রেডিও সিলনের সঙ্গে বেড়ে ওঠা । আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে রেডিও’র সম্পর্ক সামান্য। কিন্তু আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল রেডিও’র। বিশেষ করে ‘রেডিও সিলন’ এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক এতটাই নিবিড় ছিল যে বহু দশক পরও আমার মনোজগত জুড়ে আছে ‘রেডিও সিলন’। ‘বিনাকা গীতমালা,’ বোম্বের চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাটের দশক, এমনকি সত্তর দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত নির্মিত ছায়াছবির গান, সঙ্গীত শিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পচিালকদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি এবং আপন অনুভব করেছি শিল্পী কেএল সাইগল, শামশাদ বেগম, মুকেশ, গীতা দত্ত, লতামঙ্গেশকর; গীতিকার শাকিল বদাউনি, সাহির লুধিয়ানভি, মাজরুহ সুলতানপুরি, শৈলেন্দ্র, রাজিন্দর জয়কিশন, হাসরত জয়পুরী, আনন্দ বকশি; সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক নওশাদ আলী, লক্ষ্মীকান্ত-পিয়ারেলাল, শচীন দেব বর্মন, কল্যাণজি-আনন্দজি, ওপি নাইয়ার, মদনমোহন এর মত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। ‘রেডিও সিলন’ না থাকলে হয়তো হিন্দি-উর্দু কবিতা ও সঙ্গীত জগতের সঙ্গে এতটা ঘনিষ্ট হওয়া সম্ভব হতো না। ‘সিলন’ নামে যে একটি দেশ ছিল সেই নামটিও এখন অনেকের অপরিচিত হয়ে গেছে। আজকের ‘শ্রীলঙ্কা’কে আমরা জানতাম ‘সিলন’ বা সিংহল হিসেবে। ১৯৭২ সালে ‘সিলন’ এর নাম হয়েছে ‘শ্রীলঙ্কা’।

বোম্বের ছায়াছবির জনপ্রিয় গানের গীতিকারদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বার বার ‘রেডিও সিলন’ প্রসঙ্গ এসেছে এবং অনেক পাঠক ‘রেডিও সিলন’ সম্পর্কে জানার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। ‘রেডিও সিলন’ এশিয়ার প্রথম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম রেডিও স্টেশন। ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে আটক একটি জার্মান সাবমেরিনের রেডিও সরঞ্জাম ব্যবহার করে ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ ভারতের টেলিগ্রাফ ডিপার্টমেন্ট পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছিল ‘কলম্বো রেডিও’। এর উদ্যোক্তা ছিলেন ওই সময়ে সিলনে নিয়োজিত টেলিগ্রাফ ডিপার্টমেন্টের চিফ ইঞ্জিনিয়ার এডওয়ার্ড পারপার। এটির নামকরণ করে এর দুই বছর পর ১৯২৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে মিডিয়ামওয়েভ রেডিও হিসেবে চালু করা হয়। উদ্বোধন করেন সিলনের ব্রিটিশ গভর্নর স্যার হাফ ক্লিফোর্ড। রেডিও সিলনকে আমরা ‘সিলন রেডিও’ বলতেই অভ্যস্ত ছিলাম। উল্লেখ্য বিবিসি খ্যাত ব্রিটিশ ব্রডকাষ্টিং কর্পোরেশন চালু হয়েছিল ১৯২২ সালে। ‘রেডিও সিলন’ থেকে সিংহলী, তামিল ও ইংরেজি ভাষায় প্রোগ্রাম প্রচার করা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র বাহিনী ‘সাউথ ইস্ট এশিয়া কমাণ্ড’ রেডিও সিলনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। যুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালে রেডিও স্টেশনটি সিলন সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং এর নাম হয় ‘রেডিও সিলন’। ‘রেডিও সিলন’ ১৯৬৬ সালে ‘সিলন ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন হিসেবে রাষ্ট্রীয় সংস্থায় পরিণত হয় এবং ১৯৭২ সালে সিলনের আনুষ্ঠানিক নাম ‘রিপাবলিক অফ শ্রীলঙ্কা’ হওয়ার পর সিলন রেডিও’র নতুন নামকরণ করা হয় ‘শ্রীলঙ্কা ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন’।

‘রেডিও সিলন’ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে পঞ্চাশের দশকের সূচনায় হিন্দি সার্ভিস যোগ করার পর। ভারতের বড় বড় কোম্পানিগুলোর পন্যের বিজ্ঞাপন আকৃষ্ট করে ‘রেডিও সিলন’, যা ভারতের রেডিও স্টেশগুলোর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ‘রেডিও সিলন’ ভারতে তিনটি রেডিও এডভার্টাইজিং সার্ভিসকে নিয়োগ করেছিল ভারতীয় পন্যের বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজে। হিন্দি সার্ভিসকে জনপ্রিয় করার জন্য সিলন রেডিও ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঘোষকদের নিয়োগ করে, যারা এই রেডিওকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাদের মধ্যে ছিলেন হাসান রিজভি, বিমলা ও কামিনী, বিজয় কিশোর দুবে, হামিদ সায়ানি ও আমিন সায়ানি, মনোহর মহাজন, সুনীল দত্ত (পরবর্তীতে বলিউডের জনপ্রিয় নায়ক) প্রমুখ। ‘বিনাকা গীতমালা’, চিত্রতারকাদের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক সুনীল দত্তের ‘লাক্স কি সিতারে’ ও ‘লিপটন কি সিতারে’র মত প্রোগ্রাম ‘রেডিও সিলন’ এর জনপ্রিয়তাকে ভারতীয় উপমহাদেশে ভিন্ন মাত্রা দেয়।ভারতে ১৯২৭ সালের জুলাই মাসে বোম্বেতে এবং আগস্ট মাসে কলকাতা বেসরকারি উদ্যোগে রেডিও স্টেশন চালু করা হয় এবং ১৯৩০ সালে সরকার দুটি রেডিও স্টেশনকে অধিগ্রহণ করার পর ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস গঠন করে এবং ১৯৩২ সালে বিবিসি’র প্রোগ্রাম প্রচারের মাধ্যমে ভারতীয় রেডিও’র আয় বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। ওই সময় ভারতে লাইসেন্স করা রেডিওর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩,০০০টি। ১৩৩৮ সালে কলকাতায় রেডিওর শর্টওয়েভ ট্রান্সমিশনের উদ্বোধন উপলক্ষে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “ধরার আঙিনা হতে ওই শোনো/উঠিল আকাশবাণী/অমরলোকের মহিমা দিল যে মর্তলোকেরে আনি/সরস্বতীর আসন পাতিল নীল গগনের মাঝে/আলোকবীণার সভামণ্ডলে মানুষের বীণা বাজে/সুরের প্রবাহ ধায় সুরলোকে, দূরকে সে নেয় জিনি/কবিকল্পনা বহিয়া চলিল অলখ সৌদামিনী/ভাষারথ ধায় পূবে পশ্চিমে সূর্যরথের সাথে -/উধাও হইল মানবচিত্ত স্বর্গের সীমানাতে।” ১৯৪১ সালের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে আরও কিছুসংখ্যক রেডিও স্টেশন চালু হয় এবং ১৯৪৭ সালের মধ্যে লাইসেন্সকৃত রেডিও সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৫ হাজারে এবং একই বছরে ঢাকা, লাহোর ও পেশোয়ারসহ নয়টি নতুন রেডিও স্টেশন চালু করা হয়।

জওহরলাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় ১৯৫২ সালে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত প্রেমিক ড. বি,ভি কেসকার ‘আকাশবাণী;তে হিন্দি মুভির গান প্রচার বন্ধ করেন গানগুলো ‘যৌন সুড়সুড়িমূলক ও অশ্লীল’ বলে এবং গানের জন্য রেডিও’র সময়ের মাত্র ১০ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। ছায়াছবির নির্বাচিত কোনো গান প্রচারের সময় শুধু শিল্পীর নাম প্রচারের অনুমতি ছিল, ছায়াছবির নাম, গীতিকার ও সুরকারের নাম নয়। ক্ষুব্ধ চলচ্চিত্র প্রযোজকরা ‘আকাশবাণী’ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। আকাশবাণী থেকে ছায়াছবির গান উধাও হয়ে যায় এবং এ সুযোগ লুফে নেয় ‘রেডিও সিলন’। পার্লামেন্টে তথ্য মন্ত্র কেসকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠে। ১৯৫৪ সালে সরোজিনী নাইডুর ছোটভাই লোকসভার সদস্য হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, যিনি কবি, নাট্যকার ও অভিনেতা ছিলেন, তিনি আকাশবাণীর জনবিচ্ছিন্নতার তীব্র সমালোচনা করে তথ্যমন্ত্রীকে তুলোধূনা করেন যে, শ্রোতারা কী চায় মন্ত্রী তা উপলব্ধি না করেই রেডিওতে জনপ্রিয় গানের প্রচার নিষিদ্ধ করেছেন। বহু সদস্য তাঁর যুক্তির পক্ষে বক্তব্য রাখেন। মন্ত্রীকে তাঁর অবস্থান থেকে পিছু হটতে হয় এবং ১৯৫৭ সালে বিবিধ ভারতীতে ছায়াছবির গানের প্রচার শুরু হলে ‘রেডিও সিলন’ এর ‘বিনাকা গীতমালা’র স্থান দখল করতে শুরু করে। তা সত্ত্বেও পুরোনো গানের প্রোগ্রামসহ অন্যান্য প্রোগ্রাম রেডিও সিলনের জনপ্রিয়তাকে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ধরে রেখেছিল। ‘বিবিধ ভারতী’র জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনেও আমিন সায়ানির ভূমিকা রয়েছে। কারণ তিনি পরবর্তী সময়ে আকাশবাণীতে যোগ দিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদ্মশ্রী’তে ভূষিত হন।

এসময় ‘রেডিও সিলন’ এর ‘বিনাকা গীতমালা’ এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল যে, ভারতীয় পন্যের সিংহভাগ বিজ্ঞাপন চলে যেত সিলন রেডিওতে। অল ইন্ডিয়া রেডিও তীব্র সমালোচনার মধ্যে পড়ে। রেডিও সিলন’ এর সঙ্গে পাল্লা দিতে অল ইন্ডিয়া রেডিও বা ‘আকাশবাণী’ ১৯৫৭ সালে তাদের সঙ্গীতানুষ্ঠান ‘বিবিধ ভারতী’ চালু করে, যার মধ্যে ছায়াছবির বিভিন্ন ধরনের গানের প্রোগ্রাম, সঙ্গীত ও ছায়াছবির জগতের ব্যক্তিত্বদের সাক্ষাৎকার প্রচার করা হতে থাকে। শ্রোতা সংখ্যা বৃদ্ধি অর্থ্যাৎ সিলন রেডিও থেকে উপমহাদেশের শ্রোতাদের মনোযোগ আকাশবাণীর দিকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে শর্টওয়েভে ছাড়াও মিডিয়ামওয়েভে সম্প্রসারিত করা হয়। তা সত্বেও সিলন রেডিওকে হার মানাতে আকাশবাণীকে আরও কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে।

‘রেডিও সিলন’ এর সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রোগ্রাম ছিল ‘বিনাকা গীতমালা’, আধা ঘন্টার এই প্রতিযোগিতামূলক প্রোগ্রামে শ্রোতাদের আমন্ত্রণ জানানো হতো প্রতি সপ্তাহে প্রচারিত সাতটি গানকে ধারাবাহিকভাবে সাজাতে। প্রতিযোগিতায় সফল অংশগ্রহণকারীকে একশ’ রুপি পুরস্কার দেওয়া হতো। এই প্রোগ্রামের উপস্থাপক ছিলেন আমিন সায়ানি। তিনি বলেছেন, বিনাকা গীতমালা’ প্রথম প্রচার করা হয় ১৯৫২ সালের ৩ ডিসেম্বর এবং তিনি প্রথম সপ্তাহের প্রতিযোগিতায় ৯,০০০ শ্রোতার চিঠি পান, এবং এক বছরের মধ্যে প্রতি সপ্তাহে চিঠির সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫ হাজারে। রেডিও’র একটি প্রোগ্রামের সীমিত লোকবল নিয়ে প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়লে আমিন সায়ানি এবং অন্যান্য প্রযোজকরা ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ‘বিনাকা গীতমালা’কে এক ঘন্টার ‘অনুরোধের আসর’ এ রূপান্তরিত করেন, যেখানে শ্রোতাদের অনুরোধ অনুসারে গান প্রচার করা হতো। প্রতি বুধবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ৮টায় ‘রেডিও সিলন’ এ ‘বিনাকা গীতমালা’র শুরুতে ঘোষক আমিন সায়ানির কণ্ঠে “জি হ্যাঁ বেহনো আ্ওর ভাইয়োঁ, ম্যায় আপকা দোস্ত আমিন সাহানি বোল রাহা হুঁ আওর আপ সুন রাহে হ্যায় বিনাকা গীতমালা,” প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের বহু শহরের রাস্তা জনশূন্য হয়ে পড়ত, কারণ শ্রোতারা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করত কোনো গানের অনুরোধকারী হিসেবে তার নাম শোনার জন্য। সায়ানি তাঁর প্রোগ্রাম রেকর্ড করতেন বোম্বেতে এবং টেপ পাঠিয়ে দিতেন কলম্বোতে। গানের প্রোগ্রাম সম্প্রসারিত করার জন্য ‘রেডিও সিলন’ পাকিস্তানি ছায়াছবির গানের আধা ঘন্টার প্রোগ্রামও চালু করে। ”

‘রেডিও সিলন’ এর জনপ্রিয়তার কারণে ১৯৫৭ সালে ভারতের দ্বিতীয় লোকসভা নির্বাচনের সময় ভারতের সংবাদপত্রগুলোতে রিপোর্ট প্রকাশিত হতে থাকে যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতকারী প্রার্থীরা ‘রেডিও সিলন’ এর মাধ্যমে তাদের নির্বাচনী প্রচারণা পরিচালনা করতে পারে। দিল্লিতে নিযুক্ত সিলনের হাইকমিশনার সংবাদপত্রগুলোকে জানান যে, ‘রেডিও সিলন’ নিজ দেশের বা অন্য কোনো দেশের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয় না।’ ‘রেডিও সিলন’ জনপ্রিয় ছিল গান এবং অভিনয় ও সঙ্গীত জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিষয় ভিত্তিক প্রোগ্রামের কারণে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *