ওয়েছ খছরু সিলেট থেকে :
দিনে দিনে সিলেটের আন্ডারওয়ার্ল্ড সক্রিয় হয়ে উঠছে। চোখ রাঙাচ্ছে চিহ্নিত ও দাগি অপরাধীরা। এরই মধ্যে সিলেট নগরের কয়েকটি এলাকা চলে গেছে অপরাধীদের দখলে। রাতের বেলা ওইসব এলাকা এড়িয়ে চলে মানুষ। দিন দিন পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে।
রাজনীতির আড়ালে চিহ্নিত অপরাধীরা ফিরতে শুরু করেছে আস্তানায়। এতে করে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের ঘটনা দিয়ে সিলেটের অপরাধীদের দৌরাত্ম্য শুরু হয়। গত বছরের ১২ই ডিসেম্বর রাতে নগরের ফাজিলচিস্ত এলাকা থেকে মিসবাহকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় সাগরদীঘির পাড়ে। সেখানে সর্বদলীয় অপরাধী চক্রের পক্ষ থেকে মিসবাহ সিরাজের মুক্তিপণ হিসেবে চাওয়া হয় কোটি টাকা। পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে- পরে ২৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে মিসবাহ সিরাজকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয় সাগরদীঘিরপাড় এলাকার লোকজন জানিয়েছেন- মিসবাহকে অপহরণ করে সাগরদীঘির পাড়ের ড্রিমসিটিতে রাখা হয়েছিল। ওই সময়ের একটি সিসিটিভি’র ফুটেজ বিশ্বনাথের আব্দুল খালেক নামে এক ব্যক্তির কাছে ছিল। ওই সিসিটিভি ফুটেজ ফেরত না দেয়ায় ড্রিমসিটির ভেতরে বিশ্বনাথের ওই ব্যক্তির স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হয়। পরে অবশ্য সাগরদীঘির পাড় এলাকাবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদে ওই অপরাধ আস্তানার দৌরাত্ম্য কমেছে।
তবে, ড্রিমসিটির মতো সিলেট নগরে গড়ে উঠেছে একাধিক অপরাধ আস্তানা। এর মধ্যে একটি হচ্ছে জিন্দাবাজার। গত শুক্রবার রাতে জিন্দাবাজারের এক হকারকে অপহরণ করে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করে যুবদলের একটি গ্রুপ। এ ঘটনায় হকাররা প্রতিবাদ শুরু করে সড়ক ব্যারিকেড দেয়। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে নগর যুবদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাধব চৌধুরীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
রোববার পুলিশ সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ জানিয়েছে, মাধবের নেতৃত্বে নগরের জিন্দাবাজার কেন্দ্রিক একটি অপরাধ আস্তানা পরিচালিত হতো। ওখানে আড্ডা দিতো কুখ্যাত অপরাধীরা। তারা হকারদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় সহ ছিনতাই করে বেড়াতো।
মাধব গ্রুপের কাছে অস্থির ছিল এলাকা। তবে সে গ্রেপ্তারের পর তার সহযোগীরা গা ঢাকা দিয়েছে। বিএনপি’র এক সিনিয়র নেতা মাধবকে শেল্টার দিয়ে জিন্দাবাজারকে অশান্ত করে রেখেছিলেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে। কয়েক মাস আগে নগরের ফরহাদ খাঁ পুলের পাশে এক ব্যবসায়ীর কোটি টাকা ছিনতাই হয়। এ ঘটনায় শাহপরান থানায় অভিযোগ দায়ের করা হলে উপশহর কেন্দ্রীয় ওই অপরাধী গ্রুপ সব সময়ই রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে ছিনতাই সহ নানা অপরাধমূলক ঘটনায় অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর নেপথ্যে কী- অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অপরাধীদের অবাধ বিচরণ। তারা নগরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডকে সক্রিয় করে তোলেছে। এতে করে পালিয়ে যাওয়া অপরাধীরা ফের এলাকায় ফিরে অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত করছে। স্বাপ্লাই এলাকার অপরাধীরাও সক্রিয় হচ্ছে।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার বাসিন্দা ও বর্তমানে নগরীর বালুচরে বসবাসকারী সৈয়দ লোকমান গত শনিবার রাত ২টায় নগরীর শাহী ঈদগাহে ছিনতাইয়ের শিকার হন। তিনি জানান, মিরবক্সটুলাস্থ একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার স্ত্রীর সিজার হয়েছে। স্ত্রীকে দেখে রাত ২টায় পায়ে হেঁটে তিনি বালুচর যাচ্ছিলেন। পথে শাহী ঈদগাহ ‘আল্লাহু চত্বর’ এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী দু’জন ছিনতাইকারী তার গতি রোধ করে। তারা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তার কাছে থাকা দুই হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়।
নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকার বাসিন্দা লিপন আহমদ জানান, সমপ্রতি মেন্দিবাগ এলাকার একটি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বন্দরগামী একটি সিএনজি অটোরিকশায় উঠেন। রিকশায় আরও দুজন যাত্রী ছিল। সোবহানীঘাট আসার পর চালক আম্বরখানার দিকে যেতে উদ্যত হয়। পেশায় সিএনজি অটোরিকশা চালক লিপন এতে কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে জেল রোডে গিয়ে তিনি চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। গাড়ি থেকে নেমে দেখেন, তার পকেটে থাকা লাইসেন্সের ১০ হাজার টাকা নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, এ ছিনতাইয়ের সঙ্গে অবশ্যই সিএনজি অটোরিকশা চালকের যোগসাজশ রয়েছে।
সিলেট এখন ছিনতাইয়ের স্বর্গরাজ্য। এর কারণ হচ্ছে নগরে আইনশৃঙ্খলায় সক্রিয় নয় পুলিশও। এ কারণে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য কমানো সম্ভব হচ্ছে না। থানা ও ফাঁড়ি লুট করে নেয়া অস্ত্রগুলো এখনো অপরাধীদের হাতে রয়েছে। নগরের বেশির ভাগ ফাঁড়ির কার্যক্রম শুরু হয়নি। ফলে অপরাধ রাজ্য হানা দিয়ে তছনছ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে সিলেট নগরীতে ছিনতাইকারীদের অপতৎপরতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমে স্বীকার করেছেন কোতোয়ালি থানার ওসি জিয়াউল হক। তবে অপরাধী গ্রেপ্তারের বিষয়ে অভিযান জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন-গত এক মাসে পুলিশ অভিযান চালিয়ে নগরী থেকে ৫৭ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। আর গত ৪ দিনে ৫টি চাকুসহ ১০ ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশ ছোট ও বড় দলে বিভক্ত হয়ে নগরীতে টহল দিচ্ছে। ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে তারা কঠোর অবস্থানে রয়েছেন বলে জানান ওসি। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, যৌথ অভিযান, পুলিশের নিয়মিত অভিযান সবই চলছে। পুলিশের পক্ষ থেকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতি নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ছিনতাই, রাহাজানি সহ্য করা হবে না। যারা অপরাধী তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
এদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, শুধু পুলিশ সক্রিয় হলে হবে না। অন্যান্য বাহিনীকেও এগিয়ে আসতে হবে। তবেই অপরাধীরা পিছু হটবে। তিনি বলেন- যেহেতু সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার আছে সে কারণে সেনাবাহিনীকেও ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে।