রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ : এ যুদ্ধ থামাবার কোন নৈতিক শক্তি কী বৃটেন ও আমেরিকার আছে?

ইউরোপ মতামত
শেয়ার করুন

আকবর হোসেন:

৪৪ মিলিয়ন মানুষের ইস্ট ইউরোপীয়ান গণতান্ত্রিক দেশ ইউক্রেন ঘিরে আছে রাশিয়া। দেশটি দখলে নিতে চায় তারা। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে ইউক্রেনে। পশ্চিমা বিশ্বের হম্বিতম্বিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের নির্দেশে একের পর এক শহরে চলছে নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান। শিশু, নারীসহ হতাহত হন হাজার হাজার মানুষ, ইতোমধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন প্রায় আড়াই মিলিয়ন মানুষ। এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এতো বড় ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে ইউরোপে। এই বিপর্যয়ের মাঝে দলে দলে মানুষ পালাচ্ছে ইউক্রেন থেকে। তাদেরকে আশ্রয় দিতে বৃটেন সহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে চলছে হিসেব নিকেষ। সাধারণ ঘরবাড়ি, বিল্ডিং, এয়ারপোর্ট, মিলিটারী হেড কোয়ার্টার, ট্রেনিং সেন্টার, হাসপাতাল, স্কুল, ব্রীজ, রাস্তাঘাট সবই ধ্বংস করছে রাশিয়া। রাজধানী কিভ, খারকিব, লাভিভ, মারিয়াপুলসহ বিভিন্ন শহর রাশিয়ার ভয়ংকর হামলায় জর্জরিত। রাশিয়া পোল্যান্ড সীমান্তে মিলিটারী বেইজে হামলা চালিয়ে ন্যাটোকে এ যুদ্ধে জড়াতে চাচ্ছে। তাদের হামলার প্রথম একজন আমরিকান সাংবাদিক ব্রেন্ট রেনডি নিহত হলেন।

রাশিয়া এখন চীনের সহযোগিতা চাচ্ছে। ইজরাইলের সহযোগিতা চাওয়া নিয়েও কথা উঠেছে। অন্যদিকে ন্যাটোভূক্ত দেশগুলো আপাততঃ সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চাচ্ছেনা। যদিও ইউক্রেন চাচ্ছে তারা সরাসরি ইউক্রেনকে সহযোগিতা করুক। কিন্তু ইউরোপ ও আমরিকা শুধু সামরিক সহযোগিতা করছে ইউক্রেনকে ও অর্থনৈতিক শাস্তি দিচ্ছে রাশিয়াকে।

প্রশ্ন হচ্ছে এভাবে কতদিন চলবে! এই যুদ্ধ যেদিকে মোড় নিচ্ছে তাতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন অনেকেই। রাশিয়া কোনভাবেই তার পাশের একটি দেশকে ন্যাটোভুক্ত ইউরোপীয়ান দেশ হিসেবে দেখতে চায় না। অপরদিকে এ যুদ্ধ থামাবার কোন নৈতিক শক্তি কী ইউরোপ আমেরিকার আছে? করোনা ভাইরাস মহামারীর রেশ কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি সারা বিশ্বে বিশেষ করে ইউরেোপে কি পরিমাণ ক্ষতি ও ধ্বংস নিয়ে আসবে তা আগামী দিনগুলোই বলে দেবে। তবে এর পরিণতিতে আমরা আরো একটি বিপর্যয়ের দিকে যে ধাবিত হচ্ছি তার আভাস এখনই পাওয়া যাচ্ছে।

আক্রমণ শুরু পূ্র্বে রাশয়ার প্রেসিডেন্ট পুটিনের ভাষণে তিনি আধুনিক ইউক্রেনকে রাশিয়ার জন্য অনবরত হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেন। ইউক্রেন থেকে রাশিয়া নিরাপদ নয়। এটি তাদের উন্নতি ও অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এখন দাবী করছেন ইউক্রেনেরর কাছে নাকি জৈব ও রাসায়নিক মারণাস্ত্র আছে। যেভাবে টনি ব্লেয়ারও ইরাককে হুমকিস্বুরূপ মনে করেছিলেন এবং তাদের কাছেও ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র আছে বলে দাবী করেছিলেন। আর এ উদ্দেশ্যে তিনি তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বুশ দ্যা জুনিয়রের সাথে মিলে অন্যায়ভাবে ইরাক আক্রমণ করেন। সাদ্দাম হোসেনের শাসন থেকে ইরাককে মুক্ত করবেন তাকে সরিয়ে। পুটিনও একইভাবে ইউক্রেনের মানুষকে মুক্ত করতে চান।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলাডিমির জেলনস্কি রাশিয়াকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মানীর নাৎসী বাহিনীর আক্রমণের সাথে তুলনা করেন। তিনি ন্যাটো আমেরিকা সহ বিশ্ববাসীর প্রতি ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানান। রাশিয়ার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ উঠে, তারা মানবাধিকার লংঘন করছে। আলোচনা, যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব, সমঝোতা সবই যেনো বৃথা। বোমা মেরে তিনি কব্জায় আনতে চান ইউক্রেনকে। কিন্তু কে শুনে কার কথা! যারা তাকে নিবৃত্ত থাকবার আহবান জানাচ্ছেন তাদের আচরণের কথা তো বিশ্ববাসী জানে। তারাতো নিজেরাইতো দ্বৈত নীতির অনুসরণ করেন। সুতরাং তাদের কোন নৈতিক মনোবল নেই রাশিয়াকে থামাবার। ইউরোপের বনসিয়ার হারসিগভিনার উপর বর্বর সার্ভ বাহিনীর গণহত্যার কথা কেউ ভেুলে যাননি। দুনিয়াবাসী প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছে। আমেরিকার ভিয়েতনাম আক্রমণ, জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে এটম বোমা ফেলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে দুনিয়াতে বিভীষিকাময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছে, তার কথা কী ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে পারবে?

রাশিয়ার আক্রমণের কারণে বৃটেনসহ ইউরোপীয়ান দেশগুলোর নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বিগ্নতা বেড়েছে। নিজেদের দোরগোড়ায় যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে এ সকল দেশের নাগরিকরা আতংকিত। একে তো দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, গ্যাস ও তেলের দাম সহ সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ, তার উপর এই যুদ্ধও অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলেছে। কারন রাশিয়ার জ্বালানীর উপর নির্ভরশীল অনেক ইউরোপীয় দেশ বিশেষ করে জার্মানী। যুদ্ধের কারণে অত্র অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়েও মানুষের উৎকন্ঠা বেড়েছে। ইউক্রেন থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে পোলান্ডে আশ্রয় নিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আরো বহু লোক আসবে ইউক্রেন থেকে।অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এ যুদ্ধ সহসা থামবেনা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পুটিন সাহেব আবারো তার দেশকে পুর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে যেনো বদ্ধ পরিকর। তাই তিনি কারো কথা শুনেননি। শুনবেন বলেও মনে হয় না। তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন ইউক্রেনের উপর। চেচনিয়া, সিরিয়া তারও অনেক আগে আফগানিস্তানে রাশিয়ানদের আক্রমনের কথা কেউ ভুলে যাননি। ইউক্রেনকে কাবু করতে পারলে পাশ্ববর্তী অন্যান্য দেশের প্রতি নজর যে যাবে তার আশংকাকে ফেলে দেয়া যায় না।

যুদ্ধ কোনভাবেই কল্যাণ আনতে পারেনা। এটা কোন সমাধান নয়। স্বাধীন সার্বভৌম দেশকে আক্রমণ করা, জোর করে কাউকে শাসন করা অথবা ভূমি দখল করে কব্জায় রাখা একেবারেই অন্যায়। জাতিসংঘ সব সময় এ ব্যাপারে সোচ্চার থাকে। এজন্য নিরাপত্তা কাউন্সিলের মিটিং সহ আলাপ আলোচনা প্রচেষ্টা বিবৃতি সবই করা হয় কিন্তু থামে না শুধু যুদ্ধ, অনেক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পর এক সময় অবশ্য থেমে যায়। যেভাবে থেমেছে আফগানিস্তান ও বসনিয়ার যুদ্ধ। এর দায়ভার কারা নেবে? জাতিসংঘ যেনো শুধু একটি নামকাওয়াস্তের সংগঠন! ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, আফগানিস্তান, রোহিঙ্গা, কাশ্মীর, চায়নার উইঘুর ইত্যাদি দেশ বা অঞ্চলসহ দুনিয়ার বহু জায়গায় গণহত্যা ও মানবাধিকার লংঘিত হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু বড় শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থ ছাড়া যেনো কিছুই বুঝেনা। কে না জানে ইরাক আক্রমণ হয়েছিলো তেলের জন্য। আফগানিস্তানেও সম্পদের লোভ ছিলো।

টনি ব্লেয়ার বলেছিলেন, সাদ্দামবিহীন বিশ্ব নাকি হবে অনেক শান্তিময়। আজ সাদ্দাম নেই, কিন্তু সে শান্তি গেলো কোথায়? ইরাক থেকে ৪৫ মিনিটে সাইপ্রাসের বৃটিশ স্থাপনায় নাকি আক্রমণ করা সম্ভব ছিলো। এসব ভূয়া অজুহাত তুলে পার্লামেন্টে তিনি ইরাক আক্রমণের ভোট পাশ করান। এর আগে যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে একে পাকাপোক্ত করতে ইরাকের ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র নিয়ে ‘ডজি‘ ডসিয়ার তৈরি করা হয়। ইরাক সম্পর্কে অনেক কথা অতিরঞ্জিত করা হয়। তৎকালীন বিবিসি সাংবাদিক এন্ড্র গিলিগান ইরাক থেকে ৪৫ মিনিটে আক্রমণের কথা উল্লেখ করেন এবং এর সূত্র হিসেবে বৃটেনের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র বিশেষজ্ঞ ড. কেলির নাম চলে আসে। পরিণতিতে ড. কেলি আত্মহত্যা করেন অথবা তাকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ আছে।

ইরাক যুদ্ধের বিরোধীতা করে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলাপমেন্ট সেক্রেটারী ক্লেয়ার শর্ট ও সাবেক ফরেন সেক্রেটারী ও লেবার লিডার রবিন কুক পদত্যাগ করেন। টনি ব্লেয়ার ইরাক আক্রমণ করবেনই। সারা দুনিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিলো। যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। লন্ডনে ঐতিহাসিক মিলিয়ন মার্চ হলো। লক্ষ লক্ষ মানুষের পদভারে আর গগনবিদারী শ্লোগানে লন্ডনের আকাশ বাতাস প্রকম্পতি হয়েছিলো। সে মিছিলে আমিও স্বপরিবারে যোগ দেবার সুযোগ হয়েছিলো। সেন্টাল লন্ডন পরিণত হয়েছিলো প্রতিবাদী মানুষের জনসমুদ্র। কিন্তু সবকিছুই বিফল হলো। ২০০৩ সালের ১৯ মার্চ ইরাকে বিমান হামলা চালানো হয়। আগুণের লেলিহান শিখা ইরাকের আকাশে। ইরাকে কোন মারণাস্ত্র নেই। এটা বললেন তৎকালীন ইউএন চীফে উইপেন্স ইন্সপেক্টর হ্যান্স ব্লিক্স। এ যুদ্ধ বেআইনী। ইতোমধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারালেন। একটি দেশকে বিরান করে দেয়া হলো। টনি ব্লেয়ার বলেছিলেন, তার ইরাক যুদ্ধের পলিসিকে নাকি ইতিহাস বিচার করবে। হ্যাঁ ইতিহাস তাকে যুদ্ধবাজ হিসেবেই জর্জ ডব্লিউ বুশের সাথে বিচার করবে।

আমরা চাই অবিলম্বে ইউক্রেনে গণহত্যা বন্ধ হোক। আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। যুদ্ধে ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ নেই। আমেরিকা ইরাক ও আফগানিস্তানে অনেক হারিয়েছে। আফগানিস্তান থেকে হাত গুটিয়ে চলে এসেছে। তারা নিজেরা অন্যায় করে গায়ের জোরে। তাই তাদের পক্ষে অন্যের অন্যায় প্রতিরোধ করা কিভাবে সম্ভব? রাশিয়া যেটা করছে সেটা অন্যায়, দুনিয়াবাসী সেটাই বলছে। কিন্তু যারা এখন অর্থনৈতিক অবরোধ করে রাশিয়াকে শিক্ষা দিতে চান তারা কী মনে করেন এভাবেই রাশিয়া পিছু হটবে? তার হাতে আছে রাসায়নিক মারণাস্ত্র। তার হাতে আছে জ্বালানী যা‘ ইউরোপের দেশগুলোর জন্য খুবই জরুরী প্রয়োজন। পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে।

সুতরাং সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে, নিজের সাথেও অন্যায় করা হবে। তাতে নিজেরাও অন্যায়ের শিকার হবেন। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। এ শিক্ষা যারা যতো দেরিতে নেবেন তারাই ততো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

লন্ডন, ১৩ মার্চ ২০২২
akbargermany92@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *