তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম হন। এরপর ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয়বার এমএ করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে লোকসাহিত্যে পিএইচডি করেন।
১৯৫০ সালে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন আশরাফ সিদ্দিকী। ১৯৫১ সালে এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন রাজশাহী সরকারি কলেজে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ায় তার সাথে গবেষণার জন্য ওই বছর নভেম্বর মাসে ডেপুটেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে আবার ফিরে যান রাজশাহী কলেজে। তিনি ১৯৫৭ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে বদলি হয়ে ঢাকা কলেজে যোগ দেন এবং সেখান থেকেই উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান।
১৯৬৭ সালে পিএইচডি শেষ করে কিছুদিন ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে অধ্যাপনা করেন। একই বছর ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ারে প্রধান সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে দায়িত্ব পান তদানীন্তন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালকের। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ারের প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন।
আশরাফ সিদ্দিকী ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ছয় বছর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৮৩ সালে জগন্নাথ কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীনই দীর্ঘ কর্মজীবন থেকে অবসর নেন আশরাফ সিদ্দিকী।
এসবের বাইরেও বিভিন্ন সময় গুণী এ ব্যক্তি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার চেয়ারম্যান, প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট, নজরুল একাডেমির আজীবন সভাপতি ও নজরুল ইনস্টিটিউটের সভাপতির দায়িত্বপালন করেন। ত্রিশালে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছেন আশরাফ সিদ্দিকী।
৪০ এর দশকের শুরুতে প্রতিশ্রুতিময় কবি হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ। দেশবিভাগের পর অভাবের তাড়নায় এক স্কুলশিক্ষক পরিবারের সবাইকে নিয়ে আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনা আশারফ সিদ্দিকীকে তুমুল নাড়া দেয় ও তার সাহিত্য রচনার প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। সে সময় তিনি লেখেন কালজয়ী কবিতা ‘তালেব মাষ্টার’ । এ কবিতার মধ্য দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে গণমানুষের কবি হিসেবে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৫০ সালে এটিকেই নামকবিতা করে প্রকাশ পায় তার কবিতার বই ‘তালেব মাষ্টার ও অন্যান্য কবিতা’। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় তার কবিতার বই- সাত ভাই চম্পা, বিষকন্যা, ও উত্তরের তারা।
১৯৬৫ সালে ‘রাবেয়া আপা’ নামক গল্প দিয়ে গল্পকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন আশরাফ সিদ্দিকী। ‘গলির ধারের ছেলেটি’ গল্পটি তাকে গল্পকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।] এ গল্প অবলম্বনে নির্মিত প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্ত পরিচালিত ডুমুরের ফুল চলচ্চিত্রটি একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও লাভ করে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক সাহিত্য বিষয়ে পড়াকালীন তিনি রচনা করেন শিশুতোষ সাহিত্য ‘সিংহের মামা ভোম্বল দাস’, যা বিশ্বের ১১টি ভাষায় অনূদিত হয়। ‘ভোম্বল দাশ: দ্যা আঙ্কল অব লায়ন’ এবং ‘টুনটুনি এন্ড আদার স্টোরিজ’ গ্রন্থগুলোর মধ্যে দিয়ে তিনি বাংলার লোকগল্পকে বিশ্ব সাহিত্যের ভাণ্ডারে পৌঁছে দেন। ১৯৫৮ সালে প্রখ্যাত ম্যাকমিলান পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত তার ‘ভোম্বল দাশ’ বইটি ছিল সে বছরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক বিক্রিত শিশুদের বইয়ের তালিকায়।
এছাড়া ৭০-এর দশকে লেখা আশরাফ সিদ্দিকীর বই ‘রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন’ ও ‘প্যারিস সুন্দরী’ আজও তরুণ পাঠকদের কাছে বিপুল জনপ্রিয়।
বাংলার মৌখিক লোক সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে লিপিবদ্ধ করার জন্য ড. আশরাফ সিদ্দিকী বিশেষভাবে সমাদৃত। তার লেখা- ‘লোকসাহিত্য’, ‘বেঙ্গলী ফোকলোর’, ‘আওয়ার ফোকলোর আওয়ার হেরিটেজ’, ‘ফোকলোরিক বাংলাদেশ’, ‘কিংবদন্তীর বাংলা’ দক্ষিণ এশিয়ার লোক সাহিত্যে গবেষণায় মৌলিক বই হিসেব বিবেচিত হয়। এছাড়া বাংলাদেশের লোক সাহিত্য নিয়ে লেখেন ‘লোক সাহিত্য প্রথম খণ্ড’। এরই ধারাবিহিকতায় ‘কিংবদন্তির বাংলা’, “শুভ নববর্ষ’, “লোকায়ত বাংলা’, “আবহমান বাংলা’, “বাংলার মুখ’ বইগুলো প্রকাশিত হয়। ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকে শোনা রূপকথার গল্প থেকে অণুপ্রাণিত হয়ে ১৯৯১ সালে লেখেন ‘বাংলাদেশের রূপকথা’ নামক বইটি।
দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে আশরাফ সিদ্দিকী রচনা করেছেন পাঁচশ’র অধিক কবিতা। কবিতা, বাংলার লোকঐতিহ্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে তিনি রচনা করেছেন ৭৫টিরও অধিক গ্রন্থ। এছাড়া অগ্রন্থিত অনেক মূল্যবান লেখাপত্র রয়েছে।
বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন আশরাফ সিদ্দিকী।
১৯৫১ সালের ২৩ ডিসেম্বর সাঈদা সিদ্দিকীকে বিয়ে করেন আশরাফ সিদ্দিকী। স্ত্রী সাঈদা ছিলেন আজিমপুর গালর্স হাই স্কুলের শিক্ষিকা। তাদের পাঁচ সন্তান সবাই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং নিজ নিজ পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত। তার ছেলে সাঈদ সিদ্দিকী বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ‘ক্যাটস্ আই’-এর চেয়ারম্যান, আরেক ছেলে নাহিদ আলম সিদ্দিকী’স ইন্টারন্যাশনাল-এর অধ্যক্ষ, মেয়ে তাসনিম সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আরেক ছেলে রিফাত আহমদ সিদ্দিকী’স ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারপারসন ও রিয়াদ সিদ্দিকী নামে আরেক ছেলে ক্যাটস আই-এর পরিচালক।