সাঈদ চৌধুরী
লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে তৃতীয় বারের মতো নির্বাহী মেয়র নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাজনীতিক লুতফুর রহমান। ৪০ হাজার ৮০৪ ভোট (৫৪.৯%) পেয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার দলীয় জন বিগ্সকে হারিয়ে তিনি বিজয় নিশ্চিত করেছেন। দুই বারের মেয়র জন বিগ্স পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৪৮৭ ভোট (৪৫.১%)।
৫ মে বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত জনগন শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট প্রদান করেন। শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় ফলাফল ঘোষনা করা হয়। নির্বাচনে প্রথম প্রিফারেন্সে লুতফুর রহমান ৩৯ হাজার ৫৩৩ ভোট (৪৭.০%) আর জন বিগ্স ২৭ হাজার ৮৯৪ ভোট (৩৩.২%) লাভ করেন। ১১ হাজার ৬৩৯ ভোটে লুতফুর রহমান এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু বৃটেনের নিয়মানুযায়ী একক ভাবে ৫১% ভোট না পেলে দ্বিতীয় প্রিফারেন্সের ভোট গণনা করতে হয়।
দ্বিতীয় পছন্দে লুতফুর রহমান পেয়েছেন ১ হাজার ২৭১ ভোট আর জন বিগ্স ৫ হাজার ৫৯৩ ভোট। এতে লুতফুর রহমানের মোট প্রাপ্ত ভোট দাড়িয়েছে ৪০ হাজার ৮০৪ এবং জন বিগ্স পেয়েছেন মোট ৩৩ হাজার ৪৮৭ ভোট। অর্থ্যাৎ লুতফুর রহমান নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ৭ হাজার ৩১৭ ভোট বেশী পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচনে ৬ হাজার ৪৩০ ভোট পেয়ে লিবডেমের রাবিনা খান তৃতীয় এবং ৪ হাজার ২৬৯ ভোট পেয়ে কনজারভেটিব পার্টির এলিয়ট উইভার চতুর্থ হয়েছেন।
অনেক অপেক্ষা ও উ্রকন্ঠার প্রহর কাটিয়ে বহু হিসেব নিকেশের পর আসে বিজয়ের ঘোষনা। আনন্দে মেতে ওঠেন উপস্থিত লুতফুর সমর্থক অসংখ্য মানুষ। জনতার মেয়র খ্যাত লুতফুর রহমান পুনঃনির্বাচিত হওয়ায় উল্লসিত জনতা আল্লাহু আকবর বলে শ্লোগান দিয়ে মহান স্রষ্টার শুকরিয়া আদায় করেন। তারা মেয়রকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের গর্ব হিসেবে আখ্যায়িত করে তার সাফল্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করেন।
শত অপপ্রচার ও প্রপাগান্ডার পরও জনগন তাদের হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসে তাদের মূল্যবান ভোট দিয়েছেন। তবে যারা তাকে ভোট দেননি তাদেরও সেবা করতে চান তিনি। এ জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন নব নির্বাচিত মেয়র। জনতার কাতারে এসে লুতফুর রহমান বলেন, কাউন্সিলের জনগণ আমার প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখেছেন। তাদের কাছে আমার দায়বদ্ধতা আরও বেড়ে গেল। সবাকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করারও অঙ্গীকার করেন তিনি।
৫ মে যুক্তরাজ্যের সর্বত্র স্থানীয় নির্বাচন হলেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলাদেশী অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নির্বাচন। ২০১৫ সালে বিশেষ ইলেক্ট্রোরাল কোর্টের রায়ে লুতফুর রহমান পদচ্যুত হন। তখনও তিনি নির্বাহী মেয়র ছিলেন। এটাকে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করে নিজের সততার প্রমান ও স্থানীয় জনগনের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস তিনি অব্যাহত রাখেন। তবে আইনের বাধ্যবাধকতায় ৫ বছর কোন নির্বাচনে অংশ গ্রহন করতে পারেননি। ২০২১ সালে মেয়রাল রেফারেন্ডামে লেবার, কনজারভেটিব এবং লিবডেম সহ সকল দলের বিপরীতে লুতফর রহমান নির্বাহী মেয়র নির্বাচনের পক্ষে বিজয়ী হন। এরপর তিনি এবারের মেয়র নির্বাচনে নিজের প্রার্থীতা ঘোষনা করেন।
মূলত টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে ২০১০ সালের ২১ অক্টোবরের নির্বাচনে লুতফুর রহমানের বিজয়ের মধ্যদিয়ে বৃটিশ বাংলাদেশিরা বৃটেনে এক অনন্য ইতিহাস রচনা করেন। ১ম বাংলাদেশি নির্বাচিত নির্বাহী মেয়র হিসেবে ইতিহাসের খাতায় নাম লেখান লুতফুর রহমান। বৃটেনে ১৩ জন নির্বাচিত মেয়রের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র অশ্বেতাঙ্গ এবং প্রথম মুসলিম ও প্রথম বাংলাদেশি মেয়র। অন্য সকলেই শ্বেতাঙ্গ। তখন তার দায়িত্বে ছিল ১.২ বিলিয়ন পাউন্ড বাজেট ও ১১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। তখন বৃটেনের শীর্ষ পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফে সেরা ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন মেয়র লুতফুর রহমান। টানা ৩য় বারের মতো তিনি এই তালিকায় স্থান পেয়েছেন। আগের বারের চেয়ে পরের বার তিনি ১৫ ধাপ এগিয়ে ৫৩ নাম্বারে স্থান করে নেন। টপ হান্ড্রেডস মোস্ট ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ব্যক্তিদের মধ্যে লুতফুর রহমান ২০১১ সালে ৭৮তম স্থান লাভ করেন। ২০১২ সালে তিনি ১০জনকে টপকে যান। এভাবে দু বছরে ২৫ জনকে ছাড়িয়ে ৭৮ থেকে ৫৩তে স্থান করে নেন। তবে এই ধরণের প্রভাব ও সাফল্য দেখে একটি মহল ঈর্ষান্বিত হয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে।
ব্রিটেনে কোয়ালিশন সরকার যখন ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করেছে তখন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে প্রাইমারী স্কুলের রিসেপশন ও ইয়ার ওয়ান এর শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি স্কুল মিল চালু করেন নির্বাহী মেয়র লুতফুর রহমান। এ বাবত বরাদ্দ করেন প্রায় পৌনে ৩ মিলিয়ন পাউন্ড । তার এই সাহসী ও সৃজনশীল উদ্যোগের প্রশংসা করে বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকা নিবন্ধ প্রকাশ করে। বিবিসির সানডে পলিটিক্স অনুষ্ঠানসহ মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় তার কার্যক্রমের প্রশংসা করা হয়েছে। লুতফুর রহমান ফ্রি স্কুল মিল চালুর অল্প দিনের মাথায় পুরো ব্রিটেনে এই ফ্রি স্কুল মিল চালুর ঘোষণা দেন তৎকালীন ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার নিক ক্লেগ।
নির্বাহী মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে লুতফুর রহমান ২০০৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে দু টার্ম কাউন্সিল লিডার ছিলেন। পেশাগত জীবনে তিনি ফ্যামিলি এন্ড চাইলড প্রটেকশন ল স্পেশালিষ্ট ও সিনিয়র সলিসিটর।মেয়র লুতফুর রহমানের তৃতীয় বারের বিজয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন টাওয়ার হ্যামলেটস সহ গ্রেট বৃটেন এমনকি ইউরোপে বসবাসরত বিভিন্ন শ্রেনী পেশার বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছেন, লুতফুর রহমান বিগত সময়ে টাওয়ার হ্যামলেটসে অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেছেন। এই বিজয় তারই প্রতিদান। বৃটেন সরকার যখন সারাদেশে স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি স্কুল মিল বন্ধ করে দেয় তখন লুতফুর রহমান তা অব্যাহত রেখেছেন। এমনিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট, বৃদ্ধদের জন্য ফ্রি হোম কেয়ার সুবিধা, পুরো বৃটেনে সর্বোচ্চ সংখ্যক সোস্যাল হাউজ নির্মানসহ নানা উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডই তাকে এই সম্মান দিয়েছে বলে তারা মতামত ব্যক্ত করেন।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে লন্ডন বারা অব টাওয়ার হ্যামলেটসে সরাসরি ভোটে মেয়র নির্বাচনের প্রথা গণভোটের মাধ্যামে চালু হয়। ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য লুতফুর রহমান লেবার পার্টির কাউন্সিলর হিসেবে মনোনয়ন চান। প্রথম দিকে সব কিছু ঠিক থাকলেও পরে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। কমিউনিটির স্বার্থের ব্যাপারে তার স্পষ্ট ও সাহসী অবস্থানের কারনেই বাদ পড়েন তিনি।
এরপর জনতার সমর্থনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। বাঙালি অধ্যুষিত এ বারার উন্নয়নে তিনি ব্যাপক কাজ করেন, যা দেশে-বিদেশে বেশ প্রশংসিত হয়। দ্বিতীয় বার নির্বাচনের আগে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের (বিবিসি) একটি বিতর্কিত অনুষ্ঠান টাওয়ার হ্যামলেটসের বাসিন্দাদের দারুণভাবে হতাশ করে। বিবিসির বিখ্যাত প্যানারমা অনুষ্ঠানে মেয়র লুতফুর রহমানকে বলা হয়, তিনি বাঙালিদের বিভিন্ন সংগঠন ও মসজিদে বারার তহবিল থেকে অনৈতিকভাবে বেশি অর্থ প্রদান করেছেন। নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে এই প্রচারণায় তার ইমেজ সংকট দেখা দেয়। শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তার এক সময়ের রাজনৈতিক দল লেবার পার্টির প্রার্থিরা বিবিসির এই অনুষ্ঠানের সূত্র ধরে তাকে কোণঠাসা করতে চান। বিষয়টি নিয়ে পুলিশি তদন্তও চলে। অবশ্য পুলিশি তদন্তে তার বিরুদ্ধে কিছু না পাওয়ায় এটি ষঢ়যন্ত্রকারিদের জন্য ছিল হিতে বিপরীত।
দৃঢ়চেতা ও সাহসী ব্যক্তিত্ব লুতফুর রহমান ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক রেসিজমের বিরুদ্ধে ঐক্য ও ভালবাসার মন্ত্রে উজ্জিবিত হয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন তার নতুন দল আসপায়ার, ক্যাম্পেইন টিম ও সমর্থকদের। ফলে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে তার বিজয়ের মাধ্যমে জনতার বিজয় নিশ্চিত হয়েছে। অবশ্য লুতফুর বিরোধী প্রচারনায় কতিপয় বাঙালির তৎপরতাও কম ছিলনা। কাউন্সিলার পদে জনতার রায়ে এরা অনেকেই ধরা খাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ইংল্যান্ডের যে কোনও কাউন্সিলের তুলনায় বেশি সংখ্যক সোস্যাল হাউজ নির্মাণের পুরস্কার হিসেবে সরকারের তরফ থেকে সর্বোচ্চ হাউজিং বোনাস পেয়েছে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল। মেয়র লুতফুর রহমানের নেতৃত্বে টানা দুবছর সর্বোচ্চ সংখ্যক সোস্যাল হাউজ নির্মাণের কারণে সরকারের বিশেষ স্কিম থেকে সাড়ে ১৯ মিলিয়ন পাউন্ড অতিরিক্ত বরাদ্দ পেয়েছে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য এ অর্থ বরাদ্দ দেয় সরকার। এর আগের মেয়াদেও প্রায় ১৬ মিলিয়ন পাউন্ড বোনাস পেয়েছিল টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল। ফলে ২০১১ সালের পর থেকে টাওয়ার হ্যামলেটসের মোট বোনাস বরাদ্দ দাঁড়াবে ৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের কাছাকাছি।
হাউজিং বিষয়ক ইন্ডাস্ট্রি ম্যাগাজিন ইনসাইড হাউজিং সহ বৃটেনের মেইনস্ট্রিম সংবাদ মাধ্যমে টাওয়ার হ্যামলেটসের এ সফলতার খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন কাউন্সিল এলাকায় নতুন বাড়ি নির্মাণকে উৎসাহিত করতে ২০১১ সালে সরকার নতুন এ স্কিম চালু করে। লীগ টেবিলে বোনাস পাওয়ার দৌড়ে প্রথম স্থানে ছিল টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল। এর আগের মেয়াদেও টাওয়ার হ্যামলেটস প্রথম স্থান দখল করেছিল। এক্ষেত্রে মেয়র লুতফুর রহমান বলেন, হাউজিং আমার অন্যতম অগ্রাধিকার ভিত্তিক খাত। গত টার্মে ইংল্যান্ডে আমরাই সর্বোচ্চ সংখ্যক এফর্ডেবল সোস্যাল হাউজ নির্মাণ করেছি। সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া সর্বশেষ এ স্বীকৃতি তারই সাক্ষ্য বহন করে।
পারিবারিক জীবনে বিবাহিত লুতফুর রহমান দু সন্তানের জনক। ১৯৫৭ সাল থেকে তার পিতা বৃটেনে বসবাস করছেন। তিনি চার বছর বয়সে বৃটেনে আসেন সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার সিকন্দরপুর গ্রাম থেকে। সিলেট তথা বাংলাদেশের এই কৃতিমান রাজনীতিকের প্রতি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে অফুরান শুভেচ্ছা।