ডা: কর্নেল ইলাহি বখশের বিবরণী অনুবাদ: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
“আমরা বিকেল ৪টা ১৫মিনিটে আমরা মৌরিপুর অ্যারোড্রোমে অবতরণ করলাম। বিমান থেকে বের হয়ে আমি গভর্নর জেনারেলের মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জিওফ্রে নোলসকে (Colonel Geofrey Knowles) একটি অ্যাম্বুলেন্সের পাশে দাঁড়ানো দেখলাম। সময় নষ্ট না করে কায়দে আজমকে বিমান থেকে নামিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তুললাম। মিলিটারি সেক্রেটারি, ডা: মিস্ত্রি এবং আমি গভর্নর জেনারেলের ক্যাডিলাক গাড়িতে অ্যাম্বুলেন্সকে অনুসরণ করছিলাম। অ্যারোড্রোম থেকে ধীর গতিতে ৯ থেকে ১০ মাইল দূরে অবস্থিত করাচি নগরীতে গভর্নর জেনারেল হাউজের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম।
“আমরা বড় জোর চার মাইল পথ অতিক্রম করেছি, অ্যাম্বুলেন্স থেমে গেল। গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম ইঞ্জিনের সমস্যার কারণে অ্যাম্বুলেন্স বিকল হয়ে পড়েছে। ড্রাইভার বিশ মিনিট চেষ্টা করলেও অ্যাম্বুলেন্স স্টার্ট নিলো না। মিস ফাতিমা জিন্নাহ মিলিটারি সেক্রেটারিকে পাঠালেন আরেকটি অ্যাম্বুলেন্স আনার জন্য। অ্যাম্বুলেন্সে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা এবং নার্স ও পরিচারকরা বাতাস দেওয়া সত্ত্বেও কায়দে আজম ঘামছেন। আমরা তাঁকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে বড় গাড়িতে তোলার কথা ভাবলাম, কিন্তু সেই গাড়িতে ষ্ট্রেচার ওঠানো যাবে না এবং তিনি এত দুর্বল যে পেছনের আসনে ঝাঁকুনির ধকল সহ্য করতে পারবেন না। ঘামে তাঁর জামাকাপড় ভিজে গেছে, প্রবাহিত প্রবল বাতাসে তাঁকে বাইরে বের করাও ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁর নাড়ির স্পন্দন দুর্বল ও অনিয়মিত হয়ে আসছে দেখে চমকে ওঠলাম। আমাদের মালপত্র বহনকারী ট্রাক থেকে গরম চা ভর্তি থার্মোফ্লাস্ক নিয়ে ফিরে এলাম। মিস ফাতিমা জিন্নাহ তড়িঘড়ি তাঁকে এক কাপ চা ঢেলে দিলেন। মিস জিন্নাহকে বললাম তাঁর চা পান করা ভালো লক্ষণ। অ্যাম্বুলেন্সটি বিকল হয়ে পড়ার পীড়াদায়ক ঘটনা ছাড়া সবকিছু রোগীর অনুকূলে চলছিল। বিমান যাত্রায় ভালোভাবে টিকে থাকার পর তাঁকে যদি এভাবে রাস্তার পাশে মৃত্যুবরণ করতে হয়, তাহলে এর চেয়ে বিপর্যয়কর আর কিছু হতে পারে না। বেড়ে চলা উদ্বেগের মধ্যে আমি আবারও তাঁর নাড়ি পরীক্ষা করলাম, চা পান তাঁকে বেশ চাঙ্গা করেছে। নাড়ির স্পন্দন বেড়েছে ও আগের চেয়ে নিয়মিত হয়েছে। আমি বিভ্রান্তের মতো শহরের দিকে তাকাচ্ছিলাম, কিন্তু দৃষ্টিসীমার কোথায়ও কোনো অ্যাম্বুলেন্সের নিশানা দেখা যাচ্ছিল না। দীর্ঘ বিরক্তিকর বিলম্বের পর অবশেষে অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছলো। কায়দে আজমকে দ্রুত নতুন অ্যাম্বুলেন্সে স্থানান্তর করে আমরা পুনরায় আমাদের অসুখকর বাধাপ্রাপ্ত যাত্রা শুরু করলাম। অ্যাম্বুলেন্সে গভর্নর জেনারেলের পতাকা ওড়ছিল না, সেজন্য কেউ জানতে পারেনি যে কায়দে আজমকে চরম সঙ্কটজনক অবস্থায় করাচির রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
“মৌরিপুর অ্যারোড্রোমে অবতরণ করার প্রায় দুই ঘন্টা পর সন্ধ্যা ৬টা ১০মিনিটে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছলাম। আমাদের যাত্রার নিরাপদ পরিসমাপ্তির স্বস্থি বর্ণনা করা কঠিন, কারণ এ যাত্রা চরম বিপর্যয়কর বলে প্রমাণিত হতে পারতো। অ্যাম্বুলেন্স কায়দে আজমের রুমের ঠিক সামনে নেওয়া হয়। একটি ষ্ট্রেচারে ওঠিয়ে তাঁকে রুমে আনার পর আমি তাঁকে বিছানায় শুইয়ে দিতে সহায়তা করি। নার্স তাঁর তাপমাত্রা নেন ও নাড়ির স্পন্দন পরীক্ষা স্বাভাবিক বলে জানান। তাঁর অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে আমি মিলিটারি সেক্রেটারির রুমে যাই এবং এক চাপ চায়ের জন্য অনুরোধ করি। সকালে নাশতার পর আমি আর কিছু খাইনি এবং ভীষণ ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত ছিলাম। হাত মুখ ধোয়ার পর আমি পর পর চার কাপ কড়া চা পান করি। কয়েক মিনিট পর কায়দে আজমের রুমে যাওয়ার পর ডা: মিস্ত্রি ও আমি দেখতে পাই যে তিনি ঘুমাচ্ছেন। ডা: মিস্ত্রি তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য এক ঘন্টার ছুটি নেন এবং আমি কর্নেল নোলসকে বলি কর্নেল এম, এইচ শাহকে ফোন করতে, যাতে তিনি রাতের জন্য একজন নার্সের ব্যবস্থা করেন এবং তাঁর সঙ্গে একটি এনেমা ক্যান (Enema Can) পাঠান। কর্নেল শাহের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হলো না। আমরা জিন্নাহ সেন্ট্রাল হসপিটালের সার্জন কর্নেল সাঈদ আহমেদকে ফোন করি। তিনি ঠিক তখনই একটি অপারেশন শুরু করায় তাকেও পাওয়া গেল না। এরপর আমি নিজেই কর্নেল শাহকে খুঁজতে বের হলাম, যাতে আমি নিজেই একজন নার্স ও এনেমা ক্যান নিয়ে আসতে পারি। কর্নেল শাহ তার বাড়িতে বা হাসপাতালেও ছিলেন না। একটি অপারেশনের মাঝখানে কর্নেল সাঈদ আহমেদের বিঘ্ন না ঘটিয়ে আমি নার্সেস হোমে গিয়ে শুধু মেট্টনকে পাই, সেখানে কোনো অভিজ্ঞ নার্স ছিল না। আমি ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হয়ে ওঠি এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি।
মৌরিপুর অ্যারোড্রোমে অবতরণ করার মুহূর্ত থেকে সবকিছু এলোমেলো হতে শুরু হয়েছে। আমার মনে হচ্ছিল, রাতের বেলায় কর্তব্য পালনের জন্য যদি কোয়েটা থেকে একজন নার্স নিয়ে আসার ব্যাপারে মিস ফাতিমা জিন্নাহকে পীড়াপীড়ি করতাম, তাহলে সেটাই ভালো হতো। কিন্তু আমার পক্ষে কীভাবে কল্পনা করা সম্ভব যে, করাচিতে একজন নার্স পাওয়া এত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কর্নেল শাহকে খুঁজে পাওয়ার জন্য আবার বের হলাম। তখন রাত প্রায় ৮টা, কিন্তু তিনি বাড়িতে ফিরেননি। কিন্তু তার বাড়িতে দেখা হলো ডা: আর, এ শাহের সঙ্গে, যেখানে তিনি ও তার পরিবার একত্রিত হয়েছেন। অভিশপ্ত করাচিতে আমার অতি উত্তেজিত স্নায়ুকে স্বস্থি দিতে চাইছিলাম। কায়দে আজমকে নিয়ে আমার তাৎক্ষণিক কোনো দু:শ্চিন্তা নেই। তাঁর প্রতি খেয়াল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় লোকজন রয়েছেন। সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে ডা: মিস্ত্রির ফিরে আসার কথা। তবুও আমি নিজেকে সন্তুষ্ট করতে চাইছিলাম, যাতে আমি স্বস্থির সঙ্গে ডিনার করতে পারি। আমি সোজা গভর্নর জেনারেলের ভবনে গেলাম। মিলিটারি সেক্রেটারি একজন নার্স খুঁজে পেতে সফল হয়েছেন দেখে আনন্দিত হলাম।
রাত সাড়ে ৮টায় আমি লেফটেন্যান্ট মাজহারকে মিস ফাতিমা জিন্নাহকে জানাতে বললাম যে আমি হোটেলে ডিনার করতে যাওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করে কায়দে আজমের অবস্থা সম্পর্কে তাঁর কাছে জানতে চাই। আমাকে জানানো হলো কায়দে আজম দুই ঘন্টা যাবত শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন। পনেরো মিনিট পর আমি মিলিটারি সেক্রেটারির কাছে জানতে চাইলাম যে আমার বার্তাটি মিস জিন্নাহ’র কাছে পৌঁছানো হয়েছে কিনা। তার ধারণা বার্তাটি অবশ্যই পৌঁছানো হয়েছে, কিন্তু কেন এর উত্তর আসেনি, সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে পারেন না। রাত পোনে ন’টায় আমি তাকে বললাম সবকিছু যেহেতু ঠিকভাবে চলছে বলে মনে হচ্ছে এবং আমরা একটু পরই ফিরে আসছি, এই অবসরে আমি হেটেলে গিয়ে দ্রুত ডিনার সেরে নেব। আমি করাচিতে আমার অবস্থানস্থল প্যালেস হোটেলে পৌঁছে তড়িঘড়ি কিছু খেয়ে গভর্নর জেনারেলের ভবনে টেলিফোন করার জন্য বের হলাম, যাতে আমার জন্য একটি গাড়ি পাঠানো হয়। ঠিক তখনই হোটেলের রিসেপশন ক্লার্ক আমাকে একটি মেসেজ দিল যাতে আমি অবিলম্বে এডিসিকে ফোন করি। ফোন করার পর জানতে পারলাম যে কায়দে আজমের নাড়ির স্পন্দন অনিয়মিত হয়ে পড়েছে এবং অবিলম্বে আমার সেখানে পৌঁছা প্রয়োজন। এডিসিকে বললাম দ্রুত গাড়ি পাঠাতে।
আমি রাত সোয়া ন’টায় কায়দে আজমের পাশে উপস্থিত হয়ে তাঁকে পরীক্ষা করে দেখতে পেলাম তাঁর নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ এবং অনিয়মিত এবং শরীর ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়ার সঙ্গে শীতল ঘাম বের হচ্ছে। এর কারণ নির্ণয়ের আগে আমি তাঁকে হৃদপিণ্ড সক্রিয় রাখার একটি ইঞ্জেকশন দিলাম এবং তাঁর মুখে দেওয়ার জন্য একটি সার্কুলেটরি হার্ট ষ্টিমুল্যান্ট চাইলাম। কিন্তু তিনি গিলতে পারলেন না এবং মুখের কোনা দিয়ে ওষুধ গড়িয়ে পড়লো। আমি তখন তাঁর বিছানার পায়া উঁচু করার জন্য কিছু ইট অথবা কিছু কাঠের টুকরা আনতে বললাম এবং তাঁর পায়ে ব্যাণ্ডেজ বাঁধলাম, যাতে শরীরের কেন্দ্রীয় অংশে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়। গভর্নর জেনারেলের ভবনে এসব উপকরণ পাওয়া কঠিন, সেজন্য আমি নিজেই বিছানার পায়ের অংশ তুলে ধরতে চেষ্টা করলাম। বিছানা অত্যন্ত ভারি এবং যদিও আমার পক্ষে ছয় ইঞ্চি পরিমাণ উঁচুতে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু আমি খুব বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারিনি। মিস জিন্নাহ আমাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু আমি তাঁকে অনুরোধ করি শক্তি প্রয়োগ না করতে এবং যেহেতু ইট পাওয়া যাচ্ছে না, সেজন্য কিছু বই নিয়ে আসতে বলি। আমাদের এসব প্রচেষ্টা তাঁর নাড়ির স্পন্দন বৃদ্ধিতে লক্ষ্যণীয় কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আমি যখন প্রায় উন্মত্তের মতো আমার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম তখন ডা: মিস্ত্রি ও ডা: শাহ উপস্থিত হলেন। আমি ডা: শাহকে বললাম কায়দে আজমের শিরায় ইঞ্জেকশন দিতে। ইঞ্জেকশন দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা সত্ত্বেও তিনি ইঞ্জেকশন দিতে ব্যর্থ হলেন। কারণ তাঁর শিরাগুলো বসে গিয়েছিল এবং শিরা রক্ত চলাচলের উপযোগী ছিল না।
আরেকটি ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর আমি কায়দে আজমকে আশ্বস্ত করার কণ্ঠে বললাম, “স্যার, আপনাকে সমর্থ করে তোলার জন্য আমরা একটি ইঞ্জেকশন দিয়েছি এবং শিগগিরই এটি কাজ করতে শুরু করবে। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি বেঁচে থাকবেন।” কায়দে আজম তাঁর মাথা নাড়লেন এবং অতি ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, “না, আমি বাঁচবো না।” মৃত্যুর প্রায় আধা ঘন্টা আগে এই শব্দ ক’টিই ছিল কারও কাছে উচ্চারিত তাঁর শেষ কথা। মিস ফাতিমা জিন্নাহ তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল ছিলেন। তখন রুমে ছিলাম আমরা তিন ডাক্তার, মিস জিন্নাহ ও একজন নার্স। রাত দশটায় নাড়ির স্পন্দন সামান্য বাড়তে শুরু করলে আমরা মৃদু আশা করতে থাকি। কিন্তু দশ মিনিট পরই নাড়ি আবার ক্ষীণ এবং প্রায় স্পন্দনহীন হয়ে পড়ে। রাত ১০টা ২০ মিনিটে আমি তাঁর কব্জিতে আঙুল রেখে আর নাড়ি অনুভব করতে পারিনি। আমি যখন বুকে ষ্টেথোস্কোপ রাখি তখন আর হৃদপিণ্ডের কোনো শব্দ শুনতে পাইনি। কায়দে আজম মারা গেছেন।”
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু, উপদেষ্টা সম্পাদক- উইকলি বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক। সাবেক সম্পাদক- মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট।