চলে গেলেন আশির দশকের অন্যতম কবি মুকুল চৌধুরী। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) দিবাগত রাত দেড়টার দিকে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন সিলেটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন। মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন।
মুকুল চৌধুরী বাংলা কবিতায় নিজস্ব দৃষ্টি ও সৃষ্টির নতুন বাঁক নির্মাণ করেছেন। মত এবং পথ নিয়ে ভিন্নতা আনতে চেষ্টা করেছেন সজ্ঞানে, সচেতনভাবে। কবিতার কারিগর হিসেবে সেই আশির দশক থেকে সৌরভে গৌরবে এগিয়ে চলেছেন। তার কবিতায় উঠে এসেছে, আকাশ, নক্ষত্র, নদী, বৃষ্টি, পাহাড়, জ্যোৎস্না, গাছগাছালি, জীবন-জীবিকা, আশা ও ভালবাসা। তার পংক্তিমালায় জ্যোতির্ময় কাব্যসত্তা বহমান।
কবিতার আবেগঘন সবুজ জমিনে এক সরব পরিব্রাজক তিনি। চার দশকের অধিক বিরামহীন হেঁটে হেঁটে মাড়িয়েছেন কবিতার নতুন নতুন দেশ ও প্রদেশ। মুকুল চৌধুরীর সৃজনবিশ্বে দৃশ্যমান ভাবের সমুদ্র। আধ্যাত্ম-মরম, মানুষের মানচিত্রে মুক্তির যুদ্ধ, প্রিয়তমার গান্ধর্ব ঘ্রাণ, উম্মার সোয়াশো কোটি হাহাকার।
অস্পষ্ট বন্দর থেকে মাটির ঘটনা কালের সবুজপত্রে মোড়া তার সকল সৃজনকর্মের ঋদ্ধ মলাটের মুখচ্ছবিগুলোও স্বকীয়-স্বতন্ত্র। নিরীক্ষা প্রয়াসের সার্থক পাপড়ি। আলাদা স্বরের গায়ক পাপিয়া। স্বতন্তরের স্বননে কোনটি শিকড়সন্ধানী। কোনটি আবেগমন্ত্রিত-ইতিহাস ঐতিহ্যে আত্মত্রাণের পথপদর্শক। কোনটি গার্হস্থ্য প্রেমের রাহসিক প্রস্রবন। কোনটি আধ্যাত্ম-হৃদয়ের অতল আশ্চর্য অনুভবে গরীয়ান। এ অনুভব বন্ধুর আধ্যাত্মিক পর্যটনে রূপান্তরিত। এ রূপান্তর শিল্পাত্মার যৌথতায় শব্দভূগোলেও অনন্য।
বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি ও কথাশিল্পী আল মাহমুদ বলেছিলেন, মুকুল চৌধুরী প্রতিভাবান কবি। বিবেকবান কবি। তার দেখার চোখ আছে। তিনি স্বপ্ন ও কল্পনাকে সাজাতে জানেন। তার ভাষা নমনীয় এবং ভাষার যে ছন্দ চাতুরী, তার কবিতায় তাও বহমান। এই গুনগুলো নিয়ে একজন কবি বড়ো কবি হতে পারেন। মুকুল চৌধুরীর এই গুণগুলোকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমি মনে করি যে, মুকুল চৌধুরী একজন প্রকৃত কবি। আমাদের মধ্যে যে কয়জন প্রকৃত কবি আবির্ভূত হয়েছেন, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন, আশির দশকের কবিতার একটি চারিত্রলক্ষণ- কবিতার ছন্দ-মিলে প্রত্যাবর্তন- মুকুল চৌধুরীর কবিতায় প্রথম থেকেই স্পষ্টভাবে দেখা দিয়েছে।.. বিষয়ের দিক থেকে আদর্শিকতার অনুধ্যান আর আঙ্গিকের দিক থেকে ছন্দ-মিলে সমর্পন.. আশির দশকের কবিদের মধ্যে তাকে একটি স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
‘পাতলা কুয়াশা গায়ে মেখে কিশোর বাড়ি ফিরছে,/ ফিরতে ফিরতে খড়ের চুল্লির পাশে হিম-হাত সেঁকা।/ ফিরতে ফিরতে অন্ধকার, চাঁদের লণ্ঠনে পথ দেখা।/ ফিরতে ফিরতে বিকেলের সুখ ভোরের চাঁদের মতো ফিকে হয়ে যাওয়া।/ এক ফাঁকে/ মায়ের বকুনীর পিছে পিছে পিঁপড়ার আগে আগে/ পড়ার টেবিলে হাঁটে পিঠা আর পায়েসের বাটি।/ কে বেশি মোহিত হয়, পিঁপড়া না শীতের পিঠা?/ কে বেশি আনন্দ পায়, পিঠা না মায়ের মুখ?/ বরাবর শীত এলে এইসব স্মৃতির প্রবাল/ বারবার খুঁজে খুঁজে হন্যে হয় একটি লাটাই,/ যেখানে মাঞ্জা দেওয়া সুতোর ভেতর/ আমার কিশোর-বেলা লুকিয়েছিল শীতের সন্ধ্যায়।’
‘ঢালু বেয়ে ওঠে আসছে মেঘ। ঢালু বেয়ে ওঠে আসছো তুমিও।/ করিডোরে আমি কার দর্শনার্থী?/ মেঘকে বলি, হে মেঘ-আমি তো কালিদাস নই!/ তোমাকেও বলি, ওগো মেয়ে-আমি তোমার কে?/ কতো জনমের চেনা?/ জবাব না পেয়ে সতের বছর ধরে লেখা বিরহ-গাথা থেকে/ কয়েক পঙ্ক্তি আবৃত্তি করবো বলে যেই না/ ঝোলা ব্যাগে হাত ঢুকিয়েছি-/ তুমি বললে বৃষ্টি থামুক! নয়তো বৃষ্টির ঝাপটায়/ সব বিরহ-উপমা মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যাবে/ আমি বললাম-হ্যাঁ, আমার বিরহ-গাথা কেন?/ উপমান যেখানে সশরীরে হাজির, সেখানে শব্দের অভিঘাতের চেয়ে/ নন্দনের আনন্দই শ্রেয়।
এমন অসংখ্য জীবনধর্মী কবিতার স্রষ্টা মুকুল চৌধুরী মনের ক্যানভাসে নান্দনিকতার আঁচড়ে জীবন কথনের ছবি আঁকেন। তাই তার কবিতায় প্রস্ফুটিত হয় চির নতুনের এক অনিবার্য সন্নিবেশ। চেতনার অভিব্যক্তিকে নাড়া দিয়ে মনের ঘুমন্ত সত্তাকে জাগিয়ে তোলে তার কবিতা।
‘নিঃস্রোত নদীর দু’পাড়ে ঝাউগাছের বদলে এখন ইটের স্তূপ।/ ট্রাক নামক দৈত্যের উদরপূর্তির অপেক্ষায় বালি আর কংক্রিটের অট্টহাসিতে/ হাঁপিয়ে উঠছে প্রাচীন অশ্বত্থ। সেই আলপথও নেই। বিশাল অজগরের মতো/ শুয়ে থাকা পাকা সড়কের নীচে ঘনঘাসের সাথে মুছে গেছে তার রেখা।/ টেলিগ্রাফ থামের উত্তরসূরি হয়েছে বহুজাতিকের মোবাইল এ্যান্টিন্যা। ছাতা-মাথার/ কৃষক যখন পাওয়ার টিলারে বসে বিঘার পর বিঘা, একরের পর একর/ চষে বেড়ায়; দূরের গরুগুলো তখন মনোবেদনায় জাবরকাটাও ভুলে যায়।’
‘আমাদের দিন ও রাত্রি, আমাদের সকাল ও সন্ধ্যা/ আমাদের ঝড় ও রৌদ্র, আমাদের মেঘ ও বৃষ্টি;/ সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, টাইফুন অথবা সাম্প্রতিক সুনামির মতো/ দুঃস্বপ্নও ধুয়ে-মুছে যায়, শুকিয়ে যায় ক্ষতচিহ্ন।/ যথারীতি সূর্য ওঠে, পৃথিবীতে রোদ খেলা করে/ বাতাসে ক্লোরোফিলও জমে।/ পেশীতে শক্তি ফিরে এলে মনের মেঘও কেটে যায়। গাছের পাতাও ঝরে, কিন্তু ঝরে না মনের পাতা।’
এভাবে আমাদের জীবন ঘনিষ্ঠ কবিতা লিখে মুকুল চৌধুরী গণমানুষের মনে নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছেন। জন্মদিন শিরোনামের কবিতায় অসাধারণভাবে বলেছেন-
‘জন্মের ক্রন্দন শোনে ঐদিন কোন্ পাখি হারিয়েছিল পথ,/ কোন্ ফুল ফুটেছিল মৃত-বসুধায়,/ পাতার মর্মরে কার ধ্যান ভাঙে, কার গানে জ্যোৎস্নার প্লাবন?’
‘পঞ্চাশ পেরিয়ে আজ একান্ন শরৎ। সূর্যস্নাত সকাল,/ তীব্রতাপ দুপুর পেরিয়ে বিষণ্ণ বিকেল।/ করুণ সন্ধ্যা সমাগত!/ পর্দা উঠছে, পর্দা নামছে/ দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে অসফল অভিনয়ে মঞ্চ কেঁপে ওঠে।/ অথচ মনে হয় এই তো সেদিন, বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের সাথে/ জনান্তিকে হারিয়ে গিয়েছিল কম্পনহীন প্রথম কান্নার স্বর।’
কবির মমতায় উচ্চারিত কবিতার পঙ্ক্তি সমূহ বাংলা সাহিত্যের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
‘নরম রোদের তেজে আলপথে গঙ্গাফড়িং ধরতে গিয়ে বান্নী থেকে কিনে আনা/ নাকফুল হারিয়েছে বলে কিশোরীর নিষ্পাপ মুখখানি গাঙপাড়ের/ কাদামাটির রঙ ধরেছে।/ বেলা বেড়ে গেলে ভরপেট স্কুলের মেঠোপথ। সীমান্ত প্রহরীর মতো গ্রামের প্রবেশ পথে/ দাঁড়িয়ে থাকা শত বছরের অশ্বত্থের ছায়া গায়ে মেখে ছাতা-মাথার কৃষকের/ বীজ বপনের কলা-কৌশল দেখতে দেখতে কাঁটা ঝোপের পাশে স্তূপ করে রাখা/ আধ-মরা টাকি মাছ ডিঙ্গিয়ে স্কুলের মাঠ।’
‘পাশ কাটাতেই ভাটিয়ালির সুরে থৈ থৈ পানিও স্তম্ভিত। সুর ভেসে যায়,/ প্রতিধ্বনি ওঠে। নাতিদূরে নাইয়রী নৌকায়ও ঢেউ তোলে/যে মেয়েটি এই বর্ষায় বাপের বাড়ি যাবে বলে কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুর বাড়িতে/ অপেক্ষার এক হাওর পানি রেখে এসেছে, সেও এই সুরে নিজের বোকামীর লজ্জায়/ বারবার আড়ষ্ট হয়ে পরিতৃপ্ত স্বামীটির গায়ে ঢলে পড়ছে।/ যেভাবে একবার এক নারী শরমের মাথা খেয়ে ঢাকার রাজপথে/ আমার সহ-সোয়ারী হয়েছিল।/ বৃষ্টির প্ররোচণায় শাহবাগের মোড়ে/ যখন তার হাত ধরেছি, তখনও সে বৃষ্টির গুঞ্জনের সাথে/ জীবনের গানকে মিলাতে পারেনি। কি বর্ষা, কি শরৎ-/ আকাশে মেঘ জমলেই আমার সে নারীর বৃষ্টিসিক্ত মুখটি মনে পড়ে যায়।/..আলপথ-মেঠোপথ-কাদাপথ মাড়িয়ে এক কিশোর জীবনের ডিঙ্গিতে চড়ে এ অবধি এসেছি।/ কিন্তু শাহবাগের মোড়ে গেলেই বৃষ্টির ঝাপটার ভেতরও/ চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো সেই মুখটিই খুঁজতে থাকি?’
‘তুমি বলেছিলে বসন্তের পয়লা ফাল্গুনে তোমাকে হলুদ শাড়ি কিনে দিতে হবে।/ অথচ হলুদে আমার অনীহা। হলুদ মানেই তো বিরহ, বুকের বামপাশে চিনচিন ব্যথা।/আমার কাছে লেখা তোমার নীল খামগুলো এখনও হলুদ বা বিবর্ণ হয়নি।/.. তোমার অন্তরভূমি পড়ি। প্রেমপাত্রে হৃদয় ভেজাই/অবশ্য আমি একবার বিরহের লোভে এক হলুদ বাগানে ঢুকে পড়েছিলাম।/ আমার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাগানের কিষানী তার রঙমরা হলুদপাড় শাড়ি/ আকাশে মেলে ধরলে সূর্যও মধ্য-আকাশে থমকে দাঁড়িয়েছিল। সেই থেকে/ হলুদে আমার ভয়। হলুদের প্রসঙ্গ উঠলেই আমারও কৃষ্ণপক্ষ শুরু হয়ে যায়।/.. আমি রঙ বুঝি না মেয়ে, আমি বুঝি মন। আমি ফাল্গুন কিংবা বসন্তও মানি না,/ আমি মানি ঋতুর প্রকারভেদ।’
মুকুল চৌধুরীর কবিতা নিয়ে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। মূলত আশিতে আধুনিক কবিতা নিয়ে শুরু হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা। রোববার, বিচিত্রা, পূর্বাণী সহ বেশ কিছু সাপ্তাহিকী ঈদসংখ্যায় বিশেষ কবিতা প্রকাশ করতো। নতুনেরা সেখানে ছিলেন অনুপস্থিত। আবিদ আজাদ শিল্পতরু’র মাধ্যমে নতুনদের নিয়ে কাব্য গগণে আলোড়ন তুলেছিলেন। নিউ মার্কেট, বাংলাবাজার ও পুরানা পল্টন কেন্দ্রিক আরো কিছু লিটল ম্যাগাজিন ব্যাপক সাড়া জাগায়।
ষাট ও সত্তরে তন্ময় কবিতা মন্ময় হতে থাকে। প্রাধান্য পেতে থাকে বক্তব্যের চেয়ে নান্দনিকতা। বাংলা কবিতায় নতুন বাঁক নির্মাণ করেন বেশ ক’জন। এরমধ্যে মুকুল চৌধুরী ছাড়াও আবদুল হাই শিকদার, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, চৌধুরী গোলাম মওলা, তমিজ উদ্দীন লোদী, নিজাম উদ্দিন সালেহ, মোশাররফ হোসেন খান, মতিউর রহমান মল্লিক, রেজাউদ্দিন স্টালিন, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, সোলায়মান আহসান প্রমুখ ছিলেন আশির দশকের অগ্রগণ্য কবি।
কবিতার ভাষা, অলঙ্কার, ছন্দ ও প্রকরণ নিয়ে নতুন বাঁক নির্মাণে আরো যারা সক্রিয় ছিলেন তাদের মধ্যে আমিনুর রহমান সুলতান, আহমেদ মুজিব, ওমর কায়সার, কাজল শাহনেওয়াজ, কামরুল হাসান, কফিল আহমেদ, খন্দকার আশরাফ হোসেন, জুয়েল মাজহার, তুষার দাশ, নাসিমা সুলতানা, ফরিদ কবির, বিষ্ণু বিশ্বাস, মঈন চৌধুরী, মাসুদ খান, মোহাম্মদ সাদিক, মজিদ মাহমুদ, মহীবুল আজিজ, রিফাত চৌধুরী, শান্তনু চৌধুরী, শোয়েব শাদাব, সাজ্জাদ শরিফ, সৈয়দ তারিক, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, সরকার মাসুদ, সুহিতা সুলতানা, হাসান আলীম প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
কবিতায় মধ্যবিত্ত জীবনের আকাঙ্ক্ষার স্বরূপ নির্মাণে নিজস্ব শক্তিমত্তায় ঋদ্ধ করেছেন মুকুল চৌধুরী। কবিতায় তিনি নিজস্ব দর্শন ও কাব্যের আধুনিক মননশৈলী নির্মাণে সফল হয়েছেন। ইতিহাসের গলিপথ হেঁটে সমকালকে চিত্রিত করতে কবি উল্লেখ করেন-
‘আমাকে মাপছো তোমাদের দাঁড়িপাল্লায়, মাপো-/তবে বাটখারাটা পাল্টাও;/ওটাতো ঢাকার পিচ রাস্তার মতো ক্ষয়ে গেছে।/ ওজন দেবে দাও, তবে ভাবছো কেন-/ আমিও বাগদাদের বাজারে এক দখলদার মার্কিনী ক্রেতা!/ আমি তো মাপের বস্তুই। যেভাবে দামের আগুন থেকে কাঁচা মরিচ-পিঁয়াজ,/ লবণ-রসুন, আলু ও পটল ওঠে তৃষ্ণার্ত পাল্লায়-/ ঢুকে নিষিদ্ধ পলিথিনে;/ সেভাবে আমিও বাজারের পণ্য হয়েছি। যেনো মধ্যপ্রাচ্যের সাদা সোনা/ অথবা উত্তর-দক্ষিণের সিংহ-দরোজা খাইবার অতিক্রম করলেই/ উষ্ণ সাগরের লোনা পানি।/ ঋতুভেদে মূল্য ওঠে কম বা বেশি-/ কখনও নব্য-জার কখনও ইয়াংকিরা দাম হাঁকে/ তবুও কি বিনামূল্যে হেসেলে পেয়েছো?’/ সেই ঘৃণ্য বাণিজ্য-খেলায় অসহায় মানবতা-/
‘মাপছো, মাপো-সময়ের বাটখারায় তুলে কিলোগ্রাম/ অথবা লিটারে। দোহাই তোমাদের, কেটেকুটে রক্তাক্ত করো না।/ অন্তত সেইসব দিন-ঝড়, ঘূর্ণি অথবা সুনামির ধ্বংসস্তূপে/ কে লাগিয়েছে ত্রাণ-হাত; আহত লোমকূপে দিয়েছিল জীবনের শ্বাস/ সেই নামটি পড়ো,-এখনও লেখা আছে ধ্রুপদী পৃষ্ঠায়।/ সাদা ফ্লুয়িড দিয়ে যতেই ঢাকা যাক, কালো কলমের দাগ/ বন্ধুকৃত্যের মতোই অক্ষয়-/ মেঘ ভেদ করে যেভাবে বর্ষার সন্ধ্যাকাশে উঁকি দেয় উজ্জ্বল লুব্ধক।’
‘আবু জেহেলের তাঁবু থেকে সত্যের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে/ বেরিয়ে আসছে বিভেদ সৃষ্টিকারী কালো শয়তান।/ এগিয়ে আসছে দাম্ভিক আবরাহা, তার হস্তীবাহিনী এবং/ আকাশের একঝাঁক আবাবিল বেহেশতের পক্ষিকুল।’
মুকুল চৌধুরীর জীবনদৃষ্টি উদার-মানবিক এবং ঐশী শক্তিতে পূর্ণ। কবিতায় তার নিবেদন ডালপালা মেলে রূপ নেয় সার্বজনীনতার কণ্ঠস্বরে। কবি ও কবিতা এভাবেই পাঠকের প্রিয় হয়ে ওঠে-ঠাঁই করে নেয় পাঠকের হৃদয়ে, অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে জীবনের জীবাত্মার।
কবিতার পাশাপাশি গদ্যেও একটা শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করেছেন তিনি। প্রবন্ধ-নিবন্ধেও মুকুল চৌধুরী অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা। তার ভাষাভঙ্গি, বাক্যবিন্যাস, শব্দ নির্বাচন, বিবরণ ও তথ্যের সমাবেশ গদ্য রচনায় বিপুল বিস্ময় বার বার পাঠকদের আন্দোলিত করেছে। এগুলো বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হয়ে থাকবে।
মুকুল চৌধুরী ১৯৫৮ সালের ২২ আগস্ট পূণ্যভূমি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের অর্ধশতাব্দী কাল সাহিত্যের সবুজ জমিনে চাষ বাস করেছেন।
ইতোমধ্যে আটটি কাব্যগ্রন্থ, পাঁচটি কিশোরগ্রন্থ, সাতটি প্রবন্ধ-গবেষণাগ্রন্থ এবং বেশ কয়েকটি সম্পাদিত গ্রন্থ মিলে গ্রন্থসংখ্যা আটাশে পৌঁছে গেছে।
২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতাসমগ্র। এতে যুক্ত করা হয়েছে পাঠমূল্যায়ন এবং পরিশিষ্ট। কবিকে সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
কবির প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: অস্পষ্ট বন্দর (কাব্য-১৯৯১), ফেলে আসা সুগন্ধি রুমাল (কাব্য-১৯৯৪), চা বারান্দার মুখ (কাব্য-১৯৯৭), সোয়াশ’ কোটি কবর (কাব্য-২০০৩), নির্বাচিত প্রেমের কবিতা (২০১০), অপার্থিব সফরনামা (কাব্য-২০১১), ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আফগানস্তান (প্রবন্ধ-১৯৮৩), কবি ও কবিতার প্রতি রসূল (সা.)-এর অনুরাগ ও উৎসাহ (প্রবন্ধ-২০০৩), পথিকৃৎ দশ মনীষী (প্রবন্ধ-২০০৪), বাংলাদেশের স্বতন্ত্র সাহিত্য ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০০৬), আফজাল চৌধুরী : কবি ও কবিতা (প্রবন্ধ-২০০৮), চাঁদের কথা (কিশোর রচনা-১৯৯৪), মানুষের চন্দ্রবিজয় (কিশোর রচনা-২০০৩), সেই দীপ্ত শপথ (কিশোর রচনা-২০০৩), সোনালী বিশ্বাস (কিশোর রচনা-২০০৪), ইসলামের প্রথম মিছিল (কিশোর রচনা-২০০৪), আমাদের মিলিত সংগ্রাম মওলানা ভাসানীর নাম (যৌথ সম্পাদনা-১৯৮৬), অগ্রপথিক সংকলন : ভাষা আন্দোলন (সম্পাদনা-১৯৯৩), রাসূলের (সা.) শানে কবিতা (যৌথ সম্পাদনা-১৯৯৬), সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মহানবী (সা.) (সম্পাদনা-২০০৫), মহানবী (সা.)-কে নিবেদিত কবিতা (সম্পাদনা-২০০৫), বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীকে নিবেদিত কবিতা (সম্পাদনা-২০১০) ইত্যাদি।
খ্যাতিমান কবি মুকুল চৌধুরী তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরুপ অনেক সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি লাভ করেছেন বুক অব দি ইয়ার এচিভম্যান্ট এওয়ার্ড, বিএনএসএ, ইংল্যান্ড (১৯৯৬); সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ, ঢাকা (১৯৯৭); রাগীব রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার, সিলেট (২০০৬); জালালাবাদ সাহিত্য পুরস্কার, সিলেট (২০১২)।
• সাঈদ চৌধুরী কবি ও কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক: দৈনিক সময় ও মানব টিভি