সম্পাদক পরিষদের আলোচনা সভায় বক্তাদের প্রশ্ন দেশের গণমাধ্যম চরম সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে : এ থেকে মুক্ত হতে ঐক্যবদ্ধ ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : ডিজিটাল নজরদারিতে সংবাদপত্রে সেলফ সেন্সরশিপ চলছ
ডিজিটাল অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) প্রণয়ন করা হলেও এর সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা হচ্ছে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর। এ আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। আইনটির ২০টি জায়গায় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে, যার ১৪টিই জামিন অযোগ্য। প্রণয়নের পর গত ৪ বছরে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ আইনের যথেচ্ছা ব্যবহার করা হচ্ছে। সর্বোপরি দেশের স্বাধীন সাংবাদিকতা বিকশিত হওয়ার বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। বক্তারা আরো বলেন, গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে রেখে দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ সম্ভব হবে না। এ আইন নিপীড়নমূলক, এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়াবহতা আমরা উপলব্ধি করছি। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার বিকাশের লক্ষ্যে যা কিছু করার আমরা সব কিছু করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল সম্পাদক পরিষদ ‘বিশ্বমুক্ত গণমাধ্যম দিবস : ডিজিটাল নজরদারিতে সাংবাদিকতা’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে।
সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন, নিউজ পেপারর্স ওনার্স এসোসিয়েশনের (নোয়াব) সভাপতি এ কে আজাদ, ইংরেজী দৈনিক নিউএজের সম্পাদক নূরুল কবীর, সম্পাদক পরিষদের সহ-সভাপতি ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, সম্পাদক পরিষদের কোষাধ্যক্ষ মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, বিএফউজের সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আসহান বুলবুল, বর্তমান সভাপতি (একাংশের) ওমর ফারুক, বিএফইউজের সভাপতি (একাংশের) এম আব্দুল্লাহ, ডিইউজের সভাপতি কাদের গণি চৌধুরী এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু।
এ ছাড়া সম্পাদক পরিষদের সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, আজকের পত্রিকার সম্পাদক গোলাম রহমান, সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, মুস্তাফিজ শফি প্রমুখ। আলোচনা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।
সভাপতির বক্তব্যে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, স্বাধীন মত প্রকাশের বিরুদ্ধে এত আইন কেন? আমরা কি করি? যার জন্য এত আইন দিয়ে আমাদের হাত-পা বেঁধে দিতে হবে। এখন আবার গণমাধ্যম আদালত, আপিল আদালত এমন নানা আদালত সৃষ্টি কর গণমাধ্যমের হাত পা আরো বেশি বেঁধে দেয়ার প্রয়াস হচ্ছে। আমার একটি সহজ বক্তব্য, গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ হবে না। গণতন্ত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একটি চেতনা, একটি স্বপ্ন। তাই আমি মনে করি, গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে গণতন্ত্রকে ব্যাহত করার চেষ্টা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী।
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনমুক্ত গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার বিকাশের অন্তরায়। এ আইনের ভয়াবহতা আমরা উপলব্ধি করছি। এর ১৪টি ধারই জামিন অযোগ্য। ২০টি ধারা আছে সাংবাদিকদের সাজা দেওয়ার জন্য। এটা সবচেয়ে জঘন্য আইন। এ আইন কার্যকর না হলেও ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ আইন থাকলেই মনে হবে এ আইনে আমাকে যে কোনো সময় আটক করতে পারে।
তিনি বলেন, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার বিকাশের লক্ষ্যে প্রয়োজনে সম্পাদক পরিষদ সব কিছু করবে বলেও তিনি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার এ দুঃসময় অতিক্রম করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করারও উদ্যোগ গ্রহণ করবে সম্পাদক পরিষদ।
নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, সংবাদপত্রে জগৎ আজ অনেকটা সঙ্কুচিত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকতাকে আরও সঙ্কুচিত করেছে। বলা যায়, সংবাদপত্র এখন চরম দুঃসময় অতিক্রম করছে। বর্তমানে এক টন কাগজের দাম ১ হাজার ডলার। তাও এলসি খুলে সময় মতো কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। একটি পত্রিকা বের করতে ২৮ টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় ১০ টাকায়, আমরা পাই ৬ টাকা। সেটাও থাকে বাকি। বিজ্ঞাপনে যে আয় হয়, করোনার কারণে সেটাও এখন খুব কমে গেছে। সব মিলিয়ে সংবাদপত্রে খুবই করুণ অবস্থা। এর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এর কণ্ঠ চেপে ধরে আছে। এ অবস্থায় সংবাদপত্রের বিকাশে সাহসী নেতৃত্বের খুবই প্রয়োজন। সম্পাদক পরিষদ সে উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে আমি আশা রাখি। আর সে উদ্যোগের সাথে আমার সম্পৃক্ততা ও সহযোগিতা সব কিছুই থাকবে।
নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ নতুন বিষয় নয়। যখনই যে সরকার কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছে, তখনই তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে হরণ করেছে। সাংবাদিকদের নিপীড়ন করেছে। মনে রাখতে হবে, বিবেকের স্বাধীনতা দিয়ে সমালোচনা প্রকাশ করার স্বাধীনতা যেখানে থাকে না, সেখানে গণতন্ত্রও থাকে না। আমাদের সংবাদপত্রের যে চরম সঙ্কটকাল যাচ্ছে, তা থেকে মুক্ত হতে হলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে হবে। নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দ্বারা আমরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছি। এর থেকে মুক্ত হতে হলে আমাদের ঐক্য ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
সম্পাদক পরিষদের সহ-সভাপতি শ্যামল দত্ত বলেন, নজরদারি থাকলে তাকে মুক্ত সাংবাদিকতা বা মুক্ত গণমাধ্যম বলা যাবে না। গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে একের পর এক আইন হচ্ছে। এত আইন হলে কি মুক্ত সাংবাদিকতা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এটা নজরদারি নয়, এটাকে ডিজিটাল অরোধ বলা যায়। এই ডিজিটাল অবরোধ থেকে মুক্ত হতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সম্পাদক পরিষদ এ উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে আশা করি।
সম্পাদক পরিষদের কোষাধ্যক্ষ মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, এখানে বলা হয়েছে, ডিজিটাল নজরদারিতে সাংবাদিকতা। আসলে নজরদারির পর্যায়ে নেই। সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতন আরও আগেই শুরু হয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে এরই মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। সংবাদপত্রে এখন সেলফ সেন্সরশিপ চালু হয়ে গেছে। আমি আমার বিবেক যা বলে তা লিখতে পারি না। বিবেকের স্বাধীনতা প্রকাশ করতে গেলেই আমাকে জেলে যেতে হবে। নানান হয়রানির শিকার হতে হবে। এই যে এক ভীতিকর অবস্থা, এ থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস প্রয়োজন। সত্তর দশকে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে এদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রেখেছি। ৯০ এ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়ও ঐক্যবদ্ধ থেকে আন্দোলন করেছি। তখন পত্রিকা পর্যন্ত বন্ধ ছিল। এখনও এ সঙ্কটকাল অতিক্রম করতে হলে সম্মিলিত প্রয়াসের প্রয়োজন।
বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, গণমাধমের বিরুদ্ধে শুধু বাংলাদেশে বিশ্বের ৪৪টি দেশে ৫৭ ধরনের আইন রয়েছে। বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে সাংবাদিকতাকে শৃঙ্খলিত করা হয়েছে। সংবাদপত্রের ওপর নজরদারি নতুন কিছু নয়। সব সরকারের আমলেই সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতন চলেছে। সংবাদপত্রের এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য সম্পাদক পরিষদ সাংবাদিকদের সব সংগঠনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে নতুন করে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সঙ্কট দূর করা সম্ভব বলে মনে করি।
বিএফইউজের সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, সম্পাদক এবং সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে সকল বাধা অতিক্রম করা সম্ভব। তিনি সংবাদপত্রে নবম ওয়েজবোর্ড কার্যকর করার বিষয়ে সম্পাদকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
বিএফইউজের সভাপতি এম আব্দুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। দেশের সকল সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের মোবাইল ফোন নজরদারিতে হয়েছে। ২০২০ সালে দেশে ১৫৯ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০২১ সালে নির্যাতিত হয়েছে ১৮২ জন। গত ১৩ বছরে ৪৫ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করতে হবে।
ডিইউজের সভাপতি কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের মঙ্গলের জন্য নয়। এটা সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করার জন্য। তাই এটা একটা কালাকানুন। এ সরকার সাংবাদিকদের নিপীড়ন-নির্যাতনের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ব্যবহার করছে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করতে হবে।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু বলেন, আমরা এখন ডিজিটাল নজরদারির মধ্যে আছি। এ নজরদারি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হচ্ছে। সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে আমাদেরকে নজরদারি করছে। এতে স্বাধীন সাংবাদিকতা বিঘ্নিত হচ্ছে।