সুতীব্র জীবনদৃষ্টি, অপূর্ব রোমান্টিকতা আর যুগ চেতনায় ফররুখ কাব্যভাষা বর্ণাঢ্য ফোয়ারার মতো পাঠক হৃদয়কে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় করে বিমুগ্ধ। বাংলার কাব্যগগনে দীপ্তিমান সূর্যকে মাথায় নিয়ে জন্মেছিলেন কবি ফররুখ আহমদ। আধুনিক বাংলা কবিতার তিনি একটি স্বতন্দ্র ধারার যুগ প্রবর্তক কবি।
রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ নিজেই যেন সাত সাগরের মাঝি। তাঁর মতো মহত্তম কবি সমসাময়িক কালে ছিলেন সারা পৃথিবীতে বিরল। সমস্ত বাঙালী জাতির জীবনে যেটা দারুন গৌরবের। অহংকারের।
ফররুখ প্রতিভার উজ্জ্বল কিরণচ্ছটায় চল্লিশোত্তর বাংলার কাব্যগগন উদ্ভাস্তিত হয়ে ওঠে। বিস্ময়কর কাব্যপ্রতিভা ফররুখ আহমদ বাংলা সাহিত্যে এক বিশিষ্টি স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর বজ্র নির্ঘোষ আহবান আমাদের জাতীয় চৈতন্যে নতুন প্রেরণার অগ্নি সঞ্চার করেছিল। জাগরণের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর কবিতা।
মুসলিম জাগরণের আরব্ধ জয়যাত্রাকে ফররুখ আহমদ পূর্ণতা দান করেছিলেন। ঐশী আদর্শের প্রতি ছিলেন তিনি আমৃত্যু দৃঢ় সংকল্প, আপোষহীন, অনঢ়, অটল। তাঁর সত্য ও সুন্দরের স্বত: উতসারিত কাব্যভাষা আত্ম-আত্মার নিনাদে অম্লান দীপ্তিতে ভাস্বর হয়ে অবিসংবাদিত হয়ে থাকবে।
ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝি প্রকাশিত হয় ১৩৫০ (১৯৪৩ ইরেজী) সালের বৈশাখ মাসে মাসিক মোহাম্মদীতে। যে কবিতা বিদ্যুৎ চমকের মতো কবি সাহিত্যিকদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। এক অনুপম রচনা শৈলী। ভাষা, ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষার সাবলীল প্রয়োগ দেখেতো সবাই হতবাক। বিস্ময় বিমূঢ় দৃষ্টিতে এই অনিন্দ্য সুন্দর সৃষ্টির প্রতি কাব্য জগত সহসা সচকিত হয়ে উঠল।
সাত সাগরের মাঝি’র মতো কাব্য সৃষ্টি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এক নতুন স্বাদে নব উদ্দীপনায় সে কবিতা মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিল। নিরস-নির্মোহ অনিরুদ্ধ হৃদয় বিদ্যুতের গতি পেল। কবিতার সুললিত শব্দ বিন্যাস জনপ্রিয়তার স্তর পেল। বিদ্যুৎ চমকের মতো মর্যাদার শিখরে ওঠে এলেন ফররুখ আহমদ।
শুরু হল নায়কের জয়যাত্রা। সকলেই মুগ্ধ নির্বাক বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। এরি মাঝে উনিশটি কবিতা সম্বলিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ প্রকাশিত হলো। জাতীয় জাগরণী এ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা সিন্দাবাদ।
যে কবিতায় ফররুখ ঘোষণা দিলেন-
কেটেছে রঙিন মখমল দিন নতুন সফর আজ
শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক
ভাসে জোরওয়ার মউজের শিরে সফেদ চাঁদির তাজ
পাহাড়-বুলন্দ ঢেউ বয়ে আনে নোনা দরিয়ার ডাক
নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দাবাদ!
ভেঙেফেল আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ
দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাঁধ
ছিড়ে ফেলে আজ আয়েশী মখমল অবসাদ
নতুন পানিতে হাল খুলে দাও হে মাঝি সিন্দাবাদ!
যে কবিতা আত্মবিস্মৃত জাতিকে নব জাগৃতি এনে দিল। ঘুমন্ত জাতি কাব্যমন্ত্রের মোহময় স্পর্শে বাঙময় হয়ে উঠল। যাদুমন্ত্রের মতোই তাঁর বীনায় ঝংকৃত উচ্ছকিত হয়ে উঠল তৌহিদী বিশ্বাস। কবি বললেন-
তোরা চাসণে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া
তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া।
[কিংবা]
আজকে তোমার পাল ওঠাতেই হবে
ছেঁড়াপালে আজ জুড়তেই হবে তালি
ভাঙ্গা মাস্তুল দেখে দিক করতালি
তবুও জাহাজ আজ ওঠাতেই হবে।
হে মাঝি। এবার তুমিও পেয়োনা ভয়
তুমি কুড়াও হেরার পথিক তারকার বিস্ময়
ঝরুক এ ঝড়ে নারঙ্গী পাতা, তবু পাতা অগণন
ভিড় করে-যেথা জাগছে আকাশে হেরার রাজতোরণ।
কবির এই উচ্চকণ্ঠ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে প্রেরণা যোগায়। ফররুখ আহমদ এভাবে সংগ্রামী চেতনায় উজ্জীবিত করেছেন মুক্তিকামী মানুষকে। তার অভিযাত্রা ছিল অনির্বাণ। একটা আদর্শকে রোমান্টিকতার মিশেলে আবেগের স্ফুরণে ফুটিয়ে তোলেছিলেন। নতুন নতুন দিগন্তে বিচিত্র আঙ্গিকে অপূর্ব ব্যঞ্জনায় তাঁর চেতনার বিকিরণ ঘটেছে। তাঁর স্বচ্ছ ও স্পষ্ট কাব্য চেতনা বিশ্বজনীনতার মানদণ্ডে মহৎ ও মৌলিক বলেই প্রমাণিত হয়েছে।
ফররুখ কাব্যে প্রত্যয় যোগ্য ভাষা শৈলীতে রয়েছে স্বত:স্ফুর্ততা। ছন্দের দ্যোতনায় তাঁর প্রাণদ ইচ্ছাটা পরিস্ফুটিত হয়ে মোহমুগ্ধতার সৃষ্টি করে। তাঁর কবিতা স্বচ্ছ ঝর্ণা ধারার মতো, হীরা জহরতের মতো। ফল ফসলের লাবণ্যময় সৌন্দর্য, সবুজের প্রাচুর্যতা, পাখীর কুজন, মরু-সাগর কিংবা আসমান-জমিন তাঁর ক্যানভাসে ধারণ করেছেন অসাধারণ ব্যঞ্জনায়।
কবিতায় ফররুখ আহমদের আরবি ও ফার্সি শব্দ ব্যবহারের দুর্লভ দক্ষতা আর তৎসম ও তদ্ভব শব্দ প্রয়োগে ছিল ঈর্ষণীয় সাফল্য। তাই তাঁর কবিতা পাঠক মনকে নন্দিত ও স্পন্দিত করে তোলে।
ফররুখ সকল হীনমন্যতার স্খলন ঘটিয়ে আপন জাতিসত্তার মহিমা প্রকাশে নিরাপোষ সাহসী কবি। রৌদ্রকরোজ্জল প্রতিভা নিয়ে তিনি দাঁড়িয়েছেন বিপরীত স্রোতে। শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিটি পংক্তি বুলেটের মতো। অব্যর্থ কবির প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ-
রাত পোহার কত দেরী পাঞ্জেরী?
শুধু গাফলতে, শুধু খেয়ালের ভুলে
দরিয়া অথই ভ্রান্তি নিয়াছি তুলে
আমাদের ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি
দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী,
মোদের খেলায় ধূলায় লুটায়ে পড়ি
কেঁদেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাধ শর্বরী। —
পাঞ্জেরী!
জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কতদেরী, কতদেরী।।
জাতীয় চৈতন্যের অপরাজেয় কণ্ঠস্বর ফররুখ আহমদের কবিতায় প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছে সিন্দাবাদ, পাঞ্জেরী, হেরার রাজতোরণ, সাইমুম, ডাহুক, নাবিক প্রভৃতির প্রতীকী আমেজ।
পাঞ্জেরীকে মুসলিম নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে কিংবা হেরার রাজতোরণ কে মহানবীর আদর্শের প্রতীক হিসেবে, মুসলিম মিল্লাতের জাগৃতিকে সিন্দাবাদের সমুদ্র যাত্রার প্রতীকে আশাবাদী চেতনায় কবিতা দেহে দ্রবীভূত করেছেন।
আঁধার রাতের বুক চিড়ে সাধকের সাফল্য ধ্বনিত-অনুরণিত হয়েছে ডাহুকের প্রতীকে। আর তা ভাবের অন্ষুঙ্গ হিসেবে নয় কবিতার অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ হিসেবে প্রোজ্জল হয়ে উঠেছে।
ফররুখ আহমদের কাব্যে আমাদের সংস্কৃতির স্বরূপ স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট মর্যাদায় রূপায়িত হয়েছে। ইসলামি কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের তাৎপর্যপূর্ণ ভাষ্যকার তিনি। বাংলা সাহিত্যে ফররুখ পৃথিকৃত কবি।
লেখক: সময় সম্পাদক, কবি ও কথা সাহিত্যিক।
আরও পড়ুন
কোথাও আগুন লাগলে সতর্কতার জন্য যা করবেন, যা করবেন না
আগুনে পুড়লে মৃত ব্যক্তির মর্যাদা ও আগুন লাগলে যে দোয়া পড়বেন
দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে মাঙ্কিপক্স; প্রয়োজন সতর্কতা
দেহকে সুস্থ রাখবে অ্যালোভেরা
বসন্তের বাতাসে অ্যালার্জির প্রবণতা, একটু গাফিলতি হলেই মারাত্মক বিপদ
রাসূল সা: প্রবর্তিত খাদ্যবিজ্ঞান । ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন
তরমুজের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
যে খাবারে শিশুর উচ্চতা বাড়ে
ইন্ডাস্ট্রির সকলের স্বার্থে কপিরাইটের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিঃ ফাহিম ফয়সাল
অতিরিক্ত আবেগ মনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে
আক্ষেপ প্রকাশ করলেন ‘ছুটির ঘণ্টা’র নির্মাতার মেয়ে বিন্দি
ওজন কমাতে সাহায্য করে যে সকল খাবার