ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
মার্চের প্রথম সপ্তাহে ছিলেন হাসপাতালে। সে সময় থেকেই সিলেটের জন্য তার মন উচাটন করছিল। ছোট ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনসহ স্বজনদের কাছে সিলেট নিয়ে যাওয়ার বায়না ধরেছিলেন। আর তাইতো হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাওয়ার পর সিলেটে এসেছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রিয় শহরে আসার পর থেকেই হাসিখুশি ছিলেন। তাকে গুণীশ্রেষ্ঠ সম্মাননায় ভুষিত করে সিলেট সিটি করপোরেশন। সুরমার তীর। চাঁদনী ঘাট। আলী আমজদের ঘড়ি। স্টেজে বসা ছিলেন মুহিত, পাশে মেয়র আরিফ
দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য রাখলেন ড. মুহিত। সিলেটকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন। বক্তব্যের শেষ দিকে তিনি সিলেটবাসীর কাছে ক্ষমাও চেয়ে নেন। জানালেন- ‘আমার ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিয়েন।’ এটাই ছিল সিলেটে তার শেষ পাবলিক অনুষ্ঠান। মার্চ থেকে এপ্রিল। সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার প্রায় দেড় মাস। লিভার ক্যান্সারে আক্রান্তের খবর মিললো। পরিবার থেকে জানালো হলো সেই তথ্য। মারা গেলেন ঢাকাতে।
গতকাল সন্ধ্যায় সিলেট এলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তবে; এবার আর জীবিত নয়, লাশ হয়ে ফিরলেন তিনি। শোকাহত সিলেটের মানুষ। মন্ত্রীত্বের সময় রেগে যেতেন। এ রাগে ছিল এক ধরনের শাসন। ভালোবাসার।
সিলেট উন্নয়নের রূপরেখা শুরু করেছিলেন সিলেটবন্ধু বলে পরিচিত সাবেক স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। ওই সময়ের উদ্যোগ নেয়া উন্নয়ন ধারাবাহিকভাবে করে গেছেন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। আর সর্বশেষ সিলেটেরই সন্তান ও সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিতের সময়ে এসে সিলেট উন্নয়নের রূপরেখার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন হয়। কাজিরবাজার ব্রিজ, সিলেট ইন্টরন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়াম, আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্স, সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারসহ মেগা অনেক উন্নয়ন প্রকল্প শুরু করে সমাপ্ত করে গেছেন ড. মুহিত।
সর্বশেষ স্বপ্ন ছিল সিলেটের পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারকে বঙ্গবন্ধু পার্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। নানা দাপ্তরিক ঝামেলায় আটকে আছে মুহিতের শেষ ইচ্ছা। সেটির প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। এ নিয়ে কয়েক দফা ডিও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দেখে যেতে পারলেন না।
প্রশাসনের প্রায় সব শাখায় বিচরণ করেছেন তিনি। সর্বোচ্চ কর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর রাজনীতিতে এসে মন্ত্রী হয়েছেন। প্রভাবের সঙ্গে মন্ত্রিত্ব করেছেন। একটি ইচ্ছা বা স্বপ্ন অপুর্ণই থাকলো মুহিতের। নিজ থেকে মন্ত্রিত্ব, এমপিত্ব ছেড়েছিলেন তিনি। এরপরে রাষ্ট্রপতি হওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। ছোটো পরিসরে এই ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করলেও কখনো বড় পরিসরে তুলে ধরেননি। শেষবার গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে যখন সিলেটে এসেছিলেন তখনো তিনি ওই একটি ইচ্ছে অপূর্ণ থাকার কথা সাংবাদিকদের কাছে জানিয়েছিলেন। তবে- সেটি নিয়ে আপেক্ষ ছিলনা তার।
সিলেটের মানুষের প্রিয় স্বজন ড. আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্র সিলেটে শোকের ছায়া নেমে আসে। রাতে অনেকেই তার হাফিজ কমপ্লেক্সের বাসায় ভিড় করেন। সকাল ১০টা থেকে ফের নেতাকর্মীরা হাফিজ কমপ্লেক্সের বাসায় আসেন। সেখানে জেলা ও মহানগর নেতারা বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রাতে সাবেক এই মন্ত্রীর মরদেহ সিলেটের একটি হিমাগার রাখা হয়েছে। আজ দুপুরে প্রথমে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য লাশ নিয়ে যাওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এরপর বাদ জোহর আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে জানাজার পর লাশ রায়নগর কবরস্থানে সমাহিত করা হবে।
সিলেটের এই সাবেক মন্ত্রীর মৃত্যুতে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক। জীবনের শেষ বয়সে মন্ত্রী না হয়েও তিনি সিলেটের উন্নয়নের খবর রাখতেন। সিলেটের প্রতি তার বিশেষ টান ছিল।
জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন, সাবেক এই মন্ত্রীর মৃত্যুতে সিলেটে ফের রাজনৈতিক শূণ্যতার সৃষ্টি হলো। আমরা অভিভাবকহীন হলাম।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, ভাসা সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত আমাদের অভিভাবক ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত সঙ্গী ও উন্নয়নের সারথী ছিলেন। তার মৃত্যুতে শুধু সিলেটে নয়, জাতীয়ভাবেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলাম।
সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহিউদ্দিন আহমদ সেলিম জানিয়েছেন, সিলেটের ক্রীড়াঙ্গনে একশ’ বছরে যে উন্নয়ন হয়নি, মুহিতের আমলে তার চেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে। সিলেটে তিনি দুটি স্টেডিয়াম নির্মাণ করে গেছেন। তার মৃত্যুতে সিলেটের ক্রীড়া পরিবার শোকাহত বলেও জানান তিনি।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও আওয়ামী লীগ নেতা রজত কান্তি গুপ্ত জানিয়েছেন, তিনি স্বচ্ছ চিন্তার মানুষ ছিলেন বলেই আমরা দেশসেরা একটি শহীদ মিনার পেয়েছি। নাটকের মহড়া স্থানসহ সাংস্কৃতিক নানা বিষয়ে সিলেটে তার অবদান অপরিসীম।
কামরানপুত্র ডা. আরমান আহমদ শিপলু জানিয়েছেন, সাবেক মন্ত্রী মুহিত ও সাবেক মেয়র কামরান দু’জন সিলেটকে আলোকিত করতে একসঙ্গে কাজ করেছেন। এক বছর আগেই মারা গেলেন কামরান। আর আজ মুহিত। আমরা ধীরে ধীরে অভিভাবকহীন হয়ে গেছি বলে মন্তব্য করেন তিনি।