এবারের একুশে বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে লেখক, চিন্তক ও সংগঠক চৌধুরী মুঈন উদ্দিনের আত্মজীবনীমূলক সিরিজের প্রথম পর্ব ‘পৃথিবীর গোলাবের বুকে’। প্রকাশক উল্লেখ করেছেন, লেখক সাবলিল সুখপাঠ্য ভাষায় তুলে ধরেছেন তাঁর শৈশব, রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও নির্বাসনের অভিজ্ঞতা, বিশ শতকের বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে।
ভিডিও লিংক : https://www.facebook.com/manobtvuk/videos/628728332898959
হাজার বছর আগে শিকড়-বিরহের যে সুর উঠেছিল রুমির বাঁশিতে- ‘বায জুইয়াদ রোযগর-এ ওসল-এ খেশ’; কী আশ্চর্য, যেন কদিন আগে সেই একই সুর, একই দহনাভূতি নিয়ে গেয়ে উঠলো রবীন্দ্রনাথের তানপুরা- ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে মন, মন রে আমার!’ বলখ থেকে বাংলা- বোধ করি দুনিয়ার সর্বত্রই ঘরমুখো হৃদয়ের আবেগ এক ভাষাতেই কথা বলে। এই চিরায়ত সত্য পাঠকের চৈতন্যে আরও একবার প্রকটিত করে তুলবে ‘পৃথিবীর গোলাবের বুকে’ চৌধুরী মুঈন উদ্দিনের আত্মজৈবনিক রচনার প্রথম খণ্ড।
প্রায় আট দশকের বর্ণিল-বর্ণাঢ্য জীবন তাঁর। প্রথম খণ্ডের সরস, রোমাঞ্চকর ও সুখপাঠ্য উপস্থাপনায় বিবৃত হয়েছে শৈশবের দুরন্তপনা, বয়ঃসন্ধি ও তারুণ্যের মধুর স্মৃতি, শিক্ষাজীবনের নানা পর্বে ঈর্ষণীয় প্রতিভা ও সাফল্যের গল্প, রাজনীতি-ভাবনা ও জীবনদর্শনের নানামুখী বিবর্তন, পেশাগত জীবনের নাটকীয় দাস্তান, উত্তাল সময়ের সাক্ষী হয়ে মনোজগতে যাপিত টানাপোড়নের ইতিকথা।
আটপৌরে স্মৃতিচারণই শুধু নয়, এ রচনায় দেখা মিলবে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিলোকিত গ্রামবাংলার অপরূপা দৃশ্য। সাতচল্লিশ ও একাত্তরের মধ্যবর্তী ঘটনাবহুল দিনগুলোর সংক্ষিপ্ত অথচ সর্বাঙ্গীন স্কেচ তো বটেই, তৎকালীন পূর্ব বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসকেও দেখার সুযোগ করে দেবে নানা আঙ্গিক থেকে। সরেজমিন অভিজ্ঞতা আর সুদীর্ঘ অধ্যয়ন-গবেষণার সুষম সমাবেশ কখনও বা প্রণোদনা যোগাবে প্রচলিত বয়ানকে ভিন্ন আলোয় দেখার, কখনও প্রশ্নের মুখোমুখি করবে বহুলশ্রুত অনেক গল্প-কেই।
লেখক পরিচিতি : জন্ম ১৯৪৫ সালে। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। ছিলেন তুখোড় ছাত্রনেতাও; অংশ নিয়েছেন সমকালীন সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। কর্মজীবনে ছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রথমসারির দৈনিক পূর্বদেশের স্টাফ রিপোর্টার। সত্তরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় তাঁর কলমের তুলিতে সর্বতোভাবে চিত্রায়িত হয়ে এসেছে দেশবাসীর সামনে।
সাহসী ও সংবেদনশীল সাংবাদিকতা তাঁকে এনে দিয়েছে দেশজোড়া খ্যাতি। উপজাত বস্তু হিসেবে এনেছে পেশাগত ঈর্ষাও। মিথ্যা ও অমূলক অভিযোগ মাথায় নিয়ে ছাড়তে হয়েছে প্রিয় মাতৃভূমি। সম্প্রতি ব্রিটিশ সুপ্রিমকোর্ট প্রকাশিত এক রায়ে সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের অসারতা এবং বাংলাদেশের বিতর্কিত আইসিটি থেকে জারিকৃত মৃত্যুদণ্ডের ভিত্তিহীনতা।
পাঁচ দশকের প্রবাসজীবনও অক্লান্ত কর্মমুখর। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসংখ্য সামাজিক, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান-সংগঠনের গোড়াপত্তন-বিকাশ তাঁর হাত ধরে। অবদান রেখেছেন কূটনৈতিক অঙ্গনেও। অধুনা অবসরজীবনে নিয়মিত লিখছেন একাধিক জার্নালে।
সুপ্রিম কোর্টে ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারির বিরুদ্ধে মানহানি মামলায় ঐতিহাসিক বিজয়
বিশিষ্ট মুসলিম কমিউনিটি নেতা চৌধুরী মুঈন উদ্দিন কর্তৃক ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারির বিরুদ্ধে দায়ের করা মানহানি মামলায় যুগান্তকারী রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
২০২৪ সালের ২০ জুন বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের প্রেসিডেন্ট (প্রধান বিচারপতি) লর্ড রিড আদালতের পক্ষে এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন। সুপ্রিম কোর্টের সর্বসম্মত ও যুগান্তকারী রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ-বাংলাদেশী চৌধুরী মুঈন উদ্দিন।
২০২৩ সালের ১-২ নভেম্বর এই মামলার শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি লর্ড রিড’র নেতৃত্বে গঠিত ব্যাঞ্চে ৫জন লর্ড জাস্টিসের মধ্যে আরো ছিলেন লর্ড সেইল্স, লর্ড হ্যামলেন্ড, লর্ড বারোজ ও লন্ড রিচার্ডস। ২০১৯ সালে মানহানি মামলার শীর্ষ ল’ফার্ম কার্টার-রাকের মাধ্যমে চৌধুরী মুঈন উদ্দিন হোম অফিসের বিরুদ্ধে এই মামলা করেন। তার আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন সিনিয়র সলিসিটর অ্যাডাম টিউডর এবং কাউন্সেল জ্যাকব ডিন ও লিলি ওয়াকার-পার।
মামলার বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়, ২০১৯ সালে কমিশন ফর কাউন্টারিং এক্সট্রিমিজমের ‘চ্যালেঞ্জিং হেইটফুল এক্সট্রিমিজম’বিষয়ক ব্রিটিশ হোম অফিসের রিপোর্টে চৌধুরী মুঈন উদ্দিনকে এক্সটিমিজমের সাথে জড়িত বলে অভিযুক্ত করা হয়। এতে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আইসিটি মামলার রায়কে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এই রিপোর্টের জন্য চৌধুরী মুঈন উদ্দিন ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারির বিরুদ্ধে মানহানি মামলায় উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কোন রকম মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে তিনি জড়িত নন। বরং বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে উল্লেখ করা হয়, চৌধুরী মুঈন উদ্দিন ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলায় জন্মগ্রহণ করেন, যেটি তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭৩ সাল থেকে চৌধুরী মুঈন উদ্দিন যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন এবং ১৯৮৪ সাল থেকে একজন ব্রিটিশ নাগরিক। এই সময়ে তিনি ব্রিটেনে বেশ কয়েকটি সামাজিক ও দাতব্য সংস্থায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
নাগরিক সমাজে উল্লেখযোগ্য অনেক ভূমিকার মধ্যে তিনি কাউন্সিল অব মস্ক ইউকে এন্ড আয়ারের সেক্রেটারি জেনারেল এবং ব্রিটিশ মিনিস্ট্রি অব হেলথের ‘মুসলিম স্পিরিচুয়াল কেয়ার প্রভিশন ইন দ্য এনএইচএস’ প্রকল্পের ডাইরেক্টর ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থা মুসলিম এইডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি মুসলিম, খৃষ্টান, ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ-সহ ৯টা ধর্মের সমস্বয়ে গঠিত মাল্টি ফেইথ গ্রুপের নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রায়ে পরিষ্কার ভাবে বলা হয়, চৌধুরী মুঈন উদ্দিন আইসিটি মামলার সময় পর্যন্ত দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে বিলেতে মুক্তভাবে চলাফেরা করেছেন। তার ঠিকানা বাংলাদেশ সরকারের জানা ছিল। এক্ষেত্রে আইসিটি মামলায় তাঁকে পলাতক বা আত্মগোপনে থাকার কথাটা সঠিক নয়।
রায়ে আরো উল্লেখ করা হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪০ বছরেরও বেশি সময় পরে ২০১৩ সালে চৌধুরী মুঈন উদ্দিনের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের একটি আদালত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ (আইসিটি) দ্বারা ১৯৭১ সালের যুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আইসিটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে অপরাধ প্রমাণের পরিবর্তে ঘটনার সময়ে যারা শিশু ছিল এমন সাক্ষী, শোনা কথা ও সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করে রায় প্রদান দেয়। ফলে সর্বজনীনভাবে জাতিসংঘ, ইইউ-সহ মানবাধিকার সংস্থা ও আইনী প্রতিষ্ঠান আইসিটিকে ন্যায় বিচারের মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হবার জন্য নিন্দা জানায়।
রায়ে বলা হয়, প্রশ্নবিদ্ধ আইনী প্রক্রিয়ার কারণে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে চৌধুরী মুঈন উদ্দিনের বিরুদ্ধে জারি করা একটি রেড নোটিশ প্রত্যাহার করেছে ইন্টারপোল।
হোম সেক্রেটারি চৌধুরী মুঈন উদ্দিনের দাবিকে খারিজ করে দেয়ার জন্য আদালতে আবেদন করে বলেছিলেন, এটি প্রক্রিয়ার অপব্যবহার মাত্র। দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছিল যে চৌধুরী মুঈন উদ্দিনের মানহানির দাবিটি ব্রিটিশ হাইকোর্টে গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া বাংলাদেশে একজন দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী হিসেবে রায়ের কারণে তাঁর খ্যাতি ইতিমধ্যেই আর নেই।
কিন্তু হোম অফিসের এই দাবি আদালত গ্রহন করেননি। বরং উল্লেখ করেন যে. আইসিটির রায়ের পরেও তিনি ব্রিটেনের বর্তমান রাজা তৎকালীন প্রিন্স চাল্সের সাথে কয়েকবার সাক্ষাৎ করেছেন। তৎকালীন রাণীর গার্ডেন পাটি ও বাকিংহাম প্রাসাদে আমন্ত্রিত হয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্ট হোম সেক্রেটারির দাখিল করা বক্তব্য দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্রধান বিচারপতি লর্ড রিড পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন, ‘যে কোন ব্যক্তির জন্য আদালতে প্রবেশের মৌলিক অধিকার তাদের নাগরিক অধিকার হিসেবে নির্ধারিত। সে অধিকার স্বীকৃত হয়েছে বহু শতাব্দী ধরে সাধারণ আইন এবং ম্যাগনা কার্টা থেকে। যা মানবাধিকার আইন ১৯৯৮ পর্যন্ত সংবিধি দ্বারা সুরক্ষিত।
(দেশ-বিদেশে বহুল আলোচিত চৌধুরী মুঈন উদ্দিনের সাথে কবি ও কথাসাহিত্যিক, দৈনিক সময় ও মানব টিভি সম্পাদক সাঈদ চৌধুরীর আলাপচারিতা। পর্ব-১)